ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২৩ জুন ২০২১

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ ও রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা। সারাদেশের মতো রাজধানীতে নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৮৪৬ জন। নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে ১৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ হারে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা গত দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সারাদেশের মতো মঙ্গলবার ঢাকা বিভাগেও করোনা রোগীর শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৬১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর কোভিড হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকার বাইরের বিশেষ করে সীমান্তের জেলাগুলোর হাসপাতালগুলোতে শয্যার তুলনায় রোগী সংখ্যা বেশি। রাজধানীতে রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালগুলোতে সাধারণ ও আইসিইউয়ের বেডে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রাজশাহী, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বেডের চেয়ে রোগী সংখ্যা বেশি। আশঙ্কার বিষয় চিকিৎসার জন্য আত্মীয় স্বজনদের ভিড়ের কারণে মূলত হাসপাতালগুলোই এখন করোনার হটস্পটে পরিণত হয়েছে। গত ২০২০ সালের প্রথম ঢেউয়ে করোনা শহরকেন্দ্রিক হলেও এবার গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার কারণে চিকিৎসা ও পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন অনেকেই। তাদের মাধ্যমেই বেশি করোনা সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গত ২৪ ঘণ্টায় ৭৬ সহ করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজার ৭০২ জনের। নতুন শনাক্ত হওয়া ৪ হাজার ৮৪৬ রোগীসহ মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮ লাখ ৬১ হাজার ১৫০ জনে। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনামুক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯০৩ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৬ লাখ ৬১ হাজার ১৫০ জন। ২৪ ঘণ্টায় ২৫ হাজার ৩৩৮ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষা করা হয়েছে ২৫ হাজার ২৮টি। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। দেশে এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৬৩ লাখ ৭৬ হাজার ৮১৯টি। মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ৭৬ জনের মধ্যে ২৭ জন খুলনার। এছাড়া ঢাকায় ১৪, চট্টগ্রামে ১০, রাজশাহীতে ১৪, সিলেটে ৩, রংপুরে ৬ ও বরিশালে ২ জন মারা গেছেন। মারা যাওয়াদের মধ্যে ৪২ জন পুরুষ এবং ৩৪ জন নারী। এদের মধ্যে ৪ জন বাসায় মারা গেছেন। বাকিরা হাসপাতালে মারা গেছেন। এ পর্যন্ত ভাইরাসটিতে মোট মারা যাওয়া ১৩ হাজার ৭০২ জনের মধ্যে পুরুষ ৯ হাজার ৮১০ জন এবং নারী ৩ হাজার ৮৯২ জন। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ৩৭ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের ২৩, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ৭, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৮ এবং ২১ থেকে ৩০ বছরের ১ জন রয়েছেন। রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে আইসিইতে রোগী বাড়ছে ॥ গত দেড় মাস ধরে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কম থাকলেও ধীরে ধীরে সাধারণ বেড ও আইসিইউতে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ বেডের বিপরীতে কোন সিট ফাঁকা ছিল না। একইভাবে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৪টি বেডের ২৩টিতে রোগী ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ইউনিট-২) ও বার্ন ইউনিটের কোন আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ২টি বেড ফাঁকা ছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে ১৫টি বেডের বিপরীতে ৭টি বেড ফাঁকা রয়েছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মোট ১০টি বেডের বিপরীতে মোট ২টি বেড ফাঁকা রয়েছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মোট ১০টির বিপরীতে মোট ৭টি বেড ফাঁকা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ২৪টি বেডের বিপরীতে মোট ৪টি বেড ফাঁকা রয়েছে। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারী হাসপাতালে মোট ২৬টির বিপরীতে মোট ১৭টি বেড ফাঁকা রয়েছে। এছাড়া ২৫০ বেড শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল মহাখালীতে ১৬টির বিপরীতে মোট ১০টি বেড ফাঁকা রয়েছে। রাজধানীর সরকারী কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে মোট ২১২টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ১৩৪টি বেড ফাঁকা ছিল। এছাড়া ৩৪৫৫টি সাধারণ বেডের বিপরীতে ফাঁকা রয়েছে ২২৬১টি বেড। ঢাকা বিভাগে রোগী বাড়ছে ॥ গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগে মোট ১৪৯৬ রোগী শনাক্ত হয়েছে। নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ। টাঙ্গাইল জেলায় ৩৩৫টি নমুনার বিপরীতে মোট ১২১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। মোট শনাক্তের হার ৩৬ দশমিক ১১ শতাংশ। ফরিদপুর জেলায় ২৮২টি নমুনার বিপরীতে মোট ১১৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন, মোট শনাক্তের হার দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ১৩ শতাংশ। মাদারীপুরে ৮১টি নমুনার বিপরীতে ৩৩ জন শনাক্ত হয়েছে, শনাক্তের হার ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে শনাক্ত বেড়েছে ॥ রাজশাহী বিভাগে মোট ৩৯১৩টি নমুনা পরীক্ষা করে মোট ৭৬৩ রোগী শনাক্ত হয়। রোগী শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে হটস্পট নামে খ্যাত রাজশাহী জেলায়। সেখানে মোট ১৬৬৯টি নমুনা পরীক্ষা করে মোট ৩২৬ রোগী শনাক্ত হয়। রোগী শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। রংপুর বিভাগের মোট শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বিভাগে মোট ৭৪৬টি নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে মোট ২৫৮ রোগী শনাক্ত হয়। দিনাজপুরে সর্বোচ্চ ১১০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। রোগী শনাক্তের হার ৪৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ৫৩২ জন রোগী নতুন শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। খুলনা বিভাগে মৃত্যু বাড়ছে ॥ গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিভাগে মৃত্যু হয়েছে আরও ২৭ জনের। এই সময়ের মধ্যে বিভাগে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৯৯৮ জনের। শনাক্তের হার ৪৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দফতর সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনায় ৯ জন, কুষ্টিয়ায় ৫ জন, যশোরে ৪ জন, বাগেরহাটে ৪ জন এবং নড়াইলে ৩ জন এবং মেহেরপুরে ২ জন মারা গেছেন। খুলনা বিভাগের মধ্যে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় চুয়াডাঙ্গায় গত বছরের ১৯ মার্চ। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় মোট শনাক্ত হয়েছে ৪৬ হাজার ৯৭৫ জন। আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৬৪ জনে। এ সময় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩৪ হাজার ৯৪৮ জন। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের জেলাভিত্তিক করোনা সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, খুলনায় ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৯ জন এবং শনাক্ত হয়েছে ২৬৮ জন। জেলায় এ পর্যন্ত মোট করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৩ হাজার ২৬৪ জনের। মারা গেছেন ২২০ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ১০ হাজার ১৬৩ জন। বাগেরহাটে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৫৬ জনের। সাতক্ষীরায় ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছে ৮৬ জন। যশোরে গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে ২৫৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় নড়াইলে শনাক্ত হয়েছে ৪২ জন। মাগুরায় ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে ১৬ জন। ঝিনাইদহে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে ৩০ জন। ২৪ ঘণ্টায় কুষ্টিয়ায় শনাক্ত হয়েছে ১১৯ জন। চুয়াডাঙ্গায় ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে ৮২ জন। মেহেরপুরে শনাক্ত হয়েছে ৪৬ জন। বরিশাল বিভাগে মোট ৭১ জন রোগী শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ময়মনসিংহ বিভাগে শনাক্তের হার ছিল ১৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এছাড়া সিলেট বিভাগে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদÐ অনুযায়ী, কোন দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা, তা বোঝার একটি নির্দেশক হলো রোগী শনাক্তের হার। কোন দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখা দেয়। পরে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। গত বছরের শেষ দিকে এসে সংক্রমণ কমতে থাকে। দেশে এ বছরের মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় ৫ এপ্রিল থেকে সাত দিনের জন্য গণপরিবহন চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। পরে তা আরও দুই দিন বাড়ানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আরও কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হয়। পরে তা আরও বাড়িয়ে ১৫ জুলাই পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু দেশে এখন সংক্রমণ পরিস্থিতি এপ্রিলের মতো ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। ভারত সীমান্তবর্তী ১৫টি জেলায় রোগী দ্রæত বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে রাজধানী ঢাকাকে সারা দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঢাকার আশপাশের চারটি জেলাসহ মোট সাতটি জেলায় জরুরী সেবা ছাড়া সব ধরনের চলাচল ও কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে শুরু হয়ে চলবে ৩০ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত। এই সাত জেলা হলো মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ।
×