ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহান বিশ্বাস

‘মিনু’ এক ট্র্যাজিক গল্পের নায়িকা

প্রকাশিত: ১৯:৫১, ১ আগস্ট ২০২১

‘মিনু’ এক ট্র্যাজিক গল্পের নায়িকা

হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজায় নিজের পরিবর্তে কৌশলে অন্য নারীকে জেল খাটানোর দায়ে কুলসুমী আক্তার কুলসুমী নামের সেই পালিয়ে থাকা নারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার এড়াতে চতুর কুলসুমী বারবার স্থান পরিবর্তন করেছেন। তবে, তাকে নজরদারিতে রাখছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাস্তব জীবনের কোন কোন ঘটনা কখনও কখনও নাটক, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। মনকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে যায় কিছু কিছু ঘটনা। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে। চোখ জলে ভরে ওঠে। চট্টগ্রামের এমনই একটি সাম্প্রতিক ঘটনা অনেকের মনকে নাড়া দিয়েছে। দন্ডপ্রাপ্ত না হয়েও এক অভাবী মা শুধু ছেলেমেয়েদের মুখে একটু ডাল-ভাত তুলে দেয়ার আশ্বাসে নিজের কাঁধে যাবজ্জীবন দন্ড তুলে নিয়েছিলেন। গল্পের ট্র্যাজিক নায়িকার মতো এক সময় দন্ডমুক্ত হন বটে, কিন্তু নাড়িছেঁড়া ধন কোলের ছোট্ট শিশুটিকে আর জীবিত ফিরে পাননি। সন্তানের জন্য পাগলপারা সেই মাকেও শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারাতে হয়েছে এক রহস্যজনক সড়ক দুর্ঘটনায়। সেই ট্র্যাজিক ঘটনার প্রধান চরিত্রের নাম ‘মিনু’। কুমিল্লার ময়নামতির মেয়ে ছিলেন অন্যের হয়ে যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে জেল খাটা সদ্যপ্রয়াত মিনু আক্তার। স্বামী বাবুল ছিলেন ঠেলাগাড়ি চালক। পাঁচ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি বস্তিতে থাকতেন মিনু। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মা ছিলেন। বাবা মোঃ সোলাইমানের বাড়িতে তেমন কিছু ছিল না। একমাত্র ভাই রুবেল মাঝে মধ্যে খোঁজ নিতেন অভাবী বোনের। জীবনকে চালিয়ে নিতে কখনও ভিক্ষা কখনও মানুষের বাসায় কাজ করেছেন মিনু। এভাবেই চলছিল তার কষ্টসহিষ্ণু জীবন সংসার। ২০০৬ সালের ৯ জুলাই- মোবাইল ফোন নিয়ে বিবাদের জেরে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ এলাকায় পোশাক কারখানার কর্মী কোহিনূর খুন হন। ওই ঘটনায় করা মামলায় ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার উপজেলার গৌরস্থান মাঝেরপাড়া গ্রামের আনু মিয়ার মেয়ে কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী গ্রেফতার হন। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পান কুলসুমী। পরবর্তীতে মামলার বিচার শেষে ২০১৭ সালের ৩০ নবেম্বর আদালত এক রায়ে কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদন্ড দেন। রায়ের দিন কুলসুমী আদালতে অনুপস্থিত থাকায় তাকে পলাতক দেখিয়েই রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার জন্য কুলসুমীকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তাই এমন কাউকে তিনি খুঁজতে থাকেন যিনি তার হয়ে সাজা ভোগ করবেন। মর্জিনা নামে এক মহিলার মাধ্যমে মিনু আক্তারকে খুঁজে পান কুলসুমী। সন্তানদের খাওয়া-দাওয়া এবং আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় মিনুকে। বলা হয়, দ্রুতই জামিনে তাকে মুক্ত করে আনা হবে। ২০১৮ সালের ১২ জুন, রমজান মাস। ইফতারি দেয়ার কথা বলে কুলসুমী ও মর্জিনা দুজন মিলে মিনুকে চট্টগ্রাম আদালতে নিয়ে যান। মিনুকে বলা হয়েছিল ‘কুলসুম’ নাম ডাকা হলে তিনি (মিনু) যেন হাত তোলেন। সে অনুযায়ী হাত তোলার পর কর্তৃপক্ষ তাকে ‘কুলসুম’ হিসেবে চিহ্নিত করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকে মিনু ছিলেন কারাবন্দী। অনেকদিন পর কারাগারে বালাম বই খুঁজতে গিয়ে মিনুর বিষয়টি উঠে আসে। পরে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে এটি আদালতের নজরে আনেন চট্টগ্রামের আইনজীবী মুরাদ। মিনু সম্পর্কে তিনি বলেন, ঘটনাটি আলোচনায় আসে মিনুর শিশু মেয়ে জান্নাতকে কেন্দ্র করে। আড়াই বছরের জান্নাতকে ঘরে রেখেই কারাগারে গিয়েছিলেন মিনু। উপায়ান্তর না দেখে এতিমখানায় ভর্তি করানো হয় শিশু জান্নাতকে। কারাগারে যাওয়ার পর শিশু জান্নাতের খরচ চালাতে না পেরে এতিমখানা থেকে পড়া বাদ দিতে হয়। ছোট্ট জান্নাতকে নিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন এক প্রতিবেশী। ওই বাসায় জান্নাত অন্য শিশুদের সঙ্গে থাকত। করোনাকালে একদিন মিনুর মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় আইনজীবী মুরাদের সঙ্গে। তিনি পরিচয় জানতে চাইলে শিশুটি বলে তার মা কারাগারে। কিন্তু কেন তিনি কারাগারে? এরপর বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামের কারা পরিদর্শক নথি ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেন কুলসুমীর পরিবর্তে জেল খাটছেন মিনু। কারাগারে রাখা বালাম বইসহ অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করে এমনটা পাওয়া যায়। এদিকে, চুক্তি অনুযায়ী মিনুর সন্তানদের ভরণপোষণ চালানো এক সময় বন্ধ করে দেন কুলসুমী। কারাগারে থাকা অবস্থায় ভাই রুবেলের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারেন মিনু। সিদ্ধান্ত নেন সব ফাঁস করে দেয়ার। আইনজীবী এ্যাডভোকেট মুরাদের মাধ্যমে সহকারী জেল সুপার শফিকুল ইসলামকে বিষয়টি জানান। পরে জেল সুপার হাজতের নারী ওয়ার্ড পরিদর্শনে গেলে মিনু তার কাছে সব খুলে বলেন। জেল সুপার বিষয়টি আদালতকে অবহিত করেন। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে গড়ায়। সেখান থেকে মিনুর মুক্তির আদেশ আসে। আদালতের নির্দেশে গত ১৬ জুন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান মিনু। নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ এমন ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। মিনু জেলে যাওয়ার পর তার দুই ছেলে একটি মাদ্রাসায় ছিল। সবার ছোট মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসকে লালন-পালন করতেন এক প্রতিবেশী। মেয়েটিকে একবার জেলখানায় মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন মিনুর আইনজীবী মুরাদ। গত এপ্রিলে সেই ছোট্ট মেয়েটির মৃত্যু হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর মেয়ের মৃত্যুর খবর জানতে পেরে প্রায় পাগল হয়ে যান মিনু। কারাগার থেকে মুক্ত জীবনে মুক্ত বাতাসে মাত্র ১২ দিন বেঁচে ছিলেন মিনু। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পর বেওয়ারিস লাশ হিসেবে তাকে দাফন করা হয়। গত ২৮ জুন রাতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ সংযোগ সড়ক থেকে দুর্ঘটনায় নিহত এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে তার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় অজ্ঞাত হিসেবে মরদেহ দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। বায়েজিদ থানার একটি টিম সীতাকুন্ড এলাকার লোকজনকে ছবি দেখিয়ে মিনুর পরিচয় শনাক্ত করে। তবে, মিনুর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনা রহস্যজনক মনে করেন তার আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ। তিনি জানান, মিনু যখন জেলে যান, তার মেয়ে জান্নাতুল তখন কোলের শিশু। মাঝে একবার মায়ের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জঙ্গল ছলিমপুরের একটি পাহাড়ে শিশুদের সঙ্গে খেলার সময় ওপর থেকে পড়ে গিয়ে সে মারা যায়। জানা গেছে, নিহত মিনু সীতাকুন্ড এলাকা থেকে সন্তানকে মাদ্রাসায় দিতে গিয়ে নিখোঁজ হন। ৫ দিন পর ছবি দেখে স্বজনরা জানতে পারেন মিনু সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তবে, তারা মিনুর লাশ দেখতে পারেননি। মৃত্যুর কারণও জানেন না। এমন বিষাদময় কাহিনী কি কোন চলচ্চিত্র নির্মাণের উপজীব্য হবে? কোন কাহিনীকার বা চিত্রনাট্যকার কি মিনুর করুণ পরিণতির কথা তুলে আনবেন সেলুলয়েডে? পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিনা দোষে যে দন্ড মিনু নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, সেই দায় থেকে সে আজ চিরতরে মুক্ত। কিন্তু ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আমরা দেখি সেখানে মিনুর এমন কষ্টের জীবন সর্বোপরি করুণ মৃত্যু আমাদের ভীষণ ভাবায়। দংশনে ক্ষত হয় বিবেক। কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মিনুর ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। উচিতও নয়। মিনু কি নিহত হয়েছেন, নাকি হত্যাকান্ডের শিকার- সেই রহস্য উন্মোচনের জন্য আসল কুলসুমীকে খুঁজে বের করে আইনের কাছে সোপর্দ করা জরুরী ছিল। সেটা নিশ্চিত হয়েছে। এবার শুরু আইনী লড়াই। এ নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। সঠিক বিচারটিই প্রত্যাশা করি। আইনের ফাঁক গলে যেন কুলসুমীদের মিথ্যে প্রলোভনে পড়ে মিনুদের আর সর্বনাশ না হয় সেটি রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আর কোন মিনুর এমন করুণ পরিণতি দেখতে চাই না। এমন ট্র্যাজিডি যেন আর কোন অনাহারী, অভাবী মানুষের জীবনে না ঘটে। লেখক : সাংবাদিক
×