ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

ঈদ আনন্দে ডেল্টার ছোবল

প্রকাশিত: ২০:০০, ২০ জুলাই ২০২১

ঈদ আনন্দে ডেল্টার ছোবল

প্রাত্যহিক জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে এবং সমাজ-সংসারে পারস্পরিক আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নিতে বিশেষ দিনক্ষণে এক একটি উৎসব মনুষ্য সমাজে যুগের পর যুগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আজহা বিশ্বময় মুসলিম উম্মাহর জন্য দুটি সার্বজনীন উৎসব। পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সকল মুসলমান একই সময়ে এ উৎসবগুলো উদ্যাপনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যে সার্বজনীন ঐক্যের বন্ধন রয়েছে তা নতুন করে অনুভব করে। এ দুটি উৎসবের বাইরে পহেলা বৈশাখের মতো আরও একটি বড় উৎসব বাঙালী সমাজে ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। এছাড়াও ছোট-বড় আরও অনেক উৎসব সময় সময় পালিত হয়, যা এদেশের মানুষের মনোজগতের চাহিদা পূরণে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। ঈদ উৎসব মানেই আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে সড়ক, রেল কি নৌপথ- সর্বত্র ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড়। সব জায়গায় মানুষের গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি। এত কষ্ট-ক্লেশ, তবু প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলনের এ যাত্রায় কারও মনে কোন খেদ নেই। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের জন্য এটি বার্ষিক বিশেষ আয়ের একটি উপলক্ষও। কোরবানির হাটে পশু ক্রয়ের জন্য বিপুল মানুষের সমাহার, পছন্দসই পশুর খোঁজে এ হাট ও হাট ঘুরে ঘুরে দেখা, একের পর এক পশু নিয়ে দামদস্তুর-এ সবই ছেলে-বুড়ো সবার মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার করে। বাচ্চাদের মধ্যে এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে কিনে আনা পশুগুলো দেখার হিড়িক পড়ে যায়। পশু জবাইয়ের পর মাংসের কাটাকুটিতে হাত লাগানো অনেকের জন্যই সারা বছরে একবারের অভিজ্ঞতা হলেও উৎসাহের কোন কমতি থাকে না। পরিশেষে এই আয়োজনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন কোরবানির মাংস রান্না হয়ে আসে তখন সবার মনে হয় প্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি সমাগত। ইসলাম কোরবানির এ উৎসবকে সার্বজনীন রূপ দিতেও কেবল প্রথম প্রহরে সকলের সমভিব্যাহারে ঈদ জামাতের ব্যবস্থাপনাই দেয়নি, কোরবানির মাংস তিন ভাগ করে দু’ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে উৎসাহ যুগিয়েছে। এতে করে আত্মীয়-পরিজনদের হৃদ্যতা আরও গভীর হয়। গরিব-মিসকিনদের মনে এ অনুভূতি জাগে, এ উৎসব কেবল ধনীদের নয়, তারাও এর সমান অংশীদার। তবে গত বছর থেকেই মুসলিম সমাজের এই আনন্দ আয়োজন ফিকে হয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট অতিমারীর ছোবলে। কোথায় মানুষ উৎসবে মাতবে, কিন্তু জান বাঁচাতেই গলদঘর্ম। এই অতিমারীর সবচেয়ে বাজে দিক হলো, এটি মানুষের সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। তাকে বাধ্য করেছে স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় অনেকটা গৃহবন্দী জীবনযাপন করতে। মানুষ যখন তার আধুনিকতম কলাকৌশল প্রয়োগে স্বল্পতম সময়ে টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে এই ভয়ানক ভাইরাস আক্রমণের রাশ টানতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল, এটি তখন বারে বারে রূপ পাল্টে নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। রোজার ঈদে বিটা ভ্যারিয়েন্টের ধাক্কাটা দেশ কোনরকমে সামলে নিয়েছিল। কিন্তু এবারে কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে শুরু হওয়া ডেল্টার এই ভয়াবহ ছোবল কোথায় গিয়ে ঠেকে তা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারে। করোনা অতিমারীর সূচনার পর থেকে করোনাভাইরাসের আদি রূপ পরিবর্তিত হয়ে এযাবৎ অনেক মারাত্মক রূপে আবির্ভূত হয়েছে, যেগুলো দেশে দেশে অতিমারী মোকাবেলায় বিজ্ঞানীদের আপাত সাফল্যকে বারবার ম্লান করে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছে। এই ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আলফা বা ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, বিটা বা সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট, গামা বা ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট এবং সর্বশেষ ডেল্টা বা ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট। মনে করা যেতে পারে, ডেল্টা বা ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট এই ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংস্করণ। এটি যে কতটা ধ্বংসলীলা চালাতে পারে তার সাক্ষাত উদাহরণ পাশের দেশ ভারত। ডেল্টার ছোবলে সে দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারে যে ক্ষিপ্র উর্ধগতি দেখা দিয়েছে তা এক অর্থে নজিরবিহীন। বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট একরকম আগাম জানান দিয়েই এসেছে। পাশের দেশ ভারতে যখন এর ভয়াবহ তা-ব চলছিল, তখন স্পষ্টতই অনুমিত হচ্ছিল বাংলাদেশেও এর বিস্তার সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেখা গেল, শনাক্ত হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথমে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এবং পরে খুব দ্রুত সারা দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অল্প সময়ের মধ্যেই অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করে। প্রথমবারের মতো দেশ টানা দ্বিশতাধিক মৃত্যু দেখতে পায়। সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হলো, বিশেষজ্ঞদের মতে সংক্রমিত রোগীদের অর্ধেকের বেশি গ্রামাঞ্চলের। যার মানে দাঁড়ায় এই ভাইরাস এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে কি ঘাটতি ছিল? উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা কি সঠিক পথে হাঁটছি? দেখা গেছে এই ভাইরাসের দ্রুত বিস্তারের প্রধান কারণ এর অত্যধিক সংক্রমতা, যা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করে। এতে করে দ্রুত হাসপাতালসমূহে কোভিড রোগীদের জন্য বরাদ্দ সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা সংখ্যা নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে। ফলে আগত রোগীদের হাসপাতালে যথাযথ পরিচর্যার আওতায় আনতে না পারায় বাড়তে শুরু করে মৃত্যুর সংখ্যা। দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা গ্রাম-গঞ্জ থেকে অনেক দেরিতে মুমূর্ষু অবস্থায় রোগীদের হাসপাতালে আনাকেও দায়ী করেছেন। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমিত সক্ষমতার কারণে তাই প্রথম থেকেই আমাদের ফোকাস থাকা দরকার ছিল সংক্রমণের বিস্তার রোধের ওপর। এ বিবেচনায় প্রথমে আঞ্চলিক পর্যায়ে এবং পরবর্তীতে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন দিয়ে সরকার সঠিক পথেই এগিয়েছে। আমরা যেখানে মোটা দাগে পিছিয়ে আছি, তা হলো আমরা জনসাধারণের একটি বিপুল অংশকে মাস্ক পরিধানের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ অথচ নিতান্তই সহজ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণে যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারিনি। আমাদের মতো দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় লকডাউনের মতো কর্মসূচী প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সহজ নয়। এক্ষেত্রে ব্যাপক পরিসরে মাস্কের যথোচিত ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা কমে আসত। মাস্কের সার্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিতকরণে আমরা কেন আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারছি না তা নিয়ে আরও গুরুত্বসহকারে ভাবা দরকার। অনেকে মনে করেন, এটি করতে হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মীসহ ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। দৃশ্যত যা আমরা এখনও পর্যন্ত হালকাভাবে নিচ্ছি। একই কথা খাটে বারবার লকডাউন অকার্যকর হয়ে পড়ার ক্ষেত্রেও। দেখা যাচ্ছে লকডাউন শুরুর কয়েকদিন পরেই এটি বহুলাংশে স্রেফ গণপরিবহন বন্ধ থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রধান সড়ক বাদে অলি-গলিতে লকডাউনের আলামত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি লকডাউন সফলভাবে কার্যকরে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা হলো স্বল্প ও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের অনেকেই দৈনন্দিন আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তাদের সহযোগিতায় পাশে দাঁড়ানোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অনুপস্থিতি। ডেল্টা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমাদের আরেকটি ঘাটতির দিক হলো জেলা ও মফস্বল পর্যায়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ বেড সংবলিত স্বাস্থ্য অবকাঠামো পর্যাপ্ত মাত্রায় কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই না থাকা। করোনা সংক্রমণ ব্যাপকহারে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ায় এটা এখন অন্যতম প্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও একটি বিষয় সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। টিকা সংগ্রহ ও প্রয়োগে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব ঠেকাতে দ্রুত ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা অপরিহার্য। দুঃখের বিষয়, অনেক আগে এদেশেই টিকা তৈরির প্রস্তাব আমাদের দেয়া হয়েছিল, যা আমরা হেলায় হারিয়েছি। দেশেও বেসরকারীভাবে টিকা তৈরির চেষ্টা চলছে। সেখানেও আমরা যথোচিত গুরুত্ব আরোপ করতে ব্যর্থ হয়েছি। কয়েক সপ্তাহের ‘কঠোর’ লকডাউনের পর সরকার ঈদ আয়োজন ও কোরবানির পশু কেনা-বেচার মতো অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে সামনে রেখে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন শিথিল করেছে। যদিও জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে সরকারের সামনে শ্রেয়তর কোন বিকল্প ছিল না, কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি মোটেও এর অনুকূল নয়। ঈদ জামাত, কোরবানির হাট এবং ঈদ উপলক্ষে শহর ও গ্রামের মধ্যে বহুমুখী জনস্রোত শেষ পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতির ওপর কী রকম প্রভাব ফেলে বলা মুশকিল। তবে ফের কঠোর লকডাউন শুরুর যে আগাম পরিকল্পনা রয়েছে তার প্রেক্ষিতে নীতি-নির্ধারকদের নিম্ন আয়ের মানুষকে আর্থিক সাহায্য কিংবা সুদমুক্ত ঋণ দেয়ার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এখনই হাতে নেয়া জরুরী। লেখক : অধ্যাপক ও সভাপতি ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×