ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্মার্টফোনের অপব্যবহার

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ২০ জুলাই ২০২১

স্মার্টফোনের অপব্যবহার

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ তা নিয়ে বিতর্ক বিরাজমান সেই আদিকাল থেকেই। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে এ্যাটম বোমা ফেলা হলে এটি অবশ্যই বিজ্ঞানের অভিশাপ হয়ে ওঠে। তবে পারমাণবিক বিভাজন বা বিক্রিয়া যখন বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে পারমাণবিক চুল্লিতে, তখন সেটি নিশ্চয়ই হয়ে ওঠে পরিবেশবান্ধব, ব্যয়সাশ্রয়ী, টেকসই। দীর্ঘমেয়াদী তদুপরি বিজ্ঞানের আশীর্বাদ হিসেবে। অনুরূপ হয়েছে মোবাইল ফোন বিশেষ করে স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, স্মার্টফোন পুরো বিশ্বকে এনে দিয়েছে মানুষের হাতের মুঠোয়। একই সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগও। বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ১৭ লাখ ১ হাজার। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কম নয়-২০২০ সালের হিসাবে ৫৩ দশমিক ৩ মিলিয়নের বেশি। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক ব্যবহার পরিলক্ষিত হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক ব্যবহারও দেখা যায়। এমনিতেই মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে এর বিকিরণ শরীর ও মনে ক্ষতিকর প্রভাব এবং আসক্তি সৃষ্টি করে থাকে। চোখের সমূহ ক্ষতি করে। এর পাশাপাশি দেড় বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝুঁকে পড়ছে ভিডিও গেম খেলায়, টিকটক-লাইকিসহ বিভিন্ন অশ্লীল ভিডিওতে। জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক বেচাকেনা ও নেশায়। জঙ্গী কার্যক্রমে, গ্যাংকালচারে। এমন কি নারী পাচারেও। ই-বিজনেসেও চলছে দেশে নানা প্রতারণা। এ সবই সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ডেকে আনছে সমূহ বিপর্যয় ও সর্বনাশ। ইদানীং রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কিশোর অপরাধ অনেক বেড়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ভাবিয়ে তুলছে বিষয়টি। অভিভাবকরাও স্বভাবতই উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কি জানি, যদি নিজের সন্তানটিও কোন না কোনভাবে জড়িয়ে পড়ে কিশোর অপরাধী দলের সঙ্গে। আর সবাই জানেন, একবার কোন অপরাধ, তা সে ছোট-বড় যাই হোক না কেন, কম-বেশি জড়িয়ে পড়ে পুলিশের খাতায় নাম উঠলে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয় দুষ্কর্ম ও কলঙ্কের বোঝা। যা আত্মীয়স্বজনসহ সমাজের জন্য মুখ দেখানোর ক্ষেত্রে রীতিমতো দায় হয়ে দাঁড়ায়। বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে নয়ন বন্ড গ্রুপ কর্তৃক রিফাতকে রামদা দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা, রাজধানীর দিলু রোডে বিয়ের আসরে ঢুকে বখাটে কর্তৃক কনের বাবাকে হত্যা অথবা ক্রিকেট খেলাসহ নানা তুচ্ছ কারণে এক কিশোর গ্রুপ কর্তৃক আরেক কিশোর গ্রুপের কিশোর হত্যার ঘটনা বাড়ছে দিন দিন। এটি একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশের জন্য আদৌ শুভ লক্ষণ নয়। নানা কারণে দেশে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে রাজধানী ঢাকা, বন্দর ও বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যত্র। এসব গ্রুপের আবার গ্যাং লিডারও রয়েছে, যারা অপেক্ষাকৃত অল্প শিক্ষিত এবং মস্তান শ্রেণীর। অধিকাংশই ফেসবুক, ইন্টারনেটে আসক্ত, মাদকাসক্ত, ছোটখাটো ছিনতাই-রাহাজানির সঙ্গে যুক্ত। পুলিশের খাতায় নাম লেখানো উচ্ছৃঙ্খল বিপথগামী সন্তান। এক গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের সম্পর্ক মোটেও ভাল নয়-প্রধানত এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে। ফলে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনী তদুপরি প্রতিশোধ স্পৃহা লেগেই থাকে। কিশোর-তরুণদের এভাবে বখে যাওয়া, দলাদলি, গ্রুপিং-লবিং, পাড়া-মহল্লায় আধিপত্য বিস্তার, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ইত্যাদিকে বলা হয় ‘গ্যাং কালচার।’ আইনের পরিভাষায় জুভেনাইল সাবকালচার। এ নাকি নগরায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে গড়ে উঠছে গ্রামেও এরা প্রায়ই তুমুল হর্ন বাজিয়ে তীব্র গতিতে রাজপথ দাপিয়ে বেড়ায় হোন্ডায়, সমবয়সী মেয়েদের সকাল-বিকেল উত্ত্যক্ত করে, ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেয়, মোবাইলে অশ্লীল ছবি ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে, খেলার মাঠে হামলা চালায় প্রতিপক্ষের ওপর, সর্বোপরি ছিনতাই-চাঁদাবাজি-মাদক তো আছেই। পাঠকের মনে পড়তে পারে ঐশীর কথা, যে তার পুলিশ অফিসার বাবা ও মাকে কফির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলেছিল প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে। অথবা চট্টগ্রামের ঘটনাই বা কম কি? যেখানে সহপাঠী বন্ধুরা ছাদে হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দিয়ে মেরে ফেলেছিল হিমাদ্রীকে। তবে কিশোরদের এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ডের জন্য শুধু মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ফেসবুক, ইন্টারনেট ইত্যাদিকে দোষ দেয়া যাবে না। শুধু থানা-পুলিশ দিয়েও হবে না। এক্ষেত্রে সবিশেষ গুরু দায়িত্ব রয়েছে সমাজ, পরিবার ও অভিভাবকদের, বিশেষ করে মা-বাবা, ভাইবোনের। যথাযথ ভালবাসা ও শিক্ষা দিয়ে সন্তানদের বোঝালে বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে কিশোর প্রজন্ম।
×