ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি আর নয়

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ১৮ জুলাই ২০২১

রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি আর নয়

পুরান ঢাকার নিমতলী ট্র্যাজিডির শোক ভুলতে না ভুলতেই কয়েক বছর পর চুড়িহাট্টা ট্র্যাজিডি সবার মনে বিষাদের দাগ কাটে। এক বছর পর তাজরীন এবং সর্বশেষ রূপগঞ্জের সেজান জুসের হাসেম ফুডস লিমিটেডের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড নতুন ট্র্যাজিডির জন্ম দিয়েছে। সব ঘটনাই আগুনকেন্দ্রিক। বরাবরের মতোই প্রশ্ন উঠেছে- ব্যাপক শ্রমিকনির্ভর এসব প্রতিষ্ঠানে কেন বারবার আগুন লাগে? সেই আগুন আবার নেভাতে কেন এত সময় লাগে? যে সময়ের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানেরই কর্মীরা পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। শ্রমিকের পোড়াদেহ পড়ে থাকে তারই কর্মস্থলের ইট-পাথরের শক্ত ফ্লোরে। উৎকট গন্ধে ভারি হয়ে ওঠে অকুস্থল ও এর আশপাশ। এক সময় বাতাসে তা ছড়িয়ে পড়ে, মানব হত্যার নির্মমতার কথা বলতে থাকে। সদ্য আগুনের ভয়াবহতায় মারা গেছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস লিমিটেডের ৫২ জন শ্রমিক। যাদের বেশিরভাগই নারী এবং শিশু। জানা গেছে, কারখানায় অতিরিক্ত কেমিক্যালের ব্যবহার ও গেটে তালা না খোলাই কাল হয় সেইসব হতভাগ্য শ্রমিকের। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট প্রায় ৪০ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এখনও লাশের অপেক্ষায় নিহতদের স্বজনরা। নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে অন্তত ৬১ জন। উদ্ধার হওয়া লাশগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চেনার উপায় নেই। স্বজনরা চাইলেও লাশ দেখে শনাক্ত করতে পারবেন না। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। এজন্য আরও কমপক্ষে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ। এদিকে আগুনে নিহতের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় হাসেম ফুডসের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের সবাইকে চারদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) জিল্লুর রহমান বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হওয়া ভবনটিতে ত্রæটি ছিল। ভবন নির্মাণে মানা হয়নি কোন নির্দেশনা। এছাড়া ভবনে পর্যাপ্ত কোন ফায়ার এক্সিট পয়েন্ট ছিল না। ছিল না কোন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। আমরা আগুন নেভানো শেষে কয়েকটি ফ্লোর তালাবদ্ধ অবস্থা দেখতে পেয়েছি। তারা বলেছেন, রূপগঞ্জের ওই ভবনে প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, কার্টনসহ প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এগুলোর কারণ হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত ত্রæটির অভিযোগ ওঠে। তাছাড়া পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার পাশাপাশি শ্রমিকদের ভবন থেকে বের হতে দেয়া হয় না। তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান অনেকে। অভিযোগ রয়েছে, আগুন লাগার পরপরই কারখানার তৃতীয়তলার ফটকে তালা মেরে দেয়া হয়েছিল। একই অভিযোগ উঠেছে রূপগঞ্জে সেজান জুসের কারখানা হাসেম বেভারেজের আগুনের ঘটনাতে। শ্রমিকরা বলছেন, আগুন থেকে বাঁচার জন্য ভবনের ছাদে উঠতে গিয়ে সিঁড়ির গেটে তালা দেখেছেন তারা। বাঁচার পথ না করে দিয়ে উল্টো একটি ঘরে শ্রমিকদের তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগ করেছে কারখানার একজন শিশু শ্রমিক। তাজরীন আর হাসেম বেভারেজের দৃশ্যগুলো প্রায় একইরকম। তাজরীন ভবন ছিল নয়তলা। হাসেম বেভারেজ লিমিটেডের কারখানাটি ছয়তলা। তাজরীন ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর তৃতীয়তলার মূল ফটকে তালা মেরে দেয়া হয়। ফলে সেখান থেকে লোকজন বের হতে পারেনি। একই ঘটনা ঘটেছে রূপগঞ্জেও। এমন তালা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় প্রতি ফ্লোরেই মারা থাকে। কোন্ যুক্তিতে আগুন লাগলেই তারা তালা মেরে দেন? এ প্রহসনের ঐতিহ্য আর কতদিন চলবে আমরা জানি না। দ্রæত এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশ জারি হওয়া উচিত। এক পরিসখ্যানে দেখা যায়, গত ১০ বছরে বিভিন্ন ধরনের ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ১৬শ’ জন। সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ১২৪ জন। ২০১২ সালে সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ১১১ জন। ২০১৬ সালে টঙ্গীর টাম্পাকো ফুয়েলস কারখানার অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৪১ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রæয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ৭১ জন। কিন্তু ওই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। দুই বছর ধরে ঝুলে আছে ঘটনার তদন্ত। তাজরীন ফ্যাশনে আগুনে শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনায় করা মামলার বিচার হয়নি নয় বছরেও। ২০১৬ সালের টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় টাম্পাকো ফুয়েলস কারখানায় আগুনের মামলার অগ্রগতি জানে না পুলিশ। ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান মতে গত ছয় বছরে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৭৯৫ জন শ্রমিক। রূপগঞ্জের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেছেন, কারখানাটির আগুনের ঘটনায় সরকারের কোন সংস্থা বা মালিকপক্ষের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আলোচিত আগুন দুর্ঘটনার পর কারও সাজা হওয়ার ঘটনা বিরল। মামলা চলে বছরের পর বছর। কোন কোন ক্ষেত্রে মামলা পর্যন্ত করা হয় না। আবার অনেক দুর্ঘটনার পর কারখানাই বন্ধ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার কোন বিচার হয় না। তাজরীন ফ্যাশনের ঘটনায় করা মামলায় জামিনে মুক্ত আছেন কারখানা মালিক দেলোয়ার হোসেন। বেঁচে ফেরা অনেক শ্রমিক আজও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মামলার নিষ্পত্তি বিষয়টি এখনও তাদের কাছে অজানা। টঙ্গীর টাম্পাকো ফুয়েলস কারখানায় আগুনের ঘটনায় নিহত শ্রমিক জুয়েলের বাবা আবদুল কাদের একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টাম্পাকো মালিকসহ আট কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। মামলার পরবর্তী ঘটনাক্রম আর জানা যায়নি। আগুনে পুড়ে যারা মারা যান তাদের বড় একটি অংশ থাকে নারী এবং শিশু শ্রমিক। কোন দুর্ঘটনাতেই মালিকপক্ষ কিংবা তাদের ঘনিষ্ঠ উচ্চপদস্থদের তেমন কোন ক্ষতি হয় না, কেবল আর্থিক ক্ষতি ছাড়া। আবার সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ‘ঝুঁকি বীমা’ করে থাকেন তারা। কিন্তু তাদেরই প্রতিষ্ঠানে যে শ্রমিকরা কায়ক্লেশে খেটে যাচ্ছেন তারা মারা পড়ছেন ভবন ধসে কিংবা আগুনে পুড়ে। দুর্ঘটনা জাতপাত, গরিব-ধনী বোঝে না। তবুও আগুনে পুড়ে মরা যেন গরিবদেরই নির্মম ভাগ্যলেখা। রূপগঞ্জে কারখানায় আগুন লাগার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন (আইএলও)। তারা বাংলাদেশের সব কারখানায় জরুরীভিত্তিতে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে। বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই ঘটনায় নিহত ও আহতদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে বলা হয়, কারখানাগুলো বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়েছে কিনা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন মানা হচ্ছে কিনা তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও কারখানা মালিকদের খতিয়ে দেখা দরকার। আইনকানুন মেনে ভবন নির্মাণ ও কারখানা পরিচালনা করলে অগ্নিকাণ্ডের মতো জরুরী মুহূর্তে শ্রমিকরা নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ পাবেন। শ্রম ও কর্ম সংস্থান প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, কোন শিশু শ্রমিককে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি জানিয়েছেন, যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হবে। যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারকে ২ লাখ করে অনুদান দেয়া হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের মালিক থেকেও শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় বলেছেন, কারখানার আগুনের ঘটনায় তদন্ত হবে এবং দোষীদের বিচার হবে। এখন সেই কাক্সিক্ষত বিচারের দিকেই স্বজন হারানো শ্রমিক ও তাদের পরিবারের অসহায় মুখগুলো তাকিয়ে থাকবে। আগুন লাগার ধারাবাহিক ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। আগুনের লেলিহান শিখায় রূপ নেয়ার আগেই কোন্ প্রক্রিয়ায় দ্রæত সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যায় তার দিকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। কলকারখানা নির্মাণের অনুমতি দেয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই এসব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমানকে প্রধান করে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন শিল্পকারখানা পরিদর্শন করে আগুনসহ যে কোন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করবে। পর্যায়ক্রমে সেসব বাস্তবায়ন হলে আগামীতে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতে পারে। লেখক : সাংবাদিক
×