ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনী লিখতে গিয়ে সিলভিয়া টের পেলেন নানার জীবনের রয়েছে এক অন্ধকার ইতিহাস

প্রকাশিত: ১২:৪৬, ২২ জুন ২০২১

জীবনী লিখতে গিয়ে সিলভিয়া টের পেলেন নানার জীবনের রয়েছে এক অন্ধকার ইতিহাস

অনলাইন ডেস্ক ॥ সিলভিয়া ফোটির সাথে তারা নানার কখনই দেখা হয়নি। অনেক লিথুয়ানিয়ানের কাছে ইওনাস নোরিকা একজন জাতীয় বীর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যিনি সোভিয়েত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সিলভিয়ার জন্মের আগেই তিনি মারা যান। শিকাগোর বাসিন্দা লেখক সিলভিয়া ফোটি দশকের পর দশক ধরে শুনে এসেছেন যে তার নানা দেশকে রক্ষার জন্য বীরত্বপূর্ণ সব কাজ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা সিলভিয়া ফোটি তার নানার বীরত্ব এবং নিজের লিথুয়ানিয়ান পরিচয় নিয়ে সবসময় গর্ব অনুভব করেছেন। তার মা এবং নানী তাকে বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত থেকে লিথুয়ানিয়াকে রক্ষা করার সময় ১৯৪৭ সালে তার নানাকে হত্যা করা হয়। ইওনাস নোরিকার নামে লিথুয়ানিয়ার রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে, অনেক স্কুলের নাম করা হয়েছে তার নামে। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার নামে ফলক বসানো হয়েছে অনেক জায়গায়।কিন্তু ইওনাস নোরিকার নামে প্রতিষ্ঠিত এক স্কুলের একজন পরিচালক একদিন কথায় কথায় সিলভিয়া ফোটিকে বলেছিলেন যে "বহু ইহুদির হত্যার জন্য তোমার নানাকে দায়ী করা হয়।" "কথাটা শুনে আমার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়েছিল। কারণ এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের কথা আমি জানতে পেরেছিলাম।" এই ব্যাপারটা যখন ঘটে সিলভিয়া ফোটির বয়স তখন ৩৮ বছর। তার মা সম্প্রতি মারা গিয়েছেন। তার নানীও প্রয়াত হয়েছেন কিছুদিন আগে। "আমি ভাবছিলাম আমার নানার জীবন নিয়ে একটা চমৎকার গল্প লিখবো। কিন্তু তার জীবনের যে একটি অন্ধকার দিক রয়েছে সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না," বিবিসি টিভি অনুষ্ঠান হার্ড-টককে তিনি বলেন। "আমার পরিকল্পনা ছিল আমার এই গল্পের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এমন একজন বীরের কাহিনী আমি সবার কাছে পৌঁছে দেব যিনি কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন।" কিন্তু স্কুলে ঐ কথাটা শোনার পর প্রথম দিকে তিনি একে 'কমিউনিস্ট প্রোপাগান্ডা' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, বলছেন সিলভিয়া ফোটি, সে কারণে বহুদিন তিনি এসব কথায় কান দেননি। ইহুদিদের পাইকারি হত্যা : "এর পরবর্তী ১০ বছর ধরে আমি নানার ওপর সব ধরনের বই, লিফলেট ইত্যাদি তথ্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি," তিনি বলছেন। এই সময়ে সিলভিয়া ফোটি ৩০-পাতার একটি দলিল খুঁজে পান যেটি তার নানা ২২-বছর বয়সে লিখেছিলেন। তিনি বলছেন, পুরো দলিল-টি ভরা ছিল ইহুদি-বিরোধী কথাবার্তায়। ঐ দলিলে ইওনাস নোরিকা লিখেছিলেন কেন সব লিথুয়ানিয়ানকে 'ইহুদিদের সবকিছু' বর্জন করতে হবে। অন্য আরো কিছু কাগজপত্রেও প্রমাণ মিলেছিল যে ইওনাস নোরিকা ছিলেন হিটলার এবং মুসোলিনির বিশাল এক ভক্ত। কিন্তু যে তথ্যটি হাতে পেয়ে সিলভিয়া ফোটি হতবাক হয়ে যান, তা থেকে তিনি জানতে পারেন যে লিথুয়ানিয়ায় ইহুদিদের পাইকারি খুনের সাথে তার নানা জড়িত ছিলেন। তবে সেসব হত্যাকাণ্ডে ইওনাস নোরিকা নিজে অংশ নিয়েছেন এমন কোন সরাসরি প্রমাণ তার নাতনী খুঁজে পাননি। এসব তথ্য হাতে পাওয়ার পর সিলভিয়া ফোটি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তার নতুন বইয়ের নাম রাখবেন 'নাৎসির নাতনী।' নাৎসি শাসনের সময় লিথুয়ানিয়ার শতকরা পঁচানব্বই শতাংশেরও বেশি ইহুদিকে খুন করা হয়। লিথুয়ানিয়ার ইহুদি সম্প্রদায় এবং বিদেশে থাকা তাদের বংশধরদের সাথে মিলে সিলভিয়া এখন আন্দোলন করছেন যাতে লিথুয়ানিয়ার জাতীয় বীরদের তালিকা থেকে তার নানার নামটি যেন কেটে দেয়া হয়। ইওনাস নোরিকার যারা সমর্থক তারা বলেন, যে সময়ে এই কাণ্ড ঘটেছে যে সময় তিনি জাতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন। সে সময় লিথুয়ানিয়ার বাসিন্দারা একদিকে নাৎসি আর অন্যদিকে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছিল। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ইওনাস নোরিকাকে নাৎসিরাও সমর্থক বলে স্বীকার করেনি। তাকে রেহাই দেয়নি। তারা তাকে আটক করেছিল এবং নির্যাতন শিবিরে বন্দি করে রেখেছিল যেখানে পরে সোভিয়েত কমিউনিস্টরা গিয়ে তাকে হত্যা করে। কিন্তু সিলভিয়া বলছেন, এমন কিছু দলিল তিনি পেয়েছেন যেখানে প্রমাণিত হয়েছে যে ইওনাস নোরিকা সোভিয়েত-বিরোধী মুক্তিযোদ্ধা গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত ছিলেন। এবং এটা করতে গিয়ে ১৯৪১ সালে তিনি নাৎসিদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। সে সময় তার বয়স ছিল ২০ বছর। সিলভিয়া বলছেন, তার নানা ইহুদিদের ঘরবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করেছিলেন, তাদেরকে জোর করে ইহুদি বস্তিতে থাকতে বাধ্য করেছিলেন এবং প্রায় ২০০০ ইহুদিকে পাইকারি ভাবে খুন করার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন এমন জোর প্রমাণ তিনি খুঁজে বের করেছেন। এক অসম্ভব বন্ধুত্ব : সবচেয়ে বড় প্রমাণ মিলেছিল ইওনাস নোরিকার সেক্রেটারির আত্মজীবনী থেকে। সেখানে তিনি লিখেছেন ২০০০ ইহুদিকে হত্যা করার আদেশ নোরিকাই দিয়েছেন। "তিনি (সেক্রেটারি) ছিলেন ঐ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী," সিলভিয়া বলছেন। সিলভিয়া যখন তার নানার দুষ্কর্মের ওপর একের পর এক প্রমাণ সংগ্রহ করে চলেছেন, তখন নিহত ইহুদিদের বংশধরেরাও এনিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। এদেরই একজন হলেন গ্র্যান্ট গোচিন। তার পরিবার লিথুয়ানিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে গিয়ে প্রাণরক্ষা করেছিলেন। গ্র্যান্ট অবশ্য বড় হয়েছেন আমেরিকায়। তিনি দাবি করছেন, তার বংশের প্রায় ১০০ জনকে ইওনাস নোরিকা খুন করেছেন। "এ নিয়ে আমার গবেষণার নথিপত্র সবই প্রকাশ করেছিলাম। একদিন আমি সিলভিয়ার কাছ থেকে একটি ইমেইল পেলাম। "প্রথম দিকে তার প্রতি আমার কোন বিশ্বাস ছিল না। সে আমাকে ফোন করলো, এবং বললো, 'আমি তোমার সব লেখা পড়েছি। কিন্তু তুমি একটা বড় ধরনের ভুল করেছো'" "আমি বললাম: মানে? সে বললো, 'আমার নানার নির্যাতনের শিকার ১০ হাজার লোকের কথা তোমার লেখায় নেই।" এর মধ্যে দিয়ে দুজনের মধ্যে শুরু হলো অসম্ভব কিন্তু গভীর এক বন্ধুত্বের। দু'জনের বন্ধুত্ব এতটাই গভীরে গিয়েছিল যে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে গ্র্যান্ট যে মামলা দায়ের করেছিলেন তাতে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন সিলভিয়া। নিদারুণ এক মানসিক আঘাত : নিজের নানার অপকর্ম সম্পর্কে জানতে পারা ছিল সিলভিয়ার জন্য নিদারুণ এক মানসিক আঘাত। তিনি স্বীকার করেন যে তার মা কিংবা নানী বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো এই বই লিখতেন না। "বইয়ের পাণ্ডুলিপি লিখছিলাম আর প্রতিনিয়ত তাদের আত্মার সঙ্গে যুক্তি-তর্ক তৈরি করছিলাম। তাদের সঙ্গে লড়ছিলাম। তারা আমার মনের মধ্যে অনবরত ঘোরাফেরা করছিল, এবং বিশ্বাস করুন কখনও কখনও আমি খুব কাঁদতাম।," বিবিসিকে সিলভিয়া জানান। "এই ঘটনা আমার লিথুয়ানিয়ান পরিচয়কে ভেঙে-চুরে একাকার করে দিয়েছে। এখন আমি ঐ পরিচয় দিতে লজ্জা পাই। এই বিভীষিকাকে আমার মেনে নিতে হয়েছে। লিথুয়ানিয়া যে এই গণহত্যায় অংশ নিয়েছে - শুধু এটাই না। তারা যে এখনও এই সত্যকে অস্বীকার করছে এর জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমাকে আতঙ্কে থাকতে হয়েছে।" সিলভিয়া অবশ্য মনে করেন, নানার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তার মা'র কোন ধারণাই ছিল না। "১৯৪১ সালে মা'র বয়স ছিল মাত্র দু'বছর। আমার মনে হয় এ নিয়ে কিছু কানাঘুষো তার কানেও এসেছিল। কিন্তু আমার মতোই, এবং অন্যান্য লিথুয়ানিয়ানের মতোই, তিনিও একে গুজব মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।" দীর্ঘদিন ধরে এই ঘটনাকে অস্বীকার করে আসার ফলেই এই বইটি লিখতে তার ২০ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে, বলছেন সিলভিয়া ফোটি। কিন্তু তিনি মনে করেন, নানীর ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। "তিনি অবশ্যই জানতেন। এবং এই সত্য যখন আমি উপলব্ধি করতে পারলাম তখন নিজেকে প্রতারিত, নিঃস্ব এবং হতাশ মনে হলো। এই কলঙ্ক নিয়ে তিনি কীভাবে বেঁচে ছিলেন? "একদিক থেকে মনে হয় এটা ভালই হয়েছে যে আমি টের পাওয়ার আগেই তিনি মারা গেছেন। সত্য ঘটনা জানার পর আমি কীভাবে তার মুখোমুখি হতাম, কিংবা কোন্ মুখ নিয়ে তিনি আমার সামনে আসতেন, তা আমার জানা নেই।" তবে বন্ধু গ্র্যান্ট গোচিন সিলভিয়ার সাহসের প্রশংসা করেন। "এটা করতে কতখানি মনের জোর থাকা দরকার সেটা ভাবতে পারেন? সত্যিই সে অসাধারণ এক মানুষ," বলছেন তিনি। হলিউডে সিনেমা তৈরি হচ্ছে এই ঘটনা নিয়ে : 'হত্যাকারীর নাতনী' আর 'নিহতের নাতী' - দুজনে এক হয়েছেন সত্য প্রকাশের লক্ষ্যে। আর এটাই হচ্ছে আপোষের সত্যি ঘটনা, বলছেন গ্র্যান্ট। সিলভিয়াও তার সাথে একমত। আর একই সুরে সুর মিলিয়েছে হলিউডও। সিলভিয়া ও গ্র্যান্টের মধ্যে এই বন্ধুত্ব নিয়ে তৈরি হচ্ছে ছায়াছবি। সিলভিয়া বলছেন, লিথুয়ানিয়ায় ইহুদি নিধন নিয়ে সিলভিয়াই সম্ভবত প্রথম কোন মানুষ যিনি তদন্ত করার কথা বলছেন। আর এটাই গ্র্যান্টের সাথে তার বন্ধুত্বের ভিত্তি। "ইহুদি নিধনযজ্ঞে নিজেদের ভূমিকার ব্যাপারটি লিথুয়ানিয়ানদের মেনে নিতে হবে। নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলবে না। এর মধ্য দিয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের হয়তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না … কিন্তু তাদের স্মৃতির প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা দেখানো হবে, যে মর্যাদা তাদের প্রাপ্য," বলছেন সিলভিয়া। তার যুক্তি হচ্ছে, তার নানা সম্পর্কে ঐ বই লিখতে গিয়ে তার ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে, "শুধু নিহতদের পরিবারের মনের ক্ষতই নয়, লিথুয়ানিয়ানদের মনের ক্ষতও উপশম করতেও এটা সাহায্য করবে।" সূত্র : বিবিসি বাংলা
×