ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সারাদেশ ১৪ দিন সম্পূর্ণ শাটডাউনের সুপারিশ

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ২৫ জুন ২০২১

সারাদেশ ১৪ দিন সম্পূর্ণ শাটডাউনের সুপারিশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ডেল্টা ধরনের প্রভাবে বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে করোনা। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বিবেচনায় কেউ কেউ তৃতীয় বলেও এটিকে অভিহিত করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, বাংলাদেশে অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ৪০টি জেলা। এছাড়া উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ১৫টি জেলা। এমন পরিস্থিতিতে সারাদেশকে ১৪ দিন সম্পূর্ণ শাটডাউনের সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া এবং জনগণের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধে এই সুপারিশ করা হয়। এ সময় জরুরী সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস আদালত, সবকিছু বন্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লার সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে। বুধবার রাতে কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে সারাদেশে বিধিনিষেধ চলছে, যা ১৫ জুলাই পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে। এছাড়া করোনার বিস্তাররোধে ঢাকার আশপাশের সাতটি জেলায় কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে রাজধানী ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে। দেশজুড়ে ডেল্টা ধরনের কারণে আশঙ্কাজনক হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি রোধে দেশব্যাপী স্থানীয়ভাবে লকডাউনের কর্মসূচী চলছে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বর্তমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যাওয়া ঠেকানো ও জনগণের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে শাটডাউনের পরামর্শ উঠে এসেছে। কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, শাটডাউন মানে জরুরী সেবা ছাড়া সবকিছুই বন্ধ রাখার কথা বোঝানো হয়েছে। বুধবার রাতে অনুষ্ঠিত পরামর্শক কমিটির সভায় দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে উঠে আসে, দেশে বর্তমানে করোনা রোগের বিশেষ প্রজাতি ডেল্টা প্রজাতির সামাজিক সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে। দেশে ইতোমধ্যেই করোনার প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ডেল্টা প্রজাতির জীবাণু সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে সারাদেশেই উচ্চ সংক্রমণ, ৫০টির বেশি জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। রোগ প্রতিরোধের জন্য খণ্ড খণ্ড ভাবে গৃহীত কর্মসূচীর উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিশেষত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতা কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এই রোগের বিস্তৃতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এটি নিয়ে সিদ্ধান্ত আসার আগের ভারতের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতও নেয়া হয়েছে। পরামর্শক কমিটির সভায় বলা হয়েছে, ভারতের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যেসব স্থানে পরিপূর্ণ শাটডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, সেসব স্থানে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগের বিস্তার ঠেকাতে ও জনগণের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য সারাদেশে ১৪ দিনের সম্পূর্ণ শাটডাউন করতে হবে। কমিটি মনে করছে, এই ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে ব্যর্থ হলে আমাদের যতই প্রস্তুতি থাকুক না কেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে। বৈঠকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকাকরণ কর্মসূচীর উদ্যোগ নিয়েছেন। এই জন্য সভা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। এই রোগ থেকে পরিপূর্ণ মুক্তির জন্য ৮০ শতাংশের বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া বিদেশ থেকে টিকা সংগ্রহ, লাইসেন্সের মাধ্যমে দেশে টিকা উৎপাদন করা ও নিজস্ব টিকা তৈরির জন্য সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে গবেষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থনও জানানো হয়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, দেশে সংক্রমণের ২৪তম সপ্তাহে (গত এক সপ্তাহে) ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১১৪.৪ শতাংশ করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে রংপুর বিভাগ, সেখানে সংক্রমণ বেড়েছে ৮৬.৭ শতাংশ। সংস্থাটি মনে করছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪০টিই সংক্রমণের অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। বাকি ১৫টি জেলা রয়েছে উচ্চ সংক্রমণ ঝুঁকিতে। স্বাস্থ্য বিধি ও বিধিনিষেধ না মানলে দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত মঙ্গলবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১৪ থেকে ২০ জুন- এই এক সপ্তাহের নমুনা পরীক্ষা ও রোগী শনাক্তের হার বিবেচনায় এসব তথ্য জানিয়েছে তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে এই ধাপে সংক্রমণের ২৪তম সপ্তাহে সব বিভাগে নতুন শনাক্তের হার বেড়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক ১১৪.৪ শতাংশ বেড়েছে ঢাকা বিভাগে। আলোচিত সপ্তাহে ঢাকায় শনাক্ত হয়েছে আট হাজার ২১৫ জন, যা তার আগের সপ্তাহে ছিল তিন হাজার ৮৩১ জন। এরপরেই শনাক্ত বেড়েছে রংপুর বিভাগে, ৮৬.৭ শতাংশ। ওই সপ্তাহে বিভাগটিতে এক হাজার ৫৯৮ জন শনাক্ত হয়েছে, যা আগের সপ্তাহে ছিল ৮৫৬ জন। ময়মনসিংহ বিভাগে শনাক্ত বেড়েছে ৬১.৯ শতাংশ। সপ্তাহটিতে এ বিভাগে ৬৩৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৩৯১ জন। এরপর বরিশাল বিভাগে শনাক্ত বেড়েছে ৪৯.৬ শতাংশ। এ বিভাগে আগের সপ্তাহের ২২৬ জন শনাক্ত থেকে শনাক্ত বেড়ে হয়েছে ৩৩৮ জন। খুলনা বিভাগে শনাক্ত বেড়েছে ৪৯.৩ শতাংশ। এই বিভাগে করোনা শনাক্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ৪১৮ জনের, তার আগের সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছিল তিন হাজার ৬৩০ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে শনাক্ত বেড়েছে ৪২.২ শতাংশ। বিভাগে শনাক্ত হয়েছে দুই হাজার ৯৩৩ জন, যা আগের সপ্তাহে ছিল দুই হাজার ৬২ জন। এছাড়া সিলেট বিভাগে শনাক্ত বেড়েছে ২০.৬ শতাংশ। আগের সপ্তাহে এই বিভাগে শনাক্ত ছিল ৫০৫ জন, গত সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছে ৬০৯ জন। রাজশাহী বিভাগে শনাক্ত বেড়েছে ১২.৯ শতাংশ। এই বিভাগে গত সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ২ জন, তার আগের সপ্তাহে শনাক্ত ছিল চার হাজার ৪৩১ জন। ৬৪টি জেলার ৪০টিই অতি উচ্চ ঝুঁকিতে ॥ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪০টিই সংক্রমণের অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর বাইরে আরও ১৫টি জেলা আছে সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে। সংক্রমণের মধ্যম ঝুঁকিতে আছে ৮টি জেলা। বান্দরবানে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম হওয়ায় সেটি বিবেচনায় আনা হয়নি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের দশটি জেলার সবকটিই সংক্রমণের অতি উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে ছয়টি অতি উচ্চ ঝুঁকিতে, দুটি আছে উচ্চ ঝুঁকিতে। ঢাকা বিভাগের মধ্যে সাতটি জেলা আছে অতি উচ্চ ঝুঁকিতে। এই জেলাগুলো হলো গাজীপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর। রাজধানীসহ দুটি জেলা আছে উচ্চ ঝুঁকিতে, আর চারটি জেলা আছে মধ্যম ঝুঁকিতে। রংপুর বিভাগের পাঁচটি অতি উচ্চ এবং তিনটি জেলা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রামসহ ছয়টি জেলা অতি উচ্চ, তিনটি জেলা উচ্চ এবং একটি জেলা মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ। বরিশাল বিভাগে তিনটি জেলা অতি উচ্চ ঝুঁকিতে এবং মধ্যম ঝুঁকিতে তিনটি জেলা। সংক্রমণ এখনও তুলনামূলক কম সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে। বৃহস্পতিবারে খুলনা বিভাগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ২০ জন মারা গেছেন। একই সময় বিভাগে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন ৯১৭ জন। বুধবার ৩২ জনের মৃত্যু হয়। আর আক্রান্ত শনাক্ত হয় ৯০৩ জনের। অর্থাৎ গত ২৪ ঘণ্টায় আগের দিনের তুলনায় মৃত্যু কমেছে। তবে আক্রান্ত শনাক্ত বেড়েছে। এ নিয়ে বিভাগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট মারা গেলেন ৯১৬ জন। আর মোট শনাক্তের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৭৯৫ জন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৪৯১ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হলেন ৩৫ হাজার ৬৭৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি সাতজনের মৃত্যু হয়েছে কুষ্টিয়ায়। এরপর যশোরে মারা গেছেন পাঁচজন। এ ছাড়া ঝিনাইদহে তিনজন, চুয়াডাঙ্গায় ও সাতক্ষীরায় দুজন করে এবং মেহেরপুরে একজন মারা গেছেন। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে করোনায় আটজন ও উপসর্গে ১০ জন মারা গেছেন। এ পর্যন্ত এটিই একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। বুধবারও রামেক হাসপাতালে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত রামেকের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ১৮ জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে রাজশাহীর ১৩ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন ও নওগাঁর চারজন। এদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন রাজশাহীর সাতজন ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন। উপসর্গে মারা গেছেন রাজশাহীর ছয়জন ও নওগাঁর চারজন।
×