ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘ঘটনা সত্য’ নাটক নিয়ে সমালোচনার ঝড়

নির্মাতাসহ অভিনয় শিল্পীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দাবি

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২৭ জুলাই ২০২১

নির্মাতাসহ অভিনয় শিল্পীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দাবি

মোরসালিন মিজান ॥ নাটককে প্রতিবাদের ভাষা বলা হলেও, সাম্প্রতিক একটি টেলিভিশন নাটকের বেলায় উল্টোটি ঘটেছে। ‘ঘটনা সত্য’ নামের নাটকে মিথ্যার বেসাতি দেখে যারপরনাই ক্ষুব্ধ মর্মাহত দর্শক। প্রতিবন্ধী শিশুকে বাবা মায়ের পাপের ফল হিসেবে উপস্থাপন করা এ নাটক ঘিরে গড়ে উঠেছে নাগরিক প্রতিবাদ। নির্মাতাসহ অভিনয় শিল্পীরা ক্ষমা চাইলেও, পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি উঠেছে। ‘ঘটনা সত্য’ নাটকটি প্রথম প্রচারিত হয় চ্যানেল আইতে। ঈদের বিশেষ নাটক হিসেবে এটি প্রচার করা হয়। পরে অনলাইনে দেখার জন্য আপলোড করা হয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে। নির্মাতা রুবেল হাসান। মূল দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন এ সময়ের শীর্ষ তারকা আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরী। নাটকের গল্প অনুযায়ী, নিশো একটি এপার্টমেন্টের গাড়ি চালক। মেহজাবীন গৃহকর্মী। দুজনই চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। গল্পের ধারবাহিকতায় তাদের মধ্যে প্রেম ও পরে বিয়ে হয়। অচিরেই সংসারে আসে প্রথম সন্তান। সন্তানটি প্রতিবন্ধী। গল্পের এ পর্যায়ে এসে বার্তা দিয়ে বলা হয়, পাপ করলে শাস্তি অনিবার্য। এবং প্রতিবন্ধী সন্তান চোর দম্পতির পাপের ফসল। নেপথ্য কণ্ঠে পরিষ্কার করে বলা হয়, ‘পাপের ফল মানুষ কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। প্রত্যেককেই তার নিজ নিজ কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। এটাই নিয়তি। কখনও কখনও আমাদের কোন অনৈতিক কাজ বাস্তব জীবনে চরম শাস্তি নিয়ে আসতে পারে। যা হয়তো জীবনব্যাপী ভোগ করতে হয়। ঘটনাটি কিন্তু সত্য।’ টিভি নাটকের মাধ্যমে এমন ভুল অন্যায় অনাকাক্সিক্ষত এবং নিষ্ঠুর প্রচারনায় সাধারণ দর্শক স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। অনেকে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বিশেষ শিশুর বাবা মা ও অভিভাবকরা মারাত্মক আহত হন। নতুন করে বিব্রত বোধ করেন। একইসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন টেলিভিশন নাটকের সাধারণ দর্শক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বিষয়টি দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে। তুমুল সমালোচনা চলে ফেসবুকে। জনৈক শাহাদাত হোসেন তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, স্পেশাল চাইল্ড আমাদের কোন বোঝা নয়। তারা আমাদের অন্য সবার সন্তানদের মতোই সাধারণ সন্তান। সৃষ্টিকর্তা নিজেই স্পেশাল চাইল্ডদের নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন। অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমালোচনা করে তিনি লিখেছেন, টাকার জন্য অভিনেতারা বিক্রি হয়ে যায়, ডিরেক্টররা যা খুশি তাই বানায়, বড় বড় প্রতিষ্ঠান সেখানে পয়সা ঢালে। কিন্তু আমাদের নৈতিকতার এত অবক্ষয় কিভাবে মেনে নেয়া যায়? আমি জানতে চাইছি, এই নাটকটি নির্মাণের সাথে জড়িত সকল কলাকুশলী এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন। শুধু ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাসে ‘সরি’ বললে সেটাই কি সমাধান? যারা যারা এর মধ্যে নাটকটা দেখেছেন, তাদের মানসিক অবস্থাটা একবার ভাবুন! একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসে কি সব সমস্যার সমাধান হয়। তিনি দুঃখ করে বলেন, একটি নাটকের পেছনে তো কতজন মানুষ থাকে! এর স্ক্রিপ্টলেখক, প্রযোজক, পরিচালক, স্পনসর, নায়ক-নায়িকা এমনকি একটি টিভি চ্যানেলেও ঈদের নাটক হিসেবে এটি প্রচারিত হয়ে গেল! একটি মানুষেরও কি মনে হয়নি কত বড় অন্যায় তারা করছেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও চিত্র শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী নাটকের প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছেন, তাদের (নাটক সংশ্লিষ্টদের) কোন এথিকস নেই। এ কারণেই তারা সমাজের প্রতি কোন দায়িত্ব বোধ করেন না। তিনি শারীরিক ত্রæটি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করা আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিংসহ বিশ্ববরেণ্য কয়েকজনের ছবি পোস্ট করে লিখেন, সেই বাবা মায়েদের গভীর শ্রদ্ধা জানাই যারা এমন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন প্রায় সব সংগঠন নাটকের প্রতিবাদ করছে। চাইল্ড ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ঈদে আফরান নিশো এবং মেহজাবীন অভিনীত নাটক ‘ঘটনা সত্য’ গল্পে চরম অসত্য এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের পরিবারকে আঘাত করে যে গল্প মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা দুঃখজনক এবং আইনত দণ্ডনীয়। আমাদের এই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের সমাজে মাথা উঁচু করে বসবাস করতে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। নাটকের কলাকুশলীদের প্রতি নিন্দা জানিয়ে নাটকের বিরুদ্ধে ইউটিউব কর্র্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করার আহŸান জানানো হয় চাইল্ড ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে লাইভ আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলে সেখানে উপস্থিত হন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বাবা মায়েরা। তারাও নাটকের তীব্র প্রতিবাদ করেন। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন নাট্যজনরাও। সিনিয়র অভিনেতা মামুনুর রশীদের মতে, ‘ইট ইজ বিগ অফেন্স।’ তবে এটা ইন্ডিভিজুয়াল মানুষের ভুল। তাদের সতর্ক করার ওপর জোর দেন তিনি। প্রতিবাদের মুখে ক্ষমা চেয়ে নাটকটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে নিয়েছে কর্র্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে নাটকের নির্মাতা রুবেল হাসান বলেন, আমাদের ভুল হয়েছে। যেসব বাবা-মায়েরা আমাদের এই ভুলে কষ্ট পেয়েছেন, তাদের সবার কাছে ক্ষমা চাইছি। নাটকের অন্যতম অভিনয়শিল্পী মেহজাবীনও বিষয়টি নিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি খুবই দুঃখিত লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। এটা আমাদের অনেক বড় একটা ভুল। কোন স্পেশাল চাইল্ড বা তাদের বাবা-মাকে আঘাত করার মানসিকতা আমাদের মোটেও ছিল না। এটাকে একটা শিক্ষা হিসেবে নিচ্ছি। নাটকের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিএমভির পক্ষ থেকেও ফেসবুকে একটি বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘ঘটনা সত্য নাটকের নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী ও কলাকুশলীদের পক্ষ থেকে আমরা গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনাদের অনেকেই জানিয়েছেন, এ নাটকের মাধ্যমে ভুল বার্তা দেয়া হয়েছে। অভিযোগটির সাথে আমরা সহমত পোষণ করছি। বিষয়টি একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। প্রথম বার্তা পাবার পরপরই আমরা উপলব্ধি করি, অসাবধানতাবশত নাটকে আমরা ভুল একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা নাটকটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিই।’ তবে এই ক্ষমা চাওয়াতেই বিষয়টি নিষ্পন্ন হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে ক্ষমা চাওয়া হয়। পরে আবারও ঘটে। এ অবস্থায় আইনী কঠোর পদক্ষেপ দাবি করছেন অনেকে। দাবি অনুযায়ী আইনটি ঘেঁটে দেখা যায়, তাতে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এর ধারা ৩৭ (অপরাধ ও দণ্ড), উপধারা (৪) বলছে: ‘কোন ব্যক্তি পাঠ্যপুস্তকসহ যে কোন প্রকাশনা এবং গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে নেতিবাচক, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর ধারণা প্রদান বা নেতিবাচক শব্দের ব্যবহার বা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হইবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ নাফিস রহমান নামের একজন এনজিও কর্মকর্তা বলছেন, এই নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী মামলা করে একেকজনকে ৩ বছরের জেল এবং ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করা উচিত। এরকম একটি নাটকের সাথে সম্পৃক্তদের জেল-জরিমানা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবন্ধিতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে যাচ্ছেতাই নাটক হয়তো বন্ধ হবে না! আইনটির ৪০ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে সংশ্লিষ্ট প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারকেও আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি। পাশাপাশি তার পরামর্শ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন ছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৯ (মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, ইত্যাদি), ধারা ৩৫ (অপরাধ সংঘটনে সহায়তা ও উহার দণ্ড) এবং ধারা ৩৬ (কোম্পানি কর্তৃক অপরাধ সংঘটন) এর অধীনেও মামলাটি হতে পারে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার এ্যান্ড অটিজম (ইপনা)। ইপনার পরিচালক শাহীন আখতার। নাটকে তুলে ধরা বক্তব্য সম্পর্কে মতামত জানতে চাওয়া হলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা ডিজএ্যাবল বাচ্চাদের একটা স্কুল পরিচালনা করি। তাদের স্পেশাল কেয়ার দরকার হয়। সেটা নিশ্চিত করতে শিক্ষকরা অত্যন্ত ধৈর্য ও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেন। আর বাবা মায়েরা তো এই বাচ্চাদের জন্য নিজের জীবনের অনেক স্বপ্ন ত্যাগ করতেও দ্বিধা করেন না। অথচ সেই বাবা মায়েদের প্রতিই আমাদের সমাজ অনেক সময় নিষ্ঠুর আচরণ করে থাকে। নাটকটির মাধ্যমেও আসলে তা-ই করা হয়েছে। এর চেয়ে অন্যায় আর কিছু হতে পারে না। টেলিভিশন নাটক কুসংস্কার কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে কথা বলবে। সেটি না করে উল্টো কিনা তারা কুসংস্কারকেই প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা দুঃখজনক। শুধু নাটক সংশ্লিষ্টরা নয়, সমাজের সকলকে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের প্রতি, তাদের পরিবারের প্রতি মানবিক আচরণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
×