ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অতি দলিত অচ্ছুত শ্রেণী, এখনও পিছিয়ে পড়া

প্রকাশিত: ২৩:২২, ২৭ জুলাই ২০২১

অতি দলিত অচ্ছুত শ্রেণী, এখনও পিছিয়ে পড়া

শ আ ম হায়দার ॥ ইঁদুর খেকো বলতে একমাত্র মুশহরদেরকেই বুঝায়। তাদের কথা মনে হলে চোখের সামনে ভাসে লোকালয় থেকে পৃথক স্থানে ঝোপঝাড় ও জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে বাঁশ চাটি দিয়ে নির্মিত কতকগুলো কুঁড়েঘর, কাঁচা লেট্রিন, পূতি দুর্গন্ধময়, অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বসবাসকারী এক শ্রেণীর অরণ্যচারী মানুষদের। দুনিয়া ও দেশ বদলেছে। তবে তাদের অবস্থা এখনও আগের মতোই। নিজেদের কৃষি জমি নেই। এক ধরনের যাযাবর জীবন। বাস করে সরকারের খাস জমিতে। শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর, সম্পূর্ণ ভূমিহীন, অতি দরিদ্র আদিম এই নরগোষ্ঠী সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষের কাছে এখনও রয়েছে অচ্ছুত ও অতি দলিত হয়ে। এ যেন তাদের নিয়তি। দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় মুশহরদের সংখ্যা বেশি। তার মধ্যে পার্বতীপুরের মনম্মথপুর ইউনিয়নের চাকলা হাট সংলগ্ন স্থানে অনেক মুশহরের বাস। তবে মাত্র ৫ কাঠা খাস জমিতে ৬৮টি পরিবারের ঘরবাড়িগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি চাপাচাপিভাবে লাগানো। সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত অস্বাস্থ্যকর ও স্যাঁতস্যাঁতে এসব কুঁড়েঘরে সূর্যের আলো পর্যন্ত পৌঁছে না। এখানকার বয়স্ক বাসিন্দা মন্টু ঋষি (৬২) বলেন, কেউ কেউ ভূঁইয়া ও মাঝি পদবি ব্যবহার করলেও আমরা ঋষি নামে পরিচিত। এখন বর্ষাকালে খাদ্য হিসেবে মাছ, শামুক ও কুঁচিয়ার ওপর তারা নির্ভরশীল। তাদের প্রিয় খাদ্য ইঁদুর। ধানকাটা মৌসুমে ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরে এবং ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করে জীবন বাঁচায়। ঐতিহ্যগতভাবে তারা বনচারী ও শিকারি। আগে দারাশ আর গুঁই সাপ শিকার করে চামড়া ছিলে অনেক দামে বিক্রি করত। আদিবাসীদের মতোই বনজঙ্গলে বেজি, খরগোশ, বনবিড়াল, কাঠবিড়াল, খাটাশ শিকার করত। এখন এসব মিলে না। সনাতনী পোশাকের পরিবর্তে পুরুষরা বাঙালীদের মতোই শার্ট, লুঙ্গি এবং মহিলারা শাড়ি ও মেয়েরা পরিধান করে সেলোয়ার কামিজ। এখন সাঁওতাল আদিবাসীদের সংস্পর্শে এসে মুশহর মেয়েরা সেজেগুজে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচ গানে অংশ নিতে শুরু করেছে। তবে এখনও এরা শিক্ষা বিমুখ। তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের মুখে শুনেছেন ১৮শ’ শতকে ইংরেজরা এ অঞ্চলে রেললাইন বসানোর শ্রমিক হিসেবে তাদের ভারতের বিহার রাজ্যের মুঙ্গের ও ছাপরা জেলা থেকে নিয়ে আসে। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর কারেন্টের হাট, কিষান বাজার, সাহেবগঞ্জ, মঙ্গলপুর, খানসামা উপজেলার সুবর্ণখোলী, বীরগঞ্জের ভাবকি, ঠাকুরগাঁও পুরাতন বিমানঘাঁটি, কালিতলা, কলেজপাড়া, রংপুর জেলার বদরগঞ্জ, চানকুড়ির ডাঙ্গা, সান্তাহার ও নাটোরের মুশহরদের অবস্থা একই রকমের। তবে নওগাঁ জেলার পতœীতলার সুলতানপুরে মুশহরদের অবস্থা আরও খারাপ। নিজেদের জমি না থাকায় মৃতদেহ সৎকারেও অনেক বিড়ম্বনা। বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক আবুল হাসনাত তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন পতœীতলার সুলতানপুরের হতভাগ্য ভূমিহীন এসব মুশহরদের কথা। গ্রামের অদূরে খাস জমিতে লাশ পুঁতে রাখাও নিরাপদ নয়। ভূমিগ্রাসী ও খাস জমির দখলদাররা চাষাবাদ করতে গিয়ে লাশগুলো বেরিয়ে পড়লে তা কুকুর শিয়ালের খোরাক হয়। বন্যায় নিরুপায় হয়ে লাশের গলায় কলসি বেঁধে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। অর্থাভাবে লাশ পোড়াতে পারে না। তাই নামমাত্র মুখাগ্নি করে জায়গার অভাবে লাশ রাস্তার ধারে ধারে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। পিছিয়ে পড়া এই নরগোষ্ঠীর অবস্থা সারাদেশে একই রকম। বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে মুশহরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিচু জাত মনে করে হিন্দুদের শ্মশানেও লাশ দাহ করতে পারে না। সরকারী খাস সম্পত্তি নদী ও বিল ঝিলই তাদের একমাত্র ভরসা। সেখানে তারা লাশ মাটি চাপা দেয় অথবা দাহ করে। এক সময় দিগন্তজুড়ে ফাঁকা জায়গা ও ঝোপঝাড়ে জঙ্গলাকীর্ণ ছিল উত্তর জনপদ। যেখানে বিনা বাধায় ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছে মুশহররা। আর বনজঙ্গল থেকে জীবজন্তু শিকার করে দিন কেটেছে তাদের মনের আনন্দে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এখন সে অবস্থা নেই। মানুষ তার চাহিদা মেটাতে জঙ্গল কেটে আবাদি জমিতে পরিণত করেছে। এসব খাস জমিতে যুগযুগ ধরে বসবাস করেও তারা জমির মালিক তথা ভূমি বন্দোবস্ত নিতে পারেনি। ভূমি অফিসে যাওয়ার মতো যোগ্যতাও তাদের নেই। এ সুযোগ নিয়ে পাশর্^বর্তী বাঙালী মুসলমানরা মুশহরদের ঘরবাড়ির ফাঁকা জায়গাটুকুও জোরপূর্বক দখল করায় তারা একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তাদের অবস্থা এরকম, অনেক স্থানে মুশহর নারীরা উচ্চবর্ণের লালসার শিকার হলেও যোগ্যতার অভাবে প্রতিবাদ বা প্রতিকার করতে পারেনি। নিজেদের চেষ্টা ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় আদিবাসীরা অনেক দূর এগিয়েছে। সেক্ষেত্রে মুশহররা পড়ে আছে উন্নয়নের তলানীতে। তার কারণ সামাজিক আচার-আচরণ, প্রথাগত অভ্যাস, অশিক্ষা আরও অনেক কিছু। দুর্গম বনজঙ্গলের আশপাশে থাকতে তারা অভ্যস্ত, শহরমুখী হতে চায় না। যার ফলে আধুনিক সমাজের সুবিধা থেকে স্বাভাবিকভাবে তারা বঞ্চিত। বেপরোয়া মদ্যপান, ইঁদুর, সাপ, কেঁচো ইত্যাদি ভক্ষণ করায় হিন্দু মুসলমান এমনকি আদিবাসীরাও তাদের সঙ্গে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। সবচেয়ে খারাপ অভ্যাস শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি চরম অনীহা। সরকারীভাবে শিক্ষার এত সুবিধা থাকার পরও তা তারা গ্রহণ করতে পারেনি। এতদিন সরকারী তালিকায় তাদের গোত্রের কোন অস্তিত্ব ছিল না। অতি সম্প্রতি জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতৃবৃন্দ আদিবাসী তালিকায় মুশহরদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এই সংগঠনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মুশহর সম্প্রদায় গাঙ্গেয় পূর্ব সমতলভূমি এবং নেপালের তিরাই অঞ্চলের গ্রামীণ পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী। তবে তাদের মূল ভূখণ্ড উত্তর প্রদেশ, বিহার রাজ্যের ছাপরা, মুঙ্গের ও ঝাড়খন্ড প্রদেশে। এছাড়াও ভারতের বিহারের ভাগলপুর জেলার দুমকা ও পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এদের আদিনিবাস। ভারতবর্ষে সাঁওতাল বিদ্রোহ হুল ইংরেজরা কঠোরভাবে দমন করার পর ১৮৫৫ সালে ওইসব অঞ্চল থেকে রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর সীমান্ত পথ দিয়ে বিপুল সংখ্যক আদিবাসীদের সঙ্গে মুশহররাও এদেশে চলে আসে। যে কারণে উত্তরাঞ্চলে বা সমতলে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এত বেশি। সাঁওতাল বিদ্রোহ সান্তাল হুলের সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জমিদার মহাজন- সুদখোর ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ হয়। কামার, কুমার, মুশহর, ডোম, চামার ও গরিব হিন্দু মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। এ যুদ্ধ ৮ মাস স্থায়ী ছিল। সাঁওতাল বীর সিধু মুরমু ইংরেজদের হাতে ধরা পড়লে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অপর তিন বিপ্লবী কানু, চাঁদ ও ভৈরব পুলিশের গুলিতে নিহত হলে ১৮৫৬ সালের নবেম্বরে যুদ্ধ ও বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে। এর পরে ইংরেজ সৈন্য বাহিনীর নির্যাতন ও পুলিশের গণগ্রেফতারের ভয়ে আদিবাসী ও মুশহর সম্প্রদায়ের লোকজন এদেশে অভিবাসন নিতে বাধ্য হয়। প্রখ্যাত নৃতত্ত¡বিদ ননীমাধব চৌধুরী তার ভারতবর্ষের অধিবাসীর পরিচয় গ্রন্থে লিখেছেন, ঝাড়খন্ড অঞ্চলের মুন্ডা ও ওরাও ট্রাইব সম্প্রদায় কতকগুলো উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। এরাই স্থানভেদে কোথাও ধাঙ্গর, কোথাও মুশহর নামে পরিচিত। তারা আর্য এবং ভারতের আদিম বনবাসী বলে দাবি করে। তবে উচ্চবর্ণ হিন্দু ক্ষত্রিয়রা তা স্বীকার করে না। বলে ওরা অচ্ছুত, দলিত। বিহারে তারা রাজওয়াড় ও মাঝি বলে পরিচিত মালভূমি অঞ্চলে। তারা আরও তিনটি উপগোষ্ঠীতে বিভাজিত। তা হলো ভগত, সাকাতিয়া এবং তুরখাইয়া। ভাষাতাত্তি¡ক শ্রী সুনীতিকুমার চট্রোপাধ্যায় বলেছেন, মুশহরদের ভাষা অষ্ট্রো এশীয় ভাষার নানা শাখার মধ্যে রাঢ়ী উপভাষার অন্তর্গত। এ ভাষার বর্ণমালা ছিল, এখন তা বেঁচে নেই। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ও তাদের সঙ্গে কথাবলে জানা গেছে, তারা ভোজপুরী মাঘী ও মৈথেলী ভাষার গ্রামীণ প্রচলিত কথ্য ভাষায় কথাবার্তা বলে। আবার অনেকে নাগরী ভাষায়ও কথা বলে। হিন্দি ভাষা বুঝতে পারে। সেই সঙ্গে যে অঞ্চলে বসবাস করে সেখানকার আঞ্চলিক বাংলায়ও কথা বলে। আদিবাসী গবেষক ও পণ্ডিতদের মতে, মুশহররা হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্ত্যজ শ্রেণীর। পারিবারিক উপাধি মান্ধি। যদিও তারা হিন্দু ধর্মের কিছু রীতিনীতি অনুসরণ করে থাকে, যেমন হোলি-দেওয়ালি অপরপক্ষে আদিবাসী প্রথায় কিছু উৎসব যেমন দিনাভাদুড়ী, বুনিয়াবাবা আবার নিজস্ব রীতিতে কোল পূজা করে থাকে। নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আদিবাসীদের সঙ্গেও হয় তবে বাঙালী বা মুসলমানদের সঙ্গে নয়। বিবাহ কিংবা ধর্মীয় উৎসবে নিজস্ব তৈরি মদ পানীয় হিসেবে ব্যবহার করে।
×