ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কয়েক জেলায় বন্যায় তলিয়ে গেছে ফসলি জমি

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ২৯ জুলাই ২০২১

কয়েক জেলায় বন্যায় তলিয়ে গেছে ফসলি জমি

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ টানা বর্ষণ, জোয়ার, পাহাড়ী ঢল ও লঘুচাপের কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্যা ও জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। শ শ একর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। মাছের ঘেরে পানি প্রবেশ করায় কয়েকশ’ টন মাছ ভেসে গেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর নিচু এলাকায় সড়ক ও বাসাবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। খাতুনগঞ্জ, চাক্তাইসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার আড়ত ও গুদামে পানি ঢুকে ভোগ্যপণ্য নষ্ট হচ্ছে। সম্ভাব্য পাহাড় ধসের শঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। বান্দরবানের সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লামা এবং আলীকদমের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। ওই এলাকার বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। লঘুচাপের প্রভাবে বাগেরহাটের শ শ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। আমনের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুধবার জেলার বিভিন্ন নদীর পানি অন্তত তিনফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। মঙ্গলবার বিকেল থেকে শুরু হওয়ার বৃষ্টির কারণে মোংলা পৌর এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে পানি প্রবেশ করায় অনেকে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া বরগুনার আমতলী ও পটুয়াখালীতেও টানা বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের। ভারি বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ডুবেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর নিচু এলাকার সড়ক ও বাসাবাড়ি। বুধবার দিনভর চলে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ। এতে করে জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনে সড়কগুলোতে জনচলাচল কম থাকলেও রক্ষা পায়নি খাতুনগঞ্জ, চাক্তাইসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক আড়ত ও গুদামে পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে ভোগ্যপণ্য। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, এ অবস্থা আরও কয়েকদিন থাকতে পারে। একইসঙ্গে রয়েছে পাহাড় ধসের সতর্ক বার্তাও। সম্ভাব্য শঙ্কায় পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে লোকজন সরিয়ে নিচ্ছে প্রশাসন। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বুধবার বেলা ৩টা পর্যন্ত ৯৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছে লঘুচাপ। এর প্রভাবে মৌসুমি বায়ু আরও সক্রিয়। গভীর সমুদ্রে ছোটখাটো জলযানগুলো চলাচলের ওপর জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ফলে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলো উপকূলের কাছাকাছি থেকে চলাচল করছে। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাত থাকলেও মঙ্গলবার রাত থেকে এর মাত্রা বেড়েছে। সূর্যের আলোর দেখা মেলেনি বুধবার। প্রায় একটানা বর্ষণে ডুবেছে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, ছোটপুল, চান্দগাঁও, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, চকবাজার, মোহাম্মদপুর, শুলকবহর, কাতালগঞ্জ, প্রবর্তক মোড়সহ মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা। সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়েছে। অনেক বাসাবাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে পড়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। আবহাওয়া দফতরের সতর্কতা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে সরিয়ে নিতে তৎপর হয়েছে জেলা প্রশাসন। মঙ্গলবার রাত থেকেই শুরু হয় এ কার্যক্রম। মহানগরীর খুলশী ও বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িগুলো থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ৯২ পরিবারকে। সেখানে প্রায় তিনশ জন বসবাস করছিলেন। ফিরোজ শাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে এ পরিবারগুলোকে স্থানান্তর করা হয়। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন জানায়, বর্ষার আগে সরিয়ে নেয়া হলেও অনেকেই ফের ফিরে গিয়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলোতে। ভারি বর্ষণ শুরু হওয়ায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তাদের আবারও সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বসবাসকারীরা আবাসস্থল ছাড়তে আগ্রহী নয়। এ অবস্থায় পুলিশের সহায়তায় এ কার্যক্রম চলমান রাখা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সহজ হয়েছে। অস্থায়ীভাবে যে কটি আশ্রয় কেন্দ্র সৃষ্টি করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে আলহেরা মাদ্রাসা, রৌফাবাদ রশিদিয়া মাদ্রাসা, লালখান বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পিরোজশাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাহাড় থেকে সরিয়ে যাদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হচ্ছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামে কয়েকদিনের বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় স্থবিরতা নেমেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যে। শুধু তাই নয়, পানিতে ডুবে বিনষ্ট আড়ত ও গুদামগুলোতে মজুদ করা পণ্য। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের এ দুর্ভোগ অনেকটা নিত্যসঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামে ঈদের দিন থেকেই থেমে থেমে বর্ষণ ও কর্ণফুলীর জোয়ারে অধিকাংশ নিচু এলাকা পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কর্ণফুলী নদী এবং চাক্তাই খালের পাশে নগরীর চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ বাজারের অবস্থান। তাই সেখানে জোয়ার ও বৃষ্টির পানির কারণে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। বান্দরবান ॥ টানা বৃষ্টিতে বান্দরবানের সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার লামা ও আলীকদমে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার সঙ্গে এই দুই উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। অন্যদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। বুধবার সকাল থেকে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বান্দরবানে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, সোমবার রাত থেকে ভারি বৃষ্টির কারণে জেলার লামা-আলীকদম উপজেলার প্রধান সড়কের বিভিন্ন স্থান তলিয়ে গেছে, বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে পড়লেও হতাহতের কোন খবর পাওয়া যায়নি। বাগেরহাট ॥ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে উপক‚লীয় বাগেরহাটের নি¤œাঞ্চল জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন জেলার শত শত পরিবার। ঘরবাড়ি, রাস্তা, মাঠ, ক্ষেত-খামার পানিতে একাকার হয়ে গেছে। মাছ চাষের নামে প্রবাহমান খালে বাঁধ ও পাটা দেয়ায় এবং ¯øুইস গেট আটকে রাখার কারণে শতাধিক গ্রামে তীব্র জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক পরিবারের রান্না করার অবস্থাও নেই। মৎস্য ঘের তলিয়ে গেছে, আমনের বীজতলা ও বর্ষাকালীন সবজি ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুধবার রামপাল, মোংলা, কচুয়া, ফকিরহাট, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বুধবার জেলার শরণখোলার বলেশ্বর, মোরেলগঞ্জের পানগুছি, মোংলার পশুর, বাগেরহাটের ভৈরব, দড়াটানা, চিতলমারীর চিত্রা, মোল্লাহাটের মধুমতিসহ সব নদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট বেড়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু হয়ে বুধবার দুপুর পর্যন্ত এখানে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বাগেরহাট জেলায় গড়ে ৯৩ দশমিক ৬৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে কৃষিবিভাগ। এর মধ্যে সব থেকে বেশি ২৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে শরণখোলা উপজেলায়। আমতলী, বরগুনা ॥ অতিবর্ষণে আমতলী উপজেলায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। তলিয়ে গেছে ৬ হাজার ৪৫টি পুকুর ও মাছের ঘের। মাটি আগলা হয়ে উপড়ে পড়েছে অন্তত সহা¯্রাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা। পানির নিচে আউশের ধান ক্ষেত ও আমনের বীজতলা। দ্রæত পানি নিষ্কাশন না হলে অন্তত কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হবে। জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টার ২শ’ ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত বেকর্ড করা হয়েছে বলে কলাপাড়া আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে। বিরামহীন ভারি বৃষ্টিপাতে আমতলী উপজেলায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। জলকপাট দিয়ে তেমন পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। তলিয়ে গেছে উপজেলায় ছয় হাজার ৪৫টি পুকুর ও মাছের ঘের। এতে এক কোটি টাকার ক্ষতি হবে বলে উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে। জলাবদ্ধতায় উপজেলার এক হাজার ৯শ’ ২৯ হেক্টর আমনের বীজতলা এবং ১০ হাজার ৫শ’ হেক্টর আউশ ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পটুয়াখালী ॥ উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় লঘুচাপের কারণে মঙ্গলবার দুপুর থেকে পটুয়াখালীতে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। বাতাসের চাপ আগের বেড়েই চলছে। সাগর ও নদীর পানি ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই পায়রা বন্দরকে স্থানীয় তিন নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। পটুয়াখালী আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫১.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ বৃষ্টিপাত ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত বলে আবহাওয়া অফিস নিশ্চিত করেছে। মোংলা ॥ উত্তর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে মঙ্গলবার বিকেল থেকে শুরু হওয়া টানা বৃষ্টিতে মোংলা পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় ও রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে একাকার হয়ে গেছে। পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের পশু হাসপাতাল এলাকা ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বটতলা-শেহলাবুনিয়া এলাকার রাস্তাঘাট হাঁটু পানিতে তলিয়ে রয়েছে। বাড়িঘরের মধ্যে পানি উঠায় লোকজন খাটের ওপর বসবাস করছে। ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটে হাঁটু পানি জমায় কেউ যেমন বের হতে পারছে না, তেমনি ঘরেও থাকতে পারছে না। ঘর ছেড়ে কেউ কেউ রাস্তার ওপর অবস্থান নিয়েছেন। টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে জলাবদ্ধতায় এক রকম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে পৌর শহরের মিয়া পাড়া, মুন্সীপাড়া, জয়বাংলা, কুমারখালী, মাকড়ঢোন, কেওড়াতলা, ইসলামপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায়। বৃষ্টিতে পানি নিষ্কাশনের খাল ও ড্রেন তলিয়ে রয়েছে।
×