ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চেনা-শোনা

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ২৫ জুন ২০২১

চেনা-শোনা

বরেণ্য অর্থনীতিবিদ, সমাজ বিশ্লেষক, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা বিজ্ঞ মহলে বহু সমাদৃত এক ব্যক্তিত্ব। দেশীয় ঐতিহ্য, সমাজ সংস্কৃতির ধারকই শুধু নন পণ্ডিতজনের প্রতি তার অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধে এই জীবন্ত কিংবদন্তি বহুল পরিচিত এবং আদৃত। সম্প্রতি ২০২১ সালের ভাষার মাসে তার প্রবন্ধ সংকলন ‘চেনা-শোনা’ প্রকাশ করে যুক্ত প্রকাশনী। কাছ থেকে দেখেছেন, চেনার সুযোগ হয়েছে এমন সব বিশিষ্ট পণ্ডিতবর্গ নিয়ে তার অসামান্য শব্দের কারুকার্যে নির্মিত এই সংকলনের শুভ সূচনা হয় বেগম রোকেয়াকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধের উপস্থাপনায়। এক রক্ষণশীল, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও বেগম রোকেয়া কি অসম সাহসিকতায় সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে জয় করে অকুতভয় সৈনিকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হলেন তারই প্রাঞ্জল বর্ণনায় লেখক তার নান্দনিক শিল্পসত্তাকে উৎসারিত করলেন তাও যেন এক অনন্য কলমযোদ্ধার অবিস্মরণীয় দ্যোতনা। দ্রোহের মনস্তত্ত¡ অন্তরে ধারণ করে কি মাত্রায় বৈপ্লবিক চেতনায় সমকালের জরাজীর্ণ অবয়বকে ঠাণ্ডা মাথায় আঘাত করেছেন, তারই একটি সুসংহত রূপরেখা এই সমৃদ্ধ আলোখ্যটি। ‘রোকেয়া ও আমরা’ প্রবন্ধটিতে রোকেয়ার তেজোদীপ্ত বার্তা এবং নারীশিক্ষার অভিযান শুরু হয়েও আজও শেষ হতে পারেনি এমন আক্ষেপেই লেখকের শেষ গন্তব্য। বাংলাদেশে আরও অনেক প্রথিতযশা স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লেখকের যে মনন সত্তার উৎসরণ তাও এই প্রবন্ধ সংকলনের সাবলিল শব্দের অনন্য কারুকার্য। সত্যিই শব্দের নান্দনিক শিল্পী তো বটেই। শব্দের কোন কাঠিন্য নেই বাক্য গঠনের দুর্বোধ্যতা ব্যতিরেকে সহজ সবল ভাষায় অসাধারণ মনন শৌর্র্য অভিভ‚ত হওয়ার মতোই। অধ্যাপক অমিয় কুমার দাশগুপ্ত একজন যশস্বী অর্থনীতি বিশারদই শুধু নন পণ্ডিত, বিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের মর্যাদায়ও সমাসীন। তাকে নিয়ে লেখকের অন্তর নিঃসৃত শ্রদ্ধা, যৌক্তিক আলোচনা এবং অসাধারণ শিক্ষকের মর্যাদায় অর্ঘ্য নিবেদন করা যেন বিশিষ্ট জনের আরেক এক জ্ঞানী ব্যক্তিত্বের প্রতি প্রণতি জানানো। করোনাকালে প্রয়াত ড. আনিসুজ্জামানকে নিয়ে লেখা ‘এক ও অদ্বিতীয় আনিসুজ্জামান’ প্রবন্ধে জাতির এই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে চেনার সুযোগ হয় ভাষা আন্দোলনের তিন বছর পরেই। শুনেছেন বালক বয়সেই আনিসুজ্জামান ১৯৪৮ সালের ভাষার প্রশ্নে উত্তাল সময় থেকেই সমর্পিত এক সম্মুখযোদ্ধা। সে স্বপ্নের নায়ককে চেতনায় লালন করার কথা ওঠে আসে লেখকের অনবদ্য শব্দমালায়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সহযোদ্ধা কিশোর আনিসুজ্জামানের প্রতি যে নিবেদন লেখকের সেটা শেষ অবধি অক্ষুণœই ছিল প্রবন্ধের সারবত্তায় তেমন চিত্রও পাঠককে মুগ্ধ করে। ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের ওপর সনৎকুমার সাহার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনাও পাঠকদের নজর কাড়ে। ভাষা আন্দোলনের প্রধান নায়কদের অন্যতম এই ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক। অনেকেই কালের অনধিগম্যতায় তেমন মাহাত্ম্য থেকে ছিটকে পড়লেও আহমদ রফিক আপন ঐতিহ্যিক ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ হয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটের লড়াইয়ে নিজেকে উৎসর্গ করতে দ্বিধাহীন ছিলেন। তেমন সমৃদ্ধ চেতনায় আজও লেখকের দৃষ্টি এই ভাষা সংগ্রামী অকৃত্রিম যোদ্ধার ভ‚মিকায় অনমনীয় ব্যক্তিত্বের প্রতি। খ্যাতিমান রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ও বিশেষজ্ঞ সানজিদা খাতুনকে ঘিরে নিজের অনুভ‚তি ব্যক্ত করেছেন এই রবীন্দ্রবোদ্ধা। বাঙালীর সঙ্গীত ভুবনে আর এক ঐশ্বর্যমণ্ডিত নান্দনিক শিল্পী এই রবীন্দ্রানুরাগী সানজিদা খাতুন। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় লেখক এই বরেণ্য কণ্ঠযোদ্ধাকে যে মাত্রায় অভিষিক্ত করেন তা যেমন অনবদ্য একইভাবে এক শৈল্পিক সত্তার প্রতি নিবেদিত স্মৃতিও বটে। সনৎকুমার সাহা নিজেও অসাধারণ মননশিল্পীর মর্যাদায় নিজের কৃতিত্বকে ফুটিয়ে তোলেন সাবলিলভাবে। তেমন প্রাণোচ্ছল বন্দনায় সানজিদা খাতুনকে তার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেন না। প্রবন্ধটি মূলত সানজিদা খাতুনের শান্তি নিকেতনের বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে। রবীন্দ্রভক্ত এই সানজিদা খাতুন শুধু যে রবীন্দ্র সঙ্গীতে আবিষ্ট ছিলেন তা নয় বরং পুরো রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতিও ছিল তার অসামান্য দরদ এবং অর্জন করার এক উদ্দীপ্ত বাসনা। তেমন ইচ্ছাতেই শান্তি নিকেতন হয়ে উঠেছিল এক তীর্থভ‚মি। রবির ছায়ায় নিজেকে পরিপূর্ণ করা সানজিদা খাতুনকে সে আলোয় আলোকপাত করেছেন আর এক রবীন্দ্র ভক্ত, বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ সনৎকুমার সাহা। খ্যাতিমান শিক্ষক ড. গোলাম মুরশিদকে নিয়েও লিখেছেন আলোচ্য গ্রন্থের লেখক। এখানেও তার সীমাহীন উচ্ছ¡াস, পরম শ্রদ্ধামিশ্রিত আবেগ এবং বস্তু ও যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনায় গোলাম মুরশিদ সিক্ত হয়েছেন। এক নিবেদিত গবেষকের মর্যাদায় জায়গা করে দিতে তাঁকে অন্য কোন দিকে তাকাতেও হয়নি। সনৎ কুমার সাহা সেখানে এই পÐিত জ্ঞানী ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মানের আসনটুকু দিতে একেবারে অকুণ্ঠিত। গ্রন্থটি পাঠক প্রিয়তা পেয়ে যাবে। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি। নাজনীন বেগম
×