ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চক্রের ৭ জন গ্রেফতার

ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে নারী পাচার করত নদী

প্রকাশিত: ২২:৫০, ২৩ জুন ২০২১

ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে নারী পাচার করত নদী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের অন্যতম হোতা মডেল নদী আক্তার ইতি ওরফে জয়া আক্তার জান্নাত ওরফে নূর জাহান (২৮) ১০টি নাম ব্যবহার করে ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাইতে নারী পাচার করত। মূলত ওই নারী তিন দেশে নারী পাচারে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে। পাচারের কৌশল হিসেবে একেক সময় একেক নাম ব্যবহার করা হতো। এই নদী ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশী তরুণী নির্যাতনের ঘটনায় বহুল আলোচিত টিকটক হৃদয় বাবুর প্রধান নারী সহযোগী হিসেবে কাজ করত। সোমবার নদীসহ মানবপাচার চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত অন্যরা হচ্ছে, আল আমিন হোসেন (২৮), সাইফুল ইসলাম (২৮), আমিরুল ইসলাম (৩০), পলক মণ্ডল (২৬), তরিকুল ইসলাম (২৬) ও বিনাশ শিকদার (৩৩)। এ সময় তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট, ভারতের আধার কার্ড, মোবাইল ফোন, ভারতের সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে গ্রেফতারকৃতদের চারদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মঙ্গলবার সকালে নিজ কার্যালয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোঃ শহিদুল্লাহ এসব কথা বলেন। ডিসি জানান, সম্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশী তরুণী নির্যাতনের ঘটনায় আলোচনায় আসা ‘টিকটক হৃদয় বাবুর’ প্রধান নারী পাচারকারী নদী আক্তার ইতিসহ সাতজনকে গ্রেফতর করা হয়। সোমবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যশোরের শার্শা থানার পাঁচভ‚লট, বেনাপোল থানার পুটখালি এবং নড়াইল শহরের ডহর রামসিদ্দি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তিনি জানান, ভারতে নারী পাচারকারী টিকটক হৃদয় বাবুর সঙ্গে গ্রেফতারকৃত নদীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তারা দীর্ঘদিন ধরে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত। নদী শুধু ভারতে নয়, মালয়েশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতেও নারী পাচারের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে। গ্রেফতারকৃত এই চক্রটির সঙ্গে ভারতে গ্রেফতারকৃত ‘হৃদয় বাবু’ ও ‘সাগরদের’ ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোঃ শহিদুল্লাহ জানান, এক নারীকে তার স্বামী ৪০ হাজার টাকায় এই নদীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশের এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনায় ভারতের বেঙ্গালুর পুলিশ ঢাকা মগবাজারের ‘টিকটক হৃদয় বাবু’সহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে। পরে ভারত থেকে পালিয়ে আসা এক নারী রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করে। এরপরই পুলিশ তদন্তে মাঠে নামে। পরে পুলিশ ও র‌্যাব কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। ডিসি শহিদুল্লাহ জানান, এ ঘটনা উদঘাটনের পর একাধিক নারী ভারত থেকে পালিয়ে এসে মামলা করেন। একের পর এক বেরিয়ে আসে নারী পাচারের ঘটনা। পাচারকারী হিসেবে উঠে আসে আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী নদীর নাম। মোঃ শহিদুল্লাহ জানান, পাচারের উদ্দেশে আনা মেয়েদের যশোর সীমান্তে বিভিন্ন বাড়িতে রেখে সুযোগমতো ভারতে পাচার করত চক্রটি। পাচার করা প্রত্যেক মেয়ের জন্য স্থানীয় এক ইউপি সদস্যকে এক হাজার টাকা করে দেয়া হতো। পাচারকালে কোন মেয়ে বিজিবির কাছে আটক হলে সেই ইউপি সদস্য আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসত। ডিসি জানান, ২০০৫ সালে শীর্ষ সন্ত্রাসী রাজীব হোসেনের সঙ্গে নদীর বিয়ে হয়। ২০১৫ সালে রাজীব বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এরপর থেকেই নদী পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পাচার করা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নদীর দশটির মতো নাম পাওয়া যায়। নদী ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের নারী পাচার চক্রের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে। পাচার নারীদের কাছে তিনি নিজেকে নদী নামে পরিচয় দিলেও ভারতে সবাই তাকে ইতি নামে চেনেন। ভারতীয় আধার কার্ডে তার নাম জয়া আক্তার জান্নাত। বাংলাদেশী পাসপোর্টে নুর জাহান, সাতক্ষীরা সীমান্তে জলি আর যশোর সীমান্তে তিনি প্রীতি নামে পরিচিত। তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার জানান, গ্রেফতারকৃত আল আমিন হোসেন ২০২০ সালে ঈদ-উল-আজহার চারদিন পর নারী পাচার করতে গিয়ে বিএসএফ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়। পাচারের উদ্দেশে আনা মেয়েদের সীমান্তে তার বাড়িতে রেখে সুযোগমতো ভারতে পাঠানো হতো। নারী পাচারে সহায়তাকারী ওই ইউপি সদস্যের নামে যশোরের শার্শা থানায় দুটি মাদক মামলা রয়েছে। ডিসি শহীদুল্লাহ জানান, গ্রেফতারকৃত সাইফুল ইসলামের শর্শার পাঁচভুলট বাজারে মোবাইল রিচার্জ ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা আছে। মানব পাচারে জড়িত ই¯্রাফিল হোসেন খোকন, আব্দুল হাই, সবুজ, আল আমিন ও একজন ইউপি সদস্য তার মাধ্যমে মানবপাচার থেকে অর্জিত অর্থ বিকাশে লেনদেন করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলে সে মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের সতর্ক করে। বিকাশ ট্রানজেকশনে ব্যবহৃত মোবাইলটি জব্দ করা হয়েছে। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত পলক মণ্ডল যশোরের মনিরামপুর ঢাকুরিয়া স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গাহঘাটা থানার নলকড়া গ্রামে নানা বাড়িতে যায়। সেখানে পঞ্চগ্রাম স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক পাস করে। পরে ইঅগঝ (ইধপযবষড়ৎ ড়ভ অুঁৎাবফরপ গবফরপরহব ধহফ ঝঁৎমবৎু) ডিগ্রী নিয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শুরু করে। বেনাপোলের ই¯্র্রাফিল হোসেন খোকন, ভারতে অবস্থানকারী বকুল ওরফে খোকন, তাসলিমা ওরফে বিউটি ও চক্রের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নিতে আসা গ্রাম্যদরিদ্র মেয়েদের ব্যাঙ্গালুরে তাসলিমা ওরফে বিউটি নামে একজনের কাছে পাঠানোর মাধ্যমে নারী পাচারের হাতেখড়ি। পরে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা মেয়েদের আধার কার্ড প্রস্তুত করে দেয়ার পাশাপাশি নিরাপদ ‘সেফ হোম’ এ অবস্থান এবং ব্যাঙ্গালুরে নির্ধারিত স্থানে পাঠানোর দায়িত্ব নেয়। মোঃ শহিদুল্লাহ বলেন, এছাড়াও তিনি (পলক) ভারতীয় আধার কার্ড ও ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ডধারী। উত্তর প্রদেশের গোরাক্ষপুর জেলার বড়ালগঞ্জ থানার নেওয়াদা গ্রামেও থেকেছে। তার কাছ থেকে ভারতীয় আধার কার্ড, আইডি কার্ড, ভারতীয় আয়কর বিভাগ দেয়া আইডি কার্ড, সিম কার্ড ও একজন ভিকটিমের আধার কার্ড জব্দ করা হয়েছে। পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারকৃত বিনাশ সিকদার নড়াইলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তিনি বেনাপোলে বাসা ভাড়া নিয়ে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করেন। তার স্ত্রী সোনালী সিকদার ভারতীয় নাগরিক। বেনাপোলে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করতে গিয়ে ই¯্রাফিল হোসেন খোকন, আব্দুল হাই সবুজ ও মানবপাচারে জড়িত আরও কয়েকজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয়ের সূত্রধরে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েন বিনাশ সিকদার। যশোর ও নড়াইল থেকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে উচ্চ বেতনে চাকরি বা প্রলোভন দেখিয়ে আনা নারীদের ই¯্রাফিল হোসেন খোকন, আল আমিন, তরিকুল, আমিরুল ও আরও কয়েকজনের মাধ্যমে সীমান্ত পার করে ভারতীয় দালালদের কাছে পৌঁছে দেয়। তার কাছ থেকে বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা ভারতীয় পরিচয়পত্র কীভাবে তৈরি করছে এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি শহীদুল্লাহ জানান, এগুলো তৈরিতে ভারতীয় লোকেরা সহায়তা করেছে। গ্রেফতারকৃতরা কতজনকে ভারতে পাচার করেছে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেফতার করেছি। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বিস্তারিত সব জানতে পারব। হৃদয় বাবুসহ আরও দু’একজনের সঙ্গেও নদীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং পরস্পর যোগসাজশে পাচার করেছে। ভারতে যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে ওই ভিডিওর সঙ্গে নদীর সম্পৃক্ততা কতটুকু ? এ বিষয়ে তেজগাঁও ডিসি বলেন, টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে যেহেতু নদীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেহেতু ওই ভিডিওর সঙ্গেও নদীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। মানবপাচার মামলায় মডেল নদীসহ সাত-চারজন রিমান্ডে ॥ মানবপাচার আইনে করা মামলায় আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্রের অন্যতম হোতা গ্রেফতারকৃত মডেল নদী আক্তার ইতি ওরফে জয়া আক্তার জান্নাত ওরফে নূরজাহানসহ (২৮) সাতজনকে চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রিমান্ডকৃত অন্যরা হচ্ছে, মোঃ আল-আমিন হোসেন (২৮), মোঃ সাইফুল ইসলাম (২৮), আমিরুল ইসলাম (৩০), পলক মণ্ডল (২৬), মোঃ তরিকুল ইসলাম (২৬) ও বিনাশ শিকদার (৩৩)। মঙ্গলবার তাদের ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুক তাদের ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা আক্তার প্রত্যেকের চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশ বলছে, পাচারকারীদের হাতে পড়েছেন এমন বেশ কয়েকজন এরইমধ্যে জানিয়েছেন নদীর মাধ্যমে ভারতে চাকরির অফার পেয়েছিলেন তারা। সেখানে গিয়ে তারা বুঝতে পারেন তাদের বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এই চক্রে নদী বড় ভ‚মিকা রেখেছেন।
×