ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গৃহকর্মীর আড়ালে সক্রিয় সংঘবদ্ধ চক্র

প্রকাশিত: ২৩:১২, ২৭ জুলাই ২০২১

গৃহকর্মীর আড়ালে সক্রিয় সংঘবদ্ধ চক্র

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম গৃহকর্মী। গৃহকর্মী সেজে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র। এরা বিভিন্ন অনলাইনে টার্গেট করা রাজধানীর বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী দিতে মরিয়া। বেশ কয়েকটি ধাপে কাজ করে প্রতারকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রাজধানীতে এরকম শতাধিক ভয়ঙ্কর গৃহকর্মী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এরা বাসাবাড়িতে মালামাল লুট করতে কাউকে খুন করতে দ্বিধা করে না। ২০১৯ সালে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের নিজ বাসায় খুন হন ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী পারভীন। পুলিশ জানায়, এই খুনের ঘটনায় জড়িত ছিল নতুন নিয়োগ দেয়া দুই গৃহকর্মী স্বপ্না ও রেশমা। পরে তাদের গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে নিম্ন আদালতে তাদের ফাঁসি রায় হয়েছে। রবিবার এরকমই একটি চক্রের গৃহকর্মী নূপুর আক্তারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। এরপরই বেরিয়ে আসে এরকমই চাঞ্চল্যকর নানা কাহিনী। রাজধানীর রামপুরার এক বাসিন্দা অনলাইনে যোগাযোগ করে ১০ হাজার টাকার বেতনে নূপুরকে নিয়োগ দেয়ার চারদিনের মাথায় তার বাড়ি থেকে স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্র পালিয়ে যায় ওই গৃহকর্মী। এর আগে ১৬ বছরে আগে ২০০৫ সালের ২৩ আগস্ট ধানমণ্ডিতে ৬/এ সড়কের নিজ বাসায় কাজী সুহিন নাহারের নামে এক শিক্ষিকা নিজ বাসায় খুন হন। বড়তার ভাই চিকিৎসক কাজী শহীদুল আলম গৃহপরিচারক কিশোর শরিফকে আসামি করে মামলা করেন। প্রায় ১৬ বছর পর এই হত্যা মামলার আসামি কাজের ছেলে শরিফকে খুঁজে না পেয়ে গত ৩১ মার্চ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। সিআইডির বিশেষ সুপার মোঃ কামরুজ্জামান জানান, তারা আসামি শনাক্ত করেছেন। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। আসামিকে পাওয়া গেলে আবার মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হবে। গত ২১ জুলাই রাজধানীর মালিবাগে একটি ফাঁকা বাসায় সত্তরোর্ধ বৃদ্ধাকে বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতন করা ভয়ঙ্কর গৃহকর্মী রেখা ও তার স্বামী এরশাদ টাকা-পয়সা, গহনা লুট করে পালিয়ে যায়। পরে তাদের গ্রেফতার করে ৮দিনের রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের গৃহকর্মীর আড়ালে ভয়ঙ্কর কাহিনী বেরিয়ে আসে। পুলিশ জানায়, বেশ কয়েকটি অনলাইন ও এ্যাপসের মাধ্যমে গৃহকর্মী দিচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। সূত্রগুলো জানায়, বুয়া সেজে চুরি করতে টার্গেট করা বাসায় কাজ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে কয়েকটি চক্রটি। বাসায় লোকসংখ্যা কম, শিক্ষিত ও সরল, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ কম, মূলত এমন গৃহকর্ত্রীদের টার্গেট করে চক্রটি। চক্রের মূল অস্ত্র হচ্ছে নারী সদস্যদের গৃহকর্মী সাজিয়ে বিভিন্ন বাসায় কাজের ব্যবস্থা করা। এরপর বেশি কাজ দেখিয়ে বাসার লোকজনের আস্থা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যায় গৃহকর্মীটি। এক পর্যায়ে সুযোগ বুঝে বাসার লোকজনকে চেতনানাশক খাইয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়া হয়। সম্প্রতি এই নতুন যন্ত্রণায় ভুগছেন রাজধানীবাসী। ব্যস্ততম ঢাকা শহরে জীবনে ‘বুয়া’ নিয়ে আরেক আতঙ্কে পড়েছেন নগরবাসী। ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মোঃ মাহবুব আলম জানান, রামপুরার এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত গৃহকর্মী নূপুর দুটি চুরির ঘটনায় জড়িত ছিল। এর হোতাকে গ্রেফতার চেষ্টা চলছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলে পুরো চক্র সম্পর্কে জানা যাবে। তিনি জানান, এ ধরনের চুরি-ডাকাতির ঘটনায় আমরা আসামিদের গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধারে বেগ পেতে হয়। কারণ ডিএমপির তথ্যভাণ্ডারে বা ভাড়াটিয়া তথ্যভাণ্ডারে এ ধরনের গৃহকর্মীদের তথ্য সংযুক্ত থাকে না। তবে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গৃহকর্মী নূপুরকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হই। ফেসবুক গ্রæপের মাধ্যমে কাজের বুয়ার সন্ধান ও নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মী বা দারোয়ান নিয়োগ দিলে কাছের থানা পুলিশকে জানান, ভাড়াটিয়া তথ্যভাণ্ডারে তাদের ছবি, পরিচয়সহ বিস্তারিত তথ্য সংযুক্ত করুন। ১৯ জুলাই ১০ হাজার টাকা বেতনে নূপুর নামে ওই গৃহকর্মী রামপুরার একটি বাসায় কাজে যোগ দেন। ২৩ জুলাই ওই বাসা থেকে সাড়ে তিন ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকাসহ পালিয়ে যায় নূপুর। গত ২১ জানুয়ারি রাজধানীর মালিবাগে একটি ফাঁকা বাসায় সত্তরোর্ধ বৃদ্ধাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা গৃহকর্মী রেখা ও তার স্বামী এরশাদ। পরে পুলিশ তাদের গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর কাহিনী। নগদ টাকার জন্য এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে রেখা। টাকা-পয়সা, গহনা লুটে নেয়াই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। ৮দিনের রিমান্ড আবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, আসামি রেখা মামলার বাদী মেহেবুবার বাসায় দীর্ঘদিন যাবত কাজের মেয়ে হিসেবে কাজ করে আসছিল। আসামি রেখা ও তার স্বামী পরিকল্পনা করে বাসা ফাঁকা থাকার সুবাদে গত ১৮ জানুয়ারি সকালে বাদীর মা বিলকিস বেগমকে হত্যার উদ্দেশে মারধর করে গুরুতর জখম করে। এ সময় ২৪ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ দুই লাখ টাকা এবং একটি টেলিভিশন চুরি করে নিয়ে যায়। এ মামলার ঘটনা অত্যন্ত রোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর। মামলার ভিকটিম বিলকিস বেগম (৭৫) গুরুতর মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। গত ২৩ জুন রাজধানীর কলাবাগানের একটি বাসা থেকে গহনা ও নগদ টাকা চুরির অপরাধে রওশনারা ওরফে রসুনা ওরফে রুবি নামে এক গৃহকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ চন্দ্র জানান, গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে চুরি হওয়া ডায়মন্ড লকেটসহ স্বর্ণের একটি চেন, তিনটি স্বর্ণের আংটি, কানের দুল, ডায়মন্ড বসানো ওমেগার একটি ঘড়ি, সোনার দুটি বালা ও নগদ ৯৯ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। গত বছর ১৬ মার্চ পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্গেট করা বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে মহিলা সদস্যদের নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করেন দুর্ধর্ষ চোর চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে স্বর্ণের ১ জোড়া হাতের চুড়ি, একটি লকেটসহ স্বর্ণের চেন ও নগদ ৩০ হাজার টাকা, ৬টি চেতনানাশক ট্যাবলেট ও ব্যবহৃত মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃত বিউটি বেগম ওরফে ময়না ওরফে জান্নাতের মা, খোরশেদ আলম ওরফে মোরশেদ, আশাদুল ইসলাম, রিপনা বেগম ও ফারুক আহম্মেদ। গত ৯ মার্চ কাজের বুয়া হিসেবে ময়না নামে একজনকে নিয়োগ দেন। কিন্তু পরের দিনই দুপুর দেড়টার দিকে দুপুরের খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে সবাইকে অজ্ঞান করে ওই কাজের বুয়া। এরপর নগদ ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা ও ২৫ ভরি স্বর্ণ নিয়ে পালিয়ে যায়। আটক খোরশেদ আলম সুকৌশলে তার স্ত্রী ময়নাকে ভিকটিম ফয়জুন্নেছার বাসার কাজের বুয়া হিসেবে পাঠান। আর আটক আশাদুল ও তার স্ত্রী রিপনা বেগম চুরির উদ্দেশে ময়নাকে চেতনানাশক ওষুধ সরবরাহ করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের বুয়া ময়না দুপুরের খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাওয়ালে ভিকটিম ও তার পরিবারের সদস্যরা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর আলমারিতে রাখা ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা ও ২৫ ভরি বিভিন্ন স্বর্ণালঙ্কার টাকা নিয়ে যায় সে। পুলিশ ২০১৩ সালে একটি মামলায় হাজিরায় দিতে গিয়ে খোরশেদ-ময়না ও আশাদুল-রিপনা দম্পতির মধ্যে পরিচয়। তখন থেকে তারা সংঘবদ্ধভাবে ঢাকা ও রাজশাহীতে এই কৌশলে স্ত্রীদের বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে নিয়োগ দিয়ে চুরির করে আসছিল। ময়না বুয়া সেজে চুরি করে ধরা পড়ার সময়ের মধ্যে রিপনা-আশাদুল দম্পতি আরেক জায়গা আরেকটি চুরির ঘটনা ঘটায়। যেটাতে একজন এখনও আইসিইউতে ভর্তি রয়েছে। গত ৩ ফেব্রæয়ারি রাজধানীর গুলশানে বাসা-বাড়ি-মেস থেকে অভিনব কায়দায় স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান মালামাল লুট করছে দশ প্রতারক চক্র। শেফালী বেগম (২৪) নামে এ চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে গুলশান থানায় শেফালী জানায়, রাজধানীতে এ ধরনের অন্তত দশটি চক্র রয়েছে। প্রতিটি দল আলাদা আলাদা এলাকায় প্রতারণা করে থাকে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন বাসা ও ব্যাচেলর মেসে বুয়ার কাজ করে থাকে। প্রতিটি দলে ৪/৫ জন করে সদস্য থাকে। এর মধ্যে একজন থাকে দলনেতা যে প্রত্যককে বাসা নির্দিষ্ট করে দেন। প্রতারণা করে পাওয়া জিনিসপত্র বিক্রি করে প্রাপ্ত তথ্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ দলনেতাকে দিতে হয়। ফ্যামিলি বাসার ক্ষেত্রে তারা একটি নির্দিষ্ট দিনে ওই পরিবারের সদস্যদের প্রথমে রাতের খাবারের সঙ্গে উচ্চ মাত্রার ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সবাইকে গভীর ঘুমে অচেতন করে ফেলে। এরপর খুব ভোরে দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে বাসার ময়লা ফেলার কথা বলে ওই ময়লার বালতিতে করে স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। বুয়া/কাজের লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশের পরামর্শ ॥ বুয়া নিয়োগের আগে তার কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, রঙিন ছবি (সদ্য তোলা), শনাক্তকারী ব্যক্তি ও তার জাতীয় পরিচয়পত্র নিন। তথ্য যাচাই করার জন্য নিকটস্থ থানায় কাজের বুয়ার তথ্য প্রদান করুন। তিনি যদি অতীতে কোন অপরাধ করেন, তাহলে পুলিশ তাকে সহজে শনাক্ত করতে পারবে। অতীতে তিনি কোথায় কাজ করেছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নিন এবং কাজ ছাড়ার কারণ জানার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে পূর্বের কাজের ঠিকানায় যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করুন। কাজের বুয়া/ কাজের লোকের পরিবারের তথ্য নিন। স্থায়ী ঠিকানা, তার পরিবারে কে কে আছেন তা জানার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে তার স্থায়ী ঠিকানায় যোগাযোগ করুন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ওই ঠিকানায় বসবাস করে কিনা খোঁজ নিন। বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ নগরীর সব মানুষের তথ্য সংরক্ষণের কাজ করছে। ডিএমপি কর্তৃক নির্ধারিত তথ্য ফরমে আপনার কাজের বুয়া/ কাজের লোকের তথ্য পূরণ করে থানায় জমা দিন।
×