ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সংক্রমণ ও মৃত্যুর সব রেকর্ড ভেঙ্গে আগস্টেই বড় ধাক্কা

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২৭ জুলাই ২০২১

সংক্রমণ ও মৃত্যুর সব রেকর্ড ভেঙ্গে আগস্টেই বড় ধাক্কা

অপূর্ব কুমার ॥ করোনার ডেল্টা ধরনে সংক্রমণের উর্ধমুখী প্রবণতার মধ্যে কঠোর বিধিনিষেধের শিথিলতার ভয়াবহতা আগস্টে দেখা যাবে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সব রেকর্ড ভেঙ্গে আগস্টেই বড় ধাক্কা আসবে। বিধিনিষেধ শিথিল করায় ঈদ উপলক্ষে সাধারণ মানুষের অবাধ চলাচল ও স্বাস্থ্যবিধি ভাঙ্গার প্রতিযোগিতায় মাশুল সাধারণ মানুষকে দিতে হবে। দেশে গত আট দিনের করোনা সংক্রমণের হার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার আশঙ্কাজনক। সোমবার নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। রবিবার এই হার ছিল ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ। ২৪ জুলাই এই হার ছিল ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২৩ জুলাই ছিল ৩১ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২২ জুলাই ছিল ৩২ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২১ জুলাই শনাক্তের হার ছিল ৩০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২০ জুলাই করোনা শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। ১৯ জুলাই করোনা শনাক্তের হার ছিল ২৯ দশমিক ৫৯। অর্থাৎ প্রতিদিনই আশঙ্কাজনক হারে সংক্রমণ ঘটছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত আট দিনে দেশে করোনায় মারা গেছেন মোট ১৬২৭ জন। এর মধ্যে সোমবার মারা গেছেন সর্বোচ্চ ২৪৭ জন। এটি দেশে একদিনে করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু। গত ১৯ জুলাই দেশে করোনায় মৃত্যু ঘটেছে ২৩১ জনের। এটি ছিল করোনায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। ২০ জুলাই মৃত্যু ঘটেছে ২০০ জনের। ২১ জুলাই মারা গেছেন ১৭৩ জন। ২২ জুলাই মারা গেছেন ১৮৭ জন। ২৩ জুলাই মারা গেছেন ১৬৬ জন। ২৪ জুলাই করোনায় মারা গেছেন ১৯৫ জন। ২৫ জুলাই মারা গেছেন ২২৮ জন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে করোনার ভয়াবহতার মধ্যেই ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছিল। মাঝখানের বিরতির পর গত শুক্রবার থেকে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধও দেয়া হয়েছে। কিছুদিন ধরেই দেশে কঠোর বিধিনিষেধ চলছিল। ঈদ উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিলে কোরবানির পশুর হাট, শপিংমল, মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি মোটেও মানা হয়নি। অনেকেই ঢাকা থেকে বাস, ট্রাক, লঞ্চে গাদাগাদি করে ঈদ করতে গেছেন গ্রামে। গত শুক্রবার থেকে কঠোর বিধিনিষেধের পরও ঢাকায় ফিরেছেনও তারা। সোমবারও রাজধানীতে ফিরছেন জনগণ। ফেরি, বাসে ছিল না স্বাস্থ্যবিধির বালাই। তবে এখন পর্যন্ত ৫২ লাখ মানুষ ঢাকার বাইরে অবস্থান করছে। ঈদ উপলক্ষে এক কোটির ওপর মানুষ ঢাকা ছেড়েছিল। মোটরসাইকেল এখন দূরপাল্লায় যানবাহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া ফেরিগুলোতে হেঁটে আসা মানুষও গাদাগাদি করে পার হচ্ছেন। দেশের আট বিভাগের মধ্যে সাত বিভাগেই করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তির নমুনা থেকে জিনোম সিকোয়েন্সে ডেল্টা ধরন পাওয়া গেছে। বিশ্বের ১০০টি দেশে ডেল্টা ধরন পাওয়া গেছে। এটিই সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ প্রবণ। জার্মানির গেøাবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের সাতটি বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৫০টি নমুনায় ডেল্টা ধরনে বি-১৬১৭ পাওয়া গেছে। রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, বর্তমান সংক্রমণে ডেল্টা ধরনই বেশি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণের এই হার অব্যাহত থাকলে করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালে শয্যা পাওয়া যাবে না। তাই সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলার বিকল্প নেই। একইসঙ্গে জনগণকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ রোবেদ আমিন বলেন, আগামী মাস অর্থাৎ আগস্টে বড় একটা ধাক্কা আসবে। তিনি বলেন, হাসপাতালের সক্ষমতা কমে আসছে দ্রæত। নির্ধারিত শয্যার চেয়ে রোগী বেশি হলে সামলানো যাবে না। ঈদের পর করোনা সংক্রমণ মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় স্বাস্থ্য অধিদফতর ঈদ-উল-আজহার আগে কোরবানির পশুর হাট না বসানোর সুপারিশ করেছিল। ঈদের আগে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করায় গভীর উদ্বেগ জানায় কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। কমিটি বিধিনিষেধ শিথিল করার পরিবর্তে আগের বিধিনিষেধ আরও ১৪ দিন বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেটাও আমলে নেয়া হয়নি। এতে করে অবস্থা খুবই ভয়াবহ হবে মন্তব্য করেছিলেন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান। লকডাউন শিথিলের ফল পাওয়া যাবে আগস্ট মাসে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম গত ৫ জুলাই বলেছিলেন, গত বছর কোরবানির পশুর হাট শারীরিকভাবে হওয়ার কারণে সংক্রমণ বেড়ে যায় মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অনেক সময় লেগেছিল। যে কারণে এবার পশুর হাট শারীরিকভাবে না করে অনলাইনে করার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেই সুপারিশ উপেক্ষা ঈদ উপলক্ষে রাজধানীতেই ১৯টি হাট বসানো হয়েছিল। সারাদেশেই পশুর হাট বসেছিল সেখানেও স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না। অধিদফতরও বলেছিল পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। এটা বেশ উদ্বেগজনক। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ব্র্যাকের সহায়তা র‌্যাপিড এ্যান্টিজেন টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে প্রতিদিনই রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এতে বোঝা যায়, সব হাটেই মানুষ উপসর্গবিহীন ও উপসর্গ নিয়েই জমায়েত হয়েছিল। এই জমায়েত থেকেই ডেল্টা ছড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। করোনার বর্তমান উর্ধগতি সামাল দেয়া যাবে কিনা সে সংশয় জানিয়ে অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আগের বিধিনিষেধ খুব একটা কাজে আসেনি জানিয়ে অধ্যাপক খুরশিদ আলম বলেন, সীমান্তবর্তী জেলায় সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। তবে আরও কিছুদিন পর বিধিনিষেধের প্রভাব বোঝা যাবে। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, মানুষের ভিড় থেকেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সংক্রমণের উৎস অরক্ষিত রেখে কাউকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য মাস্ক পরতে বলাও ঠিক নয়। তিনি আরও বলেন, মানুষকে ব্যাপক হারে টিকা দিতে হবে। করোনার সামাজিক সংক্রমণ মারাত্মক আকারে ছড়িয়েছে। জনগণকে টিকা দেয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়া ও পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসা করা ছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অপর মুখপাত্র ডাঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, ঈদের সময় পরীক্ষার সংখ্যা কম হওয়ায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমেছে। কিন্তু নমুনার বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার কমেনি। উল্টো আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বর্তমানে যেহারে সংক্রমণ বাড়ছে সেটি যথেষ্ট শঙ্কা জাগাচ্ছে বলেও তিনি মনে করছেন। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি প্রতিদিনই খারাপ হচ্ছে। তাই সবাইকে সতর্ক হতে হবে। রাজধানীর হেলথ এ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের কারণে করোনার বড় ধাক্কা আসতে পারে আগস্টে। শিথিলতার কারণে ঢাকার মানুষদের বড় একটি অংশ বাইরে চলে যায়। অর্ধেক মানুষ ফিরে আসলেও বাকিটা রয়েছে গেছে গ্রামের বাড়িতে। কোরবানির হাট ও বিপুল মানুষের যাতায়াতের কারণে আগামীতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। এটিই হবে করোনা বড় আঘাত।
×