ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পণ্যবোঝাই কন্টেনার ১৯ বেসরকারী আইসিডিতে সরিয়ে নেয়া শুরু

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ২৭ জুলাই ২০২১

পণ্যবোঝাই কন্টেনার ১৯ বেসরকারী আইসিডিতে সরিয়ে নেয়া শুরু

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত চলমান লকডাউনে কল কারখানা বন্ধ থাকায় পণ্যজটের মুখে চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ড। কারণ যে পরিমাণ কন্টেনার জাহাজ থেকে নামছে সে তুলনায় ডেলিভারি নামমাত্র। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে সকল ধরনের কন্টেনার অফডকে (বেসরকারী কন্টেনার ডিপো) নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা জারি হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম সচল রাখতে সহায়ক হলেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে আমদানিকারকদের মধ্যে। অফডক থেকে পণ্য খালাস নিতে ব্যয়বৃদ্ধি এই অসন্তোষের অন্যতম কারণ। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডের কন্টেনার ধারণ ক্ষমতা ৪৯ হাজার টিইইউএস। সোমবার সকালে কন্টেনার ছিল ৪২ হাজারের কিছু বেশি। জাহাজ থেকে নামানো আমদানি পণ্যের কন্টেনার ডেলিভারি স্বাভাবিক না থাকায় ইয়ার্ডে পণ্যের স্তূপ ক্রমেই বড় হচ্ছে। ডেলিভারিতে যে ধীরগতি, তাতে প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজার কন্টেনার জমা হতে থাকবে। এতে করে কয়েকদিনের মধ্যেই ধারণক্ষমতার পুরোটাই ব্যবহৃত হয়ে যাবে। তখন কন্টেনার হ্যান্ডলিয়ের কাজে নিয়োজিত বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি চলাচল কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় বন্দর সচল রাখাটাও হবে চ্যালেঞ্জিং। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় এখন থেকে কোন কন্টেনারই আর ইয়ার্ডে রাখা যাবে না। আমদানির পণ্য সরাসরি চলে যাবে বেসরকারী কন্টেনার ডিপোগুলোতে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোঃ ওমর ফারুক সোমবার জনকণ্ঠকে বলেন, লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকলেও জাহাজ আগমন থেমে নেই। জাহাজ এলে পণ্যও নামাতে হবে। ডেলিভারি যদি এতটাই ধীরগতি হয়, তবে এত কন্টেনার রাখার ক্ষেত্রে স্থান সঙ্কট দেখা দেবে। সম্ভাব্য সঙ্কটের কথা আমরা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অবহিত করে। এরপর এনবিআর থেকে এ সিদ্ধান্ত এসেছে। আমদানিকারকদের অসন্তোষ থাকলেও করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সকল কন্টেনার অফডকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেহেতু সরকারী নির্দেশনা সেহেতু আমাদের তা মানতে হবে। তিনি জানান, সোমবার সকালে জেটিগুলোতে ছিল ৯টি কন্টেনার জাহাজ। পণ্য খালাসের জন্য বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষমাণ ছিল আরও ২০টি কন্টেনার জাহাজ। এদিকে আমদানি পণ্যের সকল কন্টেনার অফডকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আমদানিকারকরা। এর প্রধান কারণ ব্যয় বেড়ে যাওয়া। তারা বলছেন, বেসরকারী আইসিডিগুলো যদি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে ডিপোতে এসে ডেলিভারি দেয় তাহলে তারা অতিরিক্ত চার্জ আদায় করবে, যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া কল কারখানা বন্ধ রাখায়ও আপত্তি শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের। তারা বলছেন, কারখানা যদি বন্ধ থাকে তাহলে আমদানির কাঁচামালগুলো আমরা কোথায় নিয়ে রাখব? কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রয়েছেন ছুটিতে। সব মিলিয়ে এক ধরনের দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়তে যাচ্ছে পুরো প্রক্রিয়া, এ অভিমত শিল্প মালিকদের। বেসরকারী আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডা সূত্রে জানা যায়, মোট ১৯টি কন্টেনার ডিপোর ধারণক্ষমতা ৭৮ হাজার ৭শ’ টিইইউএস। সোমবার সকালে কন্টেনার ছিল ৫৩ হাজার ৮৯৯ টিইইউএস। এর মধ্যে রফতানির কন্টেনার রয়েছে ১১ হাজার ৮৩৮, যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৬ হাজার বেশি। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জাহাজ থেকে নামানো কন্টেনার আইসিডিতে নিয়ে আসার কাজ শুরু হয়েছে। বিকডা সচিব মোঃ রুহুল আমিন সিকদার জনকণ্ঠকে জানান, কাস্টমস থেকে প্রথম দফায় ৬ হাজার ৯২২টি কন্টেনার ডিপোতে আনার এ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে। ১৬টি জাহাজ থেকে কন্টেনারগুলো নামিয়ে ডিপোতে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যেখান থেকে আমদানিকারকরা তাদের পণ্য ডেলিভারি নেবেন। ব্যয়বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাহাজ থেকে কন্টেনার নামিয়ে ডিপোতে নিয়ে আসা পর্যন্ত কিছু খরচ রয়েছে। সেই বিষয়টি তো দেখতে হবে। প্রতি কন্টেনারে স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বেশি খরচ লাগতে পারে। করোনার এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সকলেই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সুতরাং বাড়তি এ ব্যয় স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা উচিত বলে অভিমত রাখেন তিনি। কন্টেনারের চাপে যদি ইয়ার্ডে স্বাভাবিক কার্যক্রমের অনুপযোগী হয়ে পড়ে তাহলে এ ব্যয় আরও বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বন্দর সচল রাখা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতির আলোকে সবকিছু বিবেচনা করার অনুরোধ বেসরকারী আইসিডি মালিকদের। বন্দর থেকে সকল পণ্যই অফডকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে বন্দর ব্যবহারকারীদের। অনেকেই বলছেন, এছাড়া বিকল্প কোন পথ খোলা ছিল না। কিন্তু আবার অনেকের অভিমত, বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের ঝামেলা এড়াতে চেয়েছে। কেননা, ইয়ার্ডে অনেক খালি কন্টেনার রয়েছে, যেগুলো সরিয়ে দেয়া যেত নতুন নির্মিত অব্যবহৃত ইয়ার্ডগুলোতে। তাহলেই পর্যাপ্ত জায়গা থেকে যেত স্বাভাবিক অপারেশনাল কার্যক্রম চালাবার জন্য। কিন্তু সঙ্কট সমাধানের জন্য সবকিছুই চাপানো হয়েছে আমদানি রফতানিকারকদের ওপর। পোশাক উৎপাদনকারী ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার এ সঙ্কটে বন্দর কাস্টমসের সিদ্ধান্ত আপাতত আমরা মেনে নিয়েছি। কারণ বন্দর তথা দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করা এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। তবে এতে আমাদের ব্যয় বাড়বে। বেসরকারী আইসিডিগুলো যদি একইসঙ্গে রফতানির পাশাপাশি আমদানির পণ্য হ্যান্ডলিং করতে যায় তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। বন্দর সচল রাখতে যে নির্দেশনা তা স্থায়ী কোন সমাধান নয় বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত এভাবে চলতে পারে। এরপর যে পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা সামাল দেয়া অফডকগুলোর পক্ষেও সম্ভব হবে না। তাই সকলের সমন্বয়ে একটা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। চট্টগ্রাম কাস্টমস ক্লিয়ারিং এজেন্টস এ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি একেএম আকতার হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলেই ইয়ার্ড থেকে কন্টেনার খালাসের ব্যবস্থাটা চালু রাখতে পারত। খালি কন্টেনার না সরিয়ে আমদানির সকল কন্টেনার অফডকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশনা বাস্তবসম্মত হয়নি। সব আইসিডি কাছাকাছি অবস্থানে নয়। একটি আইসিডি থেকে আরেকটি আইসিডির দূরত্ব রয়েছে। করোনাকালীন লকডাউনে পর্যাপ্ত পরিবহন না থাকায় যাতায়াতে সমস্যা আছে। সকল ক্লিয়ারিং এজেন্টের নিজস্ব গাড়ি নেই। তাছাড়া কাস্টমস কর্মকর্তাদের উপস্থিতির ব্যাপারও রয়েছে। বেসরকারী আইসিডিগুলোর যেখানে রফতানির পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে হিমশিম অবস্থা সেখানে আমদানির পণ্য খালাস দেবে কিভাবে। অফডকগুলোতে ৩৭ ধরনের পণ্য শুল্কায়ন ও সেখান থেকে ডেলিভারি হয়। এ কাজগুলো করতেই তাদের ত্রাহি অবস্থা। সেখানে আমদানির পণ্যের চাপ যুক্ত হলে অবস্থা হবে আরও কঠিন। আমদানিকারকদের ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা হবে। সঙ্কটের যৌক্তিক সমাধানে চট্টগ্রাম চেম্বারসহ বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক হওয়া প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন ট্রেড বডির এই নেতা।
×