বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বৈশ্বিক সহযোগিতা আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারীকে বিশ্ব সংহতির জন্য ‘লিটমাস টেস্ট’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বকে ব্যবসা, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ পরবর্তী অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য সকলের উন্নয়নে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই সামগ্রিক বিশ^ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠতে যাওয়া বাংলাদেশের মতো দেশগুলো উত্তরণের পথে মহামারীর প্রভাবে যেন ছিটকে না পড়ে সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ সহায়তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মহামারীর পরে টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমাদের অংশীদারিত্বমূলক সমৃদ্ধির জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং সামগ্রিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রয়োজন, আমাদের এখন সামগ্রিক বৈশি^ক প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
মঙ্গলবার কাতার অর্থনৈতিক ফোরামের ভার্চুয়াল বৈঠকে দেয়া এক ভিডিও বার্তায় কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে এবং সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ‘আগামীর জন্য নতুন দিগন্ত’ শীর্ষক স্হোগান নিয়ে সোমবার শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী সম্মেলনটিতে এক শ’র অধিক বিশ^ নেতৃবৃন্দ, ক‚টনৈতিক, শিক্ষাবিদ এবং ব্যবসায়ীবৃন্দ ভিডিও বার্তা প্রদান করছেন। বøুমবার্গের সহায়তায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠান সোমবার থেকে শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে এই কঠিন সময়ে বৈশ্বিক সহযোগিতা আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে বলেন, আমরা দৃঢভাবে বিশ্বাস করি যে, কোভিড-১৯ টিকাগুলোর মালিকানা বিশ্ববাসী সবার হওয়া উচিত। উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর যাদের সক্ষমতা রয়েছে, তাদের এই টিকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া উচিত।
কাতার ইকোনমিক ফোরামে দেয়া প্রদত্ত ভার্চুয়াল ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মহামারী পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ছয়টি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্য অর্জনে আরও উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ডিজিটাল বিভাজন এড়াতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ওপর জোর দেন।
তার ভাষণে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান আন্তর্জাতিক সমৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য, ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব নিরসনে অবিলম্বে সম্মিলিত ও সামগ্রিক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। বিশ্ব বাণিজ্য ও রফতানি আয় আগের অবস্থায় ফেরাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে সেসব ক্ষেত্রে সহায়তা দেয়ার কথা বলেন। একইসঙ্গে মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থা ফেরাতে কাতারসহ মাধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকার, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশগুলোকে অবশ্যই ডিজিটাল বিভাজন বন্ধ করার জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের সার্থকতা অর্জন করতে হবে এবং মহামারীজনিত কারণে যে কোন সম্ভাব্য চ্যুতি প্রতিরোধে গ্র্যাজুয়েশন প্রাপ্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য নতুন আন্তর্জাতিক সহায়তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি অভিমত দেন যে, এই অঞ্চলে আয়োজক দেশ, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী হিসাবে তুলে ধরা অভিবাসী শ্রমিকদের পুনরায় একত্রীকরণ পরিকল্পনায় অবদান রাখতে হবে।
বিশ্ব সংহতির জন্য কোভিড-১৯ মহামারীকে লিটমাস টেস্ট আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, যেহেতু এতে ইতোমধ্যে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এবং অর্থনীতিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, তাই ‘এজেন্ডা ২০৩০’, ‘প্যারিস চুক্তি’ এবং ‘আদ্দিস আবাবা এ্যাকশন এজেন্ডা’ সঙ্কট উত্তরণের বøু-প্রিন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে।
তিনি বলেন, কাতার ইকোনমিক ফোরাম আমাদের সুযোগগুলো শনাক্ত করার জন্য এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধারণা এবং সমাধানগুলো ভাগ করে নিতে এবং ভবিষ্যতের সঙ্কটগুলো দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করেছে।
মহামারীবিরোধী লড়াইয়ের বাংলাদেশের ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে আন্তর্জাতিক এই ফোরামে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে, কেন না তার সরকার এ পর্যন্ত ১৫ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। মহামারী থাকা সত্তে¡ও ২০২০-২০১২ সালে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্প দেশটিকে কোভিড-১৯ পরবর্তী নতুন বাণিজ্য এবং কাজের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহযোগিতা করেছে। তিনি কাতার এবং অন্যান্য মধ্য-প্রাচ্যের দেশগুলোর সরকারী ও বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে, আইসিটি, নবায়ণযোগ্য জ্বালানি, হালকা প্রকৌশল, ওষুধ শিল্প এবং কৃষিজাত পণ্য খাতে চমৎকার বিনিয়োগের সুযোগ গ্রহণ করার আহŸান জানান। কেননা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকার বিস্তৃত পরিসরে প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বিশ্বজুড়ে জনবহুলতা, বিশ্ব-বিরোধী মনোভাব এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষাবাদের বিরুদ্ধে বহুত্ববাদকে শক্তিশালী করার জন্য একসঙ্গে দাঁড়ানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করে বলেন, বিশ্বজুড়ে দেশগুলোয় এবং বিশে^র সকল জায়গায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা দরকার, কারণ এগুলো অর্থনৈতিক কার্যক্রম স¤প্রসারণের পূর্বশর্ত।