ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা ব্যবস্থাপনায় সরকারের সাফল্য

প্রকাশিত: ২০:০৪, ১৯ জুলাই ২০২১

করোনা ব্যবস্থাপনায় সরকারের সাফল্য

এখন সমস্ত পৃথিবীর দুঃসময়। পৃথিবীর গভীর-গভীরতর অসুখ। ২০১৯ সালে চীনের উহান থেকে উদ্ভূত করোনাভাইরাস ডিজিজ বা কোভিড-১৯ এখন মানব সভ্যতার ওপর বিপর্যয় ডেকে এনেছে। আমেরিকা, ব্রাজিল, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, চীন, ব্রিটেন ও ভারতসহ পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও একটি সামান্য ভাইরাসের আক্রমণ-দাপটে নাস্তানাবুদ। যারা পৃথিবীকে একটি সুইচ টিপে ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, সম্পদে ও গরিমায় যাদের অবস্থান আকাশচুম্বী, তারাও এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর মারণ থাবায় লন্ডভন্ড। আর আমরা তো অতি ছোট্ট একটি দেশ। টিকে আছি উদয়াস্ত লড়াই করে। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত পোড়ামাটি থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সুসংগঠিত হতে শুরু করা দেশ। যদিওবা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ধারাবাহিক শাসন ও নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের অনেক সূচকে এগিয়ে। বিশ্বের বহু দেশের মতো করোনা এসে হানা দিয়েছে আমাদের দেশেও। নেমে এসেছে মানবিক ও সামগ্রিক বিপর্যয়। সরকার, প্রশাসন, আওয়ামী লীগ অঙ্গ-সংগঠন ও কিছু ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান মহামারী মোকাবিলায় নানাভাবে এগিয়ে এসেছে। যেখানে মানুষের কল্যাণে, জীবনের প্রয়োজনে আবশ্যক ছিল ঐকমত্যের, সেখানে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল ও তাদের অনুসারী কতিপয় ব্যক্তির নানা সমালোচনা লক্ষ্য করা যায়। করোনা মোকাবেলায় সরকার নানা উদ্যোগ, কর্মসূচী ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে জনসচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি, চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। সরকারী, বেসরকারী উদ্যোগে ফিল্ড হাসপাতাল, কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ল্যাব স্থাপন করে দ্রুত রোগী শনাক্তকরণ, টিকা প্রয়োগ ও টিকা আমদানি প্রভৃতি ব্যবস্থাপনায় সরকার তৎপর। অন্যদিকে পোশাক শিল্প ও অন্যান্য শিল্প উৎপাদন কার্যক্রমে উৎসাহিত করার প্রবণতাও লক্ষণীয়। প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে নিম্ন আয়, হত দরিদ্র জনগণ ও শিল্প বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য দুই প্রস্থে (প্রথমে ১২০০ কোটি এবং পরবর্তীতে গত ১৩ জুলাই ৩২০০ কোটি) প্রণোদনা ঘোষণা করেন। টিকা ব্যবস্থাপনা, টিকা কূটনীতিতেও সরকারের সাফল্য ছিল। টিকা যখন বহু দেশের সোনার হরিণ, বাংলাদেশে তখন ৫৬ লাখ মানুষ টিকা পেয়েছেন। উল্লেখ্য, ভারতের সিরামে তৈরি এস্ট্রাজেনেকার টিকার ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। মাসিক কিস্তিতে অন্তত তিন কোটি টিকা পাওয়ার চুক্তি ছিল। করোনা নিয়ন্ত্রণে অন্তত এক বছর পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বের দশটি দেশের মধ্য অনন্য স্থান লাভ করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতে বিপজ্জনকভাবে করোনা প্রকোপ বৃদ্ধির কারণে স্বদেশে টিকার স্বল্পতা দেখা দেয়। ভারতের টিকা প্রদানের অপারগতায় আমাদের টিকা প্রদানের পরিকল্পনার ছন্দ পতন ঘটায়। করোনার আগ্রাসী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে নানা ব্যবস্থার পরও ভারতের সঙ্গে তিন দিকের সীমান্ত যোগাযোগ, আমদানি বাণিজ্য ও ভারতগামী চিকিৎসা প্রার্থীদের যাতায়াতের কারণে বাংলাদেশে আবারও নতুন করে বাংলাদেশে সংক্রমণের প্রদুর্ভাব দেখা দেয় অনেকে মনে করেন। প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরে স্বাস্থ্যবিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষের বেপরোয়াভাবে ঘরে ফেরা, প্রবাসীরা যখন দেশে ফিরেন তখন হোম কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন পালনে অনীহা, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পোশাক শিল্পের বাজার ধরে রাখা, দুই ঈদে সাধারণ ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে শপিংমল খুলে দিলে জনগণের স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষার ফলে আমরা করোনার ভয়াল থাবায় আবারও আক্রান্ত হই। তবে প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ কূটনীতিতে আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে ফাইজার, সিনোফার্ম, মডার্নাসহ বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হই। যার সুফল আমরা ইতোমধ্যে লাভ করতে শুরু করেছি। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী কয়েক মাসে অধিকাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে টিকা কার্যক্রম। বর্তমানে ঈদুল আজহা উপলক্ষে সাধারণ ব্যবসায়ী, লাখ লাখ খামারিকে নির্বিঘ্নে পশু বিক্রির জন্য পশুর হাট খুলে দেয়া ও ধর্মীয় উৎসব পালনের কথা চিন্তা করে সরকার এক সপ্তাহের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা দিলে একদল পরিকল্পিত সমালোচক সরব হয়ে উঠেছে। এক সময়ে ঈদের জন্য লকডাউন শিথিল করার পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছিল তারাও এখন সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। যার যার অবস্থান থেকে সরকারের সমালোচনা করা যায়। কিন্তু সরকার ৯০% মুসলমানের দেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসবের সম্মানার্থে লকডাউন শিথিল করেছে যা অবশ্যই সময়োপযোগী। অন্যথায় আমরা গতবারের মতো শত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের পাড়ি জমানোর চিত্র দেখতে পেতাম। এছাড়াও সরকার শুধু জীবনের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, অনেক সময় জীবিকার কথাও চিন্তা করতে হয়। এজন্য সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেন করোনার কারণে কোন খামারিকে লোকসানে পড়তে না হয়। করোনা নিয়ন্ত্রণে অধিকাংশ দেশ শতভাগ সফল হয়েছে কেউ বলতে পারবে না। বাংলাদেশ তো উন্নয়নশীল দেশ। এমন দেশে আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। চিন্তা করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রার কথা, মাথায় রাখতে হয় প্রবাসীদের কথাও। এসব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে লকডাউন শিথিলের বিকল্প সরকারের ছিল না। সরকারের সমালোচনা করা সহজ, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধির সবচেয়ে সস্তা বিধান- মুখে মাস্ক পরার প্রতিও আমরা যত্নবান হতে পারিনি। অনেকে সরকারকে টিকা কূটনীতিতে ব্যর্থ বলে বেড়াচ্ছেন। টিকার বিষয়টি শুধু কূটনীতির ওপর নির্ভর করে না, অনেক সময় ভৌগোলিক পরিবেশের ওপরও নির্ভর করে। যার কারণে সরকারের পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও ফাইজারের টিকা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। কিছু বিষয়কে ইস্যু করে বিএনপি ঘোলাজলে মাছ শিকারের অপতৎপরতায় নেমেছিলো। পুরো জাতি নিশ্চয়ই এই স্বল্প সময়ে তা বিস্মৃত হয়নি। এতোসব অপপ্রচার, গালমন্দ ও তৎপরতার পরও মানবতার নেত্রী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ কন্যা শেখ হাসিনা যে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা ও প্রত্যয় নিয়ে সমস্ত উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন, তা পুরো বিশ্ব দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয় পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তা আমাদের পুরো জাতির জন্যেই শ্লাঘার বিষয়। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল্যায়ন-পর্যালোচনায় কোভিড মোকাবিলায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শীর্ষস্থানে। মা-মাটি-মানুষের নেত্রী শেখ হাসিনা গত ঈদে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন চব্বিশ শত টাকা করে নগদ। ১৩ জুলাই ঘোষণা করেছেন তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া শ্রমিকরা আড়াই হাজার টাকা করে পাবেন। শুধু তাই নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই বিভিন্ন লাইভ অনুষ্ঠানে করোনা বিধিনিষেধ মানার নির্দেশনা প্রদান করেন। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার জনকল্যাণে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যখন গার্মেন্টেস খুলে দেয়া হলো, তখন সমালোচনার ঝড় বয়েছিল। বলা হয়েছিল, গার্মেন্টসে করোনার চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের সকল আশঙ্কা অমূলক ও প্রলাপ প্রমাণিত করে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব করোনা মোকাবিলায় যে সক্ষমতার পরিচয় দেন, তা ভাবীকালের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই সিদ্ধান্ত যে কত দূরদর্শী ও সুদূরপ্রসারী ছিল, তা বর্তমান বাস্তবতায় জাজ্বল্যমান। গার্মেন্টস খুলে দেয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক গতি-প্রবাহ সঞ্চালনের সে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিল, তা সঠিক ও যথার্থ ইতিবাচক হিসেবে আজ প্রমাণিত। কেননা, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি প্রধান ক্ষেত্র গার্মেন্টস সেক্টর। যখন করোনায় লকডাউনে সবকিছুই স্তব্ধ, নিথর, তখনও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ ছিল অটুট, অক্ষুণ্ণ। তাই দেশে কোন খাদ্যাভাব হয়নি। একজন মানুষও না খেয়ে মরেনি। সেটি অবশ্যই শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব। অতএব, বলার জন্য বলা বা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে সর্বগ্রাসী বৈশ্বিক অতিমারী মোকাবিলায় সবাই ইতিবাচক হই, সবাই মেনে চলি স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ। লেখক : সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×