ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রফেসর মোঃ হামিদুল হক

অতিমারীতে অতিকথন

প্রকাশিত: ২০:১৫, ১ আগস্ট ২০২১

অতিমারীতে অতিকথন

বর্তমান ভয়াবহ দুঃসময়ে আমাদের সবাইকে প্রিয় মাতৃভূমি ও দেশের মানুষকে নিয়ে নিজ নিজ বৃত্তের ভেতরে থেকেই ভাবতে হবে। মহামারী নিয়ন্ত্রণ সরকারের একার পক্ষে অসম্ভব। তাই এগিয়ে আসতে হবে সকল মানুষকে। মনে রাখতে হবে ‘অন্ধ হলে কখনও প্রলয় বন্ধ থাকে না’ অবশেষে সব আশঙ্কাকে সত্য করে বাংলাদেশে দিনে দিনে কোভিড সংক্রমণ ভয়াবহ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বিগত দেড় বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে করোনাভাইরাসের যে ভয়াবহতা আলোচিত হচ্ছে, ২০২১ সালের জুন মাসে এসে তা স্বরূপে আবির্ভূত হলো। গত এক সপ্তাহে ধরে জ্যামিতিক হারে যেভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে চলছে, তাতে আগামী কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি কোথায় পৌঁছবে তা ভাবলে শিহরিত হতে হয়। এ মুহূর্তে সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে যে পরিস্থিতি তা আমাদের আতঙ্কিত করছে। তিল ধারণের যায়গা নেই কোথাও। ভেন্টিলেটর, আইসিইউ তো দূরের কথা সাধারণ শয্যা এমনকি হাসপাতালের মেঝেতেও রোগীর ঠাঁই মেলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবরে জানা যায় হাসপাতালের মেঝে, করিডর এমনকি হাসপাতালের সামনে গাছতলায় রোগীকে রেখে অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী সবাই ক্লান্ত, শ্রান্ত। সেবা দিতে গিয়ে অনেকেই আক্রান্ত। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। প্রতিদিন দিনশেষে রেকর্ড হচ্ছে আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা। এভাবে আর কতদিন? এর সমাধান কী? সরকারের স্বাস্থ্য কাঠামো, জনবল, স্বাস্থ্য উপকরণ, চিকিৎসা সামগ্রী সবটিরই সীমাবদ্ধতা আছে। রাতারাতি একটা দেশকে তো হাসপাতাল বানিয়ে ফেলা যায় না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যমান স্বাস্থ্য কাঠামোয় উপনীত হতে সময় লেগেছে কয়েক শ’ বছর। তাই এ ভয়াবহ মহামারী ঠেকাতে শুধু হাসপাতাল, নার্স আর সরকারের ওপর নির্ভর করলে মারাত্মক ভুলের মাশুল দিতে হবে গোটা জাতিকে। অন্যান্য ভাইরাসের মতো কোভিড-১৯ ভাইরাস নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। যখন কোন ভাইরাস এরূপ নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে তখন পূর্বাবস্থার চেয়ে কিছুটা রেপলিকেট বা পরিবর্তন করে মিউটেশন ঘটতে পারে। ফলে, নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্ম নেয়। ভাইরাসের এ ধরনের মিউটেশন অব্যাহত থাকতে পারে। আর জন্ম নেয়া নতুন ভাইরাসকে মূল ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোন ভাইরাসের বিশ্বময় বিস্তৃতির কারণে যখন অতিমারীর সৃষ্টি হয় তখন বিস্তৃতির সঙ্গে মিউটেশনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ ভাইরাসের আলফা, বিটা ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের স্বীকৃতি দিয়েছে। আবার অতি সম্প্রতি তারা গত মাসে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট নামে ‘ল্যামডা ভ্যারিয়েন্ট’ নামে একটি নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টের প্রথম উপস্থিতি আগস্ট ২০২০ এ নিশ্চিত হয় পেরুতে। এ ভ্যারিয়েন্টটি ইতোমধ্যে আর্জেন্টিনা, চিলি, ইকুয়েডরসহ ৩০টির মতো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে গত ১০ জুলাই সরকারের তথ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো এক বিবরণীতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধ ও মোকাবেলায় জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ কমিটিতে প্রধান শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, স্বাস্থ্য, যুব, কৃষি ও আনসার ভিডিপির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, মসজিদের ইমাম, এনজিও প্রতিনিধি, হাট-বাজার সমিতির নেতাসহ সংশ্লিষ্টরা অন্তর্ভুক্ত হবেন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সুরক্ষা এ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন প্রক্রিয়ার স্থলে ৫ আগস্ট থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে যে কোন নাগরিক নিবন্ধন ছাড়াই টিকা দিতে পারবেন। এদিকে ২৯ জুলাই থেকে সুরক্ষা এ্যাপে ২৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের নাগরিকরা টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারছেন। মহামারী নিয়ন্ত্রণের পথ একটাই সংক্রমণ কমানো হাসপাতাল আর ডাক্তারের কাছে এ সমস্যার সমাধান নেই। এর সমাধান সর্বসাধারণের হাতে। এ মহাদুর্যোগ থেকে উত্তরণের চাবিকাঠি সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন হলেন তার ওপর নির্ভর করছে। সরকার যতই লকডাউন, শাটডাউন, কার্ফু দিক না কেন মানুষ যদি এতে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ না করে তা হলে গোটা বাংলাদেশকে হাসপাতাল বানিয়ে ফেললেও এ দুর্যোগ থেকে নিস্তার নেই। মানুষ কেন এ ধরনের কর্মসূচীতে সার্বজনিনভাবে অংশ নিচ্ছে না? প্রথমতঃ সবাই ভাবছেন এ দায়িত্ব শুধু সরকারের। ভাবছেন অসুখ হবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দায় সরকারের। অসুখ সৃষ্টি তো সরকার করছে না। কোটি কোটি মানুষ যদি অবহেলা, অবজ্ঞা আর দায়িত্বহীন থেকে প্রতিদিন মনের ভুলে সংক্রমণ বাড়াতেই থাকেন, তাহলে কে কার চিকিৎসা দিতে পারবে? এ ভয়াবহ রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অবশ্যই সরকারের হাতে নেই, মানুষকেই এ রোগ নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে এই মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা আমাদের কমিউনিটিকে এ পর্যন্ত পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে পারছি না। আমরা যেন অন্ধকার ঘরে লাঠি হাতে বিষধর সাপকে মারার জন্য ছোটাছুটি করছি। আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিতে যতদিন পর্যন্ত কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা যাবে না, ততদিন পর্যন্ত সংক্রমণ ও মৃত্যুর ভয়াবহতা বাড়তেই থাকবে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় আমাদের এ মুহূর্তে দলমত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলকে সামাজিক সম্পৃক্ততার দিকে দ্রুত মনোযোগ দেয়া উচিত। আশার কথা, ২০২১ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ নির্দেশনার আলোকে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সর্বসাধারণকে কারা জাগিয়ে তুলতে পারেন ১। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ; ২। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ; ৩। শিক্ষক; ৪। সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো; ৫। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ; ৬। এনজিও কর্মীগণ ৭। অন্যান্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিবিধ কর্মসূচী দিচ্ছে, কিন্তু প্রতিটি কর্মসূচী সময়ের পরিক্রমায় কাগুজে বাঘে পরিণত হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক এই কর্মসূচীকে তারা তাদের প্রতিপক্ষ ভাবছেন। এর ফলে কর্মসূচীর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে পুলিশ, আনসার, বিজিবি, এমনকি সেনাবাহিনী নামিয়ে জরিমানা, গ্রেফতার, এমনকি রক্তচক্ষু দেখিয়েও জন¯্রােতকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তাহলে সমাধান কোথায়? সরকার কী লকডাউন বাস্তবায়নে টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ, জলকামান, রাবার বুলেট ইত্যাদি ব্যবহার করে জন¯্রােত নিয়ন্ত্রণ করবেন? আর এতেও কি মানুষের জনসমাগম বা চলাচল নিয়ন্ত্রণ হবে? একটু গভীরে চিন্তা করলে দেখা যাবে সমস্যাটা হচ্ছে এ কর্মসূচীগুলোকে সর্বসাধারণ নিজেদের কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করতে পারছেন না। বরং টেলিভিশনে মানুষের প্রতিক্রিয়ায় অনুমিত হয় যে, তারা ক্ষোভের সঙ্গে এ ধরনের কর্মসূচীকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখছেন। আমাদের ভাবতে হবে কেন সাধারণ মানুষ পরিত্রাণের একমাত্র পথকে নিজের করে ভাবছেন না? এই দিকগুলো বিশ্লেষণ করে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করতে জরুরীভিত্তিতে যে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে সেগুলো হলো- সর্বসাধারণের আন্তরিক অংশগ্রহণ আমাদের জীবনে আমরা কখনই এ ধরনের মহামারীর মুখোমুখি হইনি। বর্তমান প্রজন্মের মানুষ তাদের পারিবারিক, নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চায় কখনই এ অতিমারীর সময়কার জীবনাচার সম্পর্কে অবগত নন। তাই তাদের কাছে সরকার ঘোষিত বিবিধ কর্মসূচী একটি বিশেষ শ্রেণীকে রক্ষার কর্মসূচী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে হঠাৎ করে দু’এক মাসে পৃথিবী থেকে কোভিড মহামারী বিদায় নেবে না। একের পর এক ঢেউ আসবে, কেড়ে নেবে হাজারো লাখো মানুষের জীবন। সার্বজনীন টিকা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতেও সময় দরকার কয়েক বছর। আর হার্ড ইমিউনিটি আসার জন্য অপেক্ষা করলেও সচেতন হয়ে মানুষকেই লড়াই করতে হবে কোভিড ভাইরাসের বিরুদ্ধে। তাই নতুন সাধারণ জীবনের সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষকে যত দ্রুততার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে, ততই দ্রুত মানুষকে সুরক্ষা দেয়া যাবে। তাই এখনই পুরো বিষয়টিকে একটি বড় ক্যানভাসে নিয়ে এসে নতুন করে সাজাতে হবে সকল প্রশাসন যন্ত্রকে। এক্ষেত্রে ডায়রিয়া হলে আগে যেমন মানুষ তরল খাবার গ্রহণ করতেন না, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখন সকল মানুষই জানেন ডায়রিয়া হলে কিভাবে স্যালাইন বানাতে হয়, রোগীকে পর্যাপ্ত তরল পান করাতে হয় - এ ধারণাকে উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে। সামাজিক নেতৃবৃন্দের দায়বদ্ধতা এতবড় জাতীয় দুর্যোগে আমাদের দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যেভাবে অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা থাকার প্রয়োজন ছিল তা যথার্থভাবে সমন্বিত করা যায়নি। অথচ এ দুর্যোগে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে সমাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা দরকার। আসলে তাঁদের মূল ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা আমরা তুলে ধরতে পারছি না। এ অতিমারীর সময় তাঁদের সকলকে মনে রাখতে হবে যে, এ ভাইরাসটি ছড়ায় মানুষ থেকে মানুষে। আর মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে কখনই ওপর থেকে নির্দেশনা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে মানুষের চলাচল ও সমাগম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আর মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারেন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। তাঁদেরকে হাসপাতাল, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ভাবনার পাশাপাশি মনোযোগ দিতে হবে জনগণকে সচেতন করতে। হাসপাতালে যাতে কাউকে যেতে না হয় সেজন্য উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দিতে হবে। চলবে... লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন ও সাবেক মহাপরিচালক জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)
×