ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফেরত গেছে সিংহভাগ বড় সাইজের গরু

শেষদিনে গরুর দাম কমলেও আশানুরূপ বিক্রি হয়নি

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ২৪ জুলাই ২০২১

শেষদিনে গরুর দাম কমলেও আশানুরূপ বিক্রি হয়নি

রহিম শেখ ॥ করোনা মহামারীর মধ্যেই ঈদ-উল-আজহা পালিত হয়েছে। তবে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে এ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ কোরবানি দেয়ার হার এবার অনেকাংশেই কমেছে। তবে রাজধানীর হাটগুলোতে এবার কোরবানির পশু ছিল পর্যাপ্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল মাঝারি ও ছোট আকারের দেশী গরুর। দাম ও ক্রেতা কম থাকায় শেষ সময়ে সিংহভাগ বড় গরু বিক্রি করতে পারেননি বেপারিরা। ফলে ঈদ-উল-আজহার দিন সকালে খামারি ও ব্যবসায়ীরা ট্রাক-পিকআপে চেপে অবিক্রীত গরু নিয়ে রওনা হন উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এদিকে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। শেষ দিনে অনলাইনে বিক্রি হয়েছে ৩১১ কোটি টাকার কেরবানির পশু। ১৯ দিনের হিসেবে প্রায় চার লাখ কোরবানির পশু বাবদ বিক্রি হয়েছে সাড়ে ২৭০০ কোটি টাকার বেশি পশু বিক্রি হয়েছে অনলাইনে। রাজধানীতে কোরবানির পশু রাখার ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় অনেকেই ঈদের আগের দিনে কোরবানির পশু কেনেন। তবে এবার হয়েছে উল্টো। অনেকেই আগেই গরু কিনেছেন। কেউবা হাসিলের টাকা বাঁচাতে সরাসরি ফার্ম থেকে গরু কিনেছেন। সরাসরি ফার্ম থেকে গরু কেনার এই প্রথা গত কয়েক বছরে বেশ বেড়েছে। অনেকেই আবার অনলাইন থেকেও কিনছেন। করোনার কারণে অনলাইনে এবার চাহিদার তুলনায় পশু বিক্রি বেড়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতা এবং হাট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্তত ৩০ শতাংশ ব্যবসায়ী সন্তোষজনক দাম পাওয়ার পরও গরু ছাড়েননি শেষ দিনে ভাল দাম পাওয়ার আশায়। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে মানুষের কাছে অর্থের সঙ্কট থাকায় অনেকেই এবার কোরবানি দেননি। তবে রাজধানীর হাটগুলোতে এবার গরু এসেছে অনেক। গত কয়েক বছরে গরু উৎপাদনে বাংলাদেশ যে রেকর্ড অর্জন করেছে, হাটগুলোতে বেশি দেশী গরুর উপস্থিতি সেটিই এবার জানান দিয়েছে। এবার যে পরিমাণ গরু এসেছে, তা চাহিদার তুলনায় বেশ বেশি বলে মনে করছেন তারা। বাজারে গরুর যোগান বেশি থাকায় শেষ দিনে দাম কমেছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। ঈদ-উল-আজহার আগের দিন রাজধানীর গাবতলী, শাহজাহাপুর, রহমতগঞ্জ, বনশ্রীর মেরাদিয়া, হাজারীবাগের মতো বড় কোরবানির হাট ঘুরে দেখা গেছে, পছন্দের পশু কিনতে রাজধানীতে কোরবানির হাটের মধ্যেই যেমন ঘুরছেন অনেকে, তেমনি এক হাট থেকে আরেক হাটেও ছুটছেন কেউ কেউ। শেষ দিনের কেনাবেচায় দেখা গেছে কেউ জিতছেন, কেউবা হেরেছেন। আর অন্যরা পছন্দের পশু বিশেষ করে মাঝারি আকারের দেশি গরু কিনতে হাটের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চষে বেরিয়েছেন। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি কোরবানির পশু আসে রাজধানীর অন্যতম প্রধান পশুর হাট গাবতলীতে। শেষ দিন গাবতলী হাট ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন জাতের বিশাল আকৃতির গরু রয়েছে এই হাটে। বড় গরুর একেকটার ওজন ১৫-৩৫ মণ পর্যন্ত হবে বলে দাবি বিক্রেতাদের। অস্ট্রেলিয়ান, আফ্রিকান জাতসহ রয়েছে দেশী মীরকাদিম, লম্বা শিংয়ের সিদ্ধি গরু। এসব বড় আকৃতির একেকটা গরুর দাম ৭-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে। এবার এসব গরু খুব একটা বিক্রি হতে দেখা যায়নি। বিক্রেতাদের অনেকেই বিরক্তি নিয়ে বললেন, সবাই শুধু দাম জানতে চায়। কিন্তু কেউ কিনতে চায় না। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের বাবু ক্যাটল ফার্মের কর্মী হেমায়েত বলেন, শেষদিনে দাম পানির মতো হয়ে গেছে। যে গরুর দাম আগে ক্রেতারা সাড়ে তিন লাখ বলেছেন, পরে সেটি বলছেন দুই লাখ। হাটে আসা ক্রেতারাও স্বীকার করছেন, শেষ দিনে পশুর দাম কমেছে। আকার অনুযায়ী গরুপ্রতি অন্তত ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা কমেছে। কম দামে কাক্সিক্ষত পশু পেয়ে খুশি ক্রেতারা। অন্যদিকে হাটের শেষ রাতে কম দামে পশু ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বিক্রেতারা। পাবনা থেকে ২৫টি গরু নিয়ে এসেছিলেন জামাল মিয়া। জানান, ১৯টির মতো বিক্রি হয়েছে। বাকি ৬টা গরু বড় আকারের, ফলে দাম উঠছে না বলে বিক্রি করতে পারেননি তিনি। মিরপুর থেকে গাবতলী হাটে কোরবানির গরু কিনতে এসেছিলেন ফরহাদ হোসেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, প্রতি কোরবানিতে এখান থেকে গরু কিনি। হাটে গরুর সংখ্যা বেশি। করোনার কারণে তুলনামূলকভাবে ক্রেতা কম। শেষ সময়ে এসে এক লাখ ৮৫ হাজার টাকায় গরুটি কিনতে পেরেছি। দুদিন আগে এটি কিনতে হলে অন্তত আড়াই লাখ টাকা গুনতে হতো। আফতাবনগর ও মেরাদিয়া হাটের ইজারাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ায় এবার হাটে বেচাকেনা কিছুটা কম ছিল। অনলাইন থেকে অনেকে গরু-ছাগল কিনেছে। ফলে এবার যত পশু এসেছে, সব বিক্রি হবে কিনা আগে থেকেই শঙ্কায় ছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত সিংগভাগ বড় গরু অবিক্রীত অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। বিক্রি না হওয়ায় ফেরত গেছে সিংহভাগ বড় সাইজের গরু ॥ এবার উত্তরবঙ্গ থেকে কয়েক হাজার পশু বিক্রির জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাটে নিয়েছিলেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু দাম ও ক্রেতা কম থাকায় বিক্রি হয়নি বড় সাইজের অধিকাংশ গরু। ঈদের দিনেও পশুর হাটে রয়ে যাওয়া গরুর বেপারিদের বেশির ভাগ জানান, তাদের লোকসান হয়েছে। কয়েকজন বলছেন, লাভ হয়নি, ক্ষতিও হয়নি। গরু বিক্রি করে শুধু টাকা নগদ করেছেন। তারা বলেন, শুধু উত্তরবঙ্গেরই অন্তত ১০ হাজার গরু অবিক্রীত রয়ে গেছে। ঈদের দিন দুপুরে গাবতলী হাটে কথা হয় একাধিক খামারি ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে। এ সময় কুষ্টিয়া থেকে আসা ব্যবসায়ী সুজন বলেন, ‘১৪টি গরু গাবতলী হাটে নিয়েছিলাম। মাত্র ছয়টি গরু বিক্রি হয়েছে। এবার গরুতে লাভ হয়নি, ক্ষতি হয়েছে। হাটে ক্রেতা ও দাম কম থাকায় বাকি ১১টি গরু বিক্রি করতে পারিনি। ট্রাক ভাড়া ও আমাদের খরচ ওঠেনি। গরু তো আর ফেলে দেয়া যাবে না। এজন্য বাড়িতে ফিরিয়ে নিচ্ছি। স্থানীয় হাটে বিক্রি করব।’ ছাগলের দাম ছিল বাড়তি ॥ শেষ দিনে গাবতলী, আফতাবনগর, শাহজাহানপুরের হাটে দেখা গেছে, ছোট আকারের ছাগল ১৫/১৮ হাজার টাকা, মাঝারি ২৫/৩০ হাজার এবং বড় আকারের ৩৫/৩৮ হাজার টাকা দাম হাঁকাচ্ছিলেন বিক্রেতারা। ক্রেতা আব্দুস শাকুর বলেন, ‘পরিবারের পছন্দ বলে ঈদে তিনটি ছাগল কোরবানি দেই। এবার যে দাম দেখছি, সব বাজেট ফেল হয়ে গেছে। কোনভাবে দরদাম ম্যানেজ করতে পারছি না।’ পাবনা থেকে ৪৮টা ছাগল এনেছেন শিহাব ও রাকীব। শিহাব জানান, চাহিদা বেশি থাকায় খামারিদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। পরিবহন খরচ মিলিয়ে হিসাব করলে যে দাম বলছি, সেটা খুব বেশি না। ‘দাম-দরের কষাকষিতে দেখবেন যে ছাগল ১৫/১৮ হাজার টাকা হাঁকানো হচ্ছে, সেটা পরে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।’ এছাড়া ঈদের আগের দিন মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, বছিলা, পশ্চিম ধানম-ি, রামপুরা, মৌচাক, শান্তিবাগ, পল্টন লেন, আজিমপুর, নবাবপুরসহ অনেক এলাকাতেই ঈদ-উল-আজহার আগের দিন বিভিন্ন সড়কের ফুটপাথে ও অলি-গলিতে ছাগল বিক্রি করতে দেখা গেছে। ১৯ দিনে সাড়ে ২৭০০ কোটি টাকার বেশি পশু বিক্রি ॥ প্রাণিসম্পদ অফিসের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯ দিনে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সাড়ে ২৭০০ কোটি টাকার বেশি পশু বিক্রি হয়েছে। পশুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে প্রায় চার লাখ। প্রায় ১৮০০ অনলাইন হাটে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়াসহ কোরবানিযোগ্য পশুর ছবি আপলোড হয়েছে ১৮ লাখের বেশি। ঈদ-উল-আজহার আগের দিন মঙ্গলবার পশু বিক্রি হয়েছে ৩১১ কোটি টাকার উপরে। প্রাণিসম্পদ অফিস জানায়, অনলাইনে মোট পশু বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫৭৯টি। যার বিক্রয় মূল্য ২ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা ১১ লাখ ১৫ হাজার ৬৭৮ টাকা। এর মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যা ২ লাখ ৯৬ হাজার ৭১০টি ও ছাগল এবং ভেড়া রয়েছে ৯০ হাজার ৮৬৯টি। গত মঙ্গলবার একদিনে পশু বিক্রি হয়েছে ৩১১ কোটি ১ লাখ ৭৯ হাজার ৪২৪ টাকা, পশুর সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ১৫১টি। ১ হাজার ৭৬৮টি অনলাইন বাজারে মোট ছবি আপলোড হয়েছে ১৮ লাখ ১২ হাজার ২০২টি। এর মধ্যে গরু-মহিষ ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮৪০টি ও ছাগল এবং ভেড়ার সংখ্যা ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৩৬২টি। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের দেয়া তথ্যে দেখা যায়, অনলাইনে পশু বিক্রিতে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৬৯ হাজার ২১১টি পশু বিক্রি হয়েছে, যার বাজারমূল্য ১ হাজার ১৬৫ কোটি ৬৬ লাখ ৩৪ হাজার ৪০০ টাকা। এর পরে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগে এখন পর্যন্ত ৬৩ হাজার ৪২টি পশু বিক্রি হয়েছে ৬২৮ কোটি ৬৮ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫২ টাকায়। রাজশাহী বিভাগে ৫৮ হাজার ৯৫০টি পশু বিক্রি হয়েছে ৩৫৪ কোটি ১১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৮ টাকায়। খুলনা বিভাগে ২৫ হাজার ৯৬১টি কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছে ১৭১ কোটি ১৬ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকায়। বরিশাল বিভাগে চার হাজার ২৬১টি গবাদি পশু বিক্রি হয় ২৮ কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার ৪০০ টাকায়। সিলেট বিভাগে ছয় হাজার ৭৪৫টি কোরবানির পশু বিক্রি হয় ৩৬ কোটি ৫৪ লাখ ২৯ হাজার ৯০৮ টাকায়। রংপুর বিভাগে ৬৭ হাজার ৫৮২টি পশু বিক্রি হয়েছে ৩২৭ কোটি ৯৬ লাখ ৭৮ হাজার ৫৯০ টাকায়। ময়মনসিংহ বিভাগে দুই হাজার ৪২৭টি পশু বিক্রি হয়েছে ২২ কোটি ৩৭ লাখ ৮২ হাজার ৪৬০ টাকায়। হাট থেকে উধাও স্বাস্থ্যবিধি ॥ পশুর হাটগুলোতে শেষ দিনের বেচাকেনায় স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না বললেই চলে। হাটের অধিকাংশ সময়ই অধিকাংশ বিক্রেতার মুখে মাস্ক ছিল না।
×