ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাইসি জানিয়ে দিয়েছেন মিসাইল কর্মসূচী নিয়ে কোন দরকষাকষি চলবে না

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২২ জুন ২০২১

রাইসি জানিয়ে দিয়েছেন মিসাইল কর্মসূচী নিয়ে কোন দরকষাকষি চলবে না

অনলাইন ডেস্ক ॥ ইরানের সঙ্গে বিশ্বের ছয়টি শক্তিধর দেশের পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, সেখানে নতুন আশংকার ছায়া ফেলেছে ইরানে ক্ষমতার শীর্ষ পদে পরিবর্তন। ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী কট্টর রক্ষণশীল বলে পরিচিত এব্রাহিম রাইসি দায়িত্ব নেবেন আরও ছয় সপ্তাহ পর, অগাস্ট মাসে। এব্রাহিম রাইসি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেইনির বেশ ঘনিষ্ঠ এবং ইরানের সবচেয়ে রক্ষণশীল একজন নেতা হিসেবে পরিচিত। এব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর এরই মধ্যে কিছুটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই পরমাণু চুক্তি নিয়ে তার অবস্থান। নির্বাচিত হওয়ার পর সোমবার তার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনাকে তিনি স্বাগত জানান, কিন্তু এতে অবশ্যই ইরানের জাতীয় স্বার্থের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম নিয়ে কোন দরকষাকষি চলবে না। মিস্টার রাইসি বলেন, "আমরা কেবল আলোচনার স্বার্থে আলোচনা চাই না। আলোচনাকে প্রলম্বিত করা যাবে না। প্রতিটি বৈঠকের ফল হতে হবে। এখান থেকে ইরানের মানুষের জন্য একটা ফলাফল বেরিয়ে আসতে হবে।" বিবিসির ফারসি ভাষা বিভাগের বিশ্লেষক কাসরা নাজি বলছেন, প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই এব্রাহিম রাইসি যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তা দেশের ভেতরে, বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব বেশি মানুষকে আশ্বস্ত করবে বলে মনে হয় না। তিনি নিজের এমন এক ছবি তুলে ধরেছেন, যাতে বোঝা যায় একজন কট্টরপন্থী হিসেবে তার নিজের পথ ঠিক করা আছে। ইরানের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ছটি দেশ ২০১৫ সালে যে পরমাণু চুক্তি করে, সেটির লক্ষ্য ছিল, দেশটি যেন এই কর্মসূচী কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করে এবং তারা যেন পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে না পারে। এই চুক্তিতে সই করা ছয়টি শক্তিধর দেশ হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া এবং জার্মানি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে চুক্তিটি সই হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তার মতে, এই চুক্তিতে ইরানকে অনেক বেশি ছাড় দেয়া হয়েছিল। মিস্টার ট্রাম্প শুধু এই চুক্তি থেকেই বেরিয়ে যাননি, তিনি ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ট্রাম্প প্রশাসন শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে এমন এক নীতি গ্রহণ করেছিল, যাতে সবকিছুতে ইসরায়েলের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। মিস্টার ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল ইসরায়েল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন হোয়াইট হাউসে এসেই ইরান পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে আলোচনায় যোগ দিলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েলকে তা ক্ষিপ্ত করে। ইসরায়েলের ক্ষমতায় পরিবর্তনের পর নাফতালি বেনেত নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেও, ইরান চুক্তির ব্যাপারে পূর্বসূরি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নীতির সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র ফারাক নেই। কাজেই মিস্টার বেনেত প্রথম সুযোগেই ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্র দেশগুলোকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। চুক্তি পুনরুজ্জীবনের আশাবাদ: ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে আলোচনা অব্যাহত আছে গত এপ্রিল মাস হতে। ভিয়েনায় রবিবার ছটি দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া এবং জার্মানির প্রতিনিধিরা ইরানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সর্বশেষ দফা বৈঠক করেছেন। এই বৈঠক থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, আলোচনায় বেশ অগ্রগতি হচ্ছে। তবে রবিবারের বৈঠকের পর আলোচনা আপাতত মুলতবি রাখা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তাদের রাজধানীতে ফিরে গেছেন। এই আলোচনার লক্ষ্য হচ্ছে, ইরানের বিরুদ্ধে জারি করা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিনিময়ে তাদের পরমাণু কর্মসূচী সীমিত পর্যায়ে আটকে রাখা। ইরানের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বলেছেন, চুক্তির বিভিন্ন পক্ষ একটা সমঝোতার কাছাকাছি পৌঁছেছেন, তবে বাকী পথ অতিক্রম করা 'অত সহজ হবে না।' অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূত এনরিক মোরা বলেছেন, কারিগরি বিষয়ে আলোচনায় অগ্রগতির ফলে তারা এখন, রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর ব্যাপারে একটা স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছেন। তবে আলোচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোকে উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, চুক্তি পুনরুজ্জীবনের আলোচনা সফল হওয়ার পথে দুটি বড় বাধা এখনো আছে। এই দুটি বাধা অপসারণ করা না গেলে, আলোচনা ভেস্তে যেতে পারে। এর একটি হচ্ছে, ভবিষ্যতের কোন মার্কিন প্রশাসন যেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এবারের চুক্তি বাতিল করতে না পারে, সেরকম একটি নিশ্চয়তা চায় ইরান। একজন মার্কিন কূটনীতিকের ভাষায়, "ইরান চায় এমন একটি স্থায়ী ব্যবস্থা, যা কোন সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে করা অসম্ভব।" ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে যেটি সই হয়েছিল, সেটি ছিল আসলে একটি সমঝোতা, সত্যিকারের চুক্তি নয়। কারণ চুক্তি করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে সেটি অনুমোদনের দরকার হতো, যেটি প্রায় অসম্ভব। সেজন্যে প্রেসিডেন্ট ওবামা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এটি অনুমোদন করেন, যা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর সহজেই বাতিল করে দিতে পেরেছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেও এই আলোচনায় এমন এক দাবি তোলা হচ্ছে, যেটি ইরানের পক্ষে মানা কঠিন হতে পারে। আগের চুক্তির সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বাইডেন প্রশাসন ইরানের কাছ থেকে এমন লিখিত অঙ্গীকার চায় যে, আগের চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার সাথে সাথে ইরান যেন আরও 'বৃহত্তর, দীর্ঘস্থায়ী এবং শক্তিশালী' একটি চুক্তির জন্য আলোচনার টেবিলে ফিরে আসে। তবে ইরান এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, আগের চুক্তির শর্তাবলীতে এমন কোন পরিবর্তন তারা চায় না, যেটি তার পরমাণু কর্মসূচিকে আরও সীমিত করে দেবে। কট্টরপন্থীদের উত্থান: কিন্তু এই আলোচনার সব হিসেব-নিকেশ এখন পাল্টে গেছে ইরানে কট্টর রক্ষণশীল প্রার্থী এব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর। এব্রাহিম রাইসি তার অতি রক্ষণশীল মতাদর্শের জন্য পরিচিত। তাকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেইনির ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। বিবিসির ফারসি বিভাগের বিশ্লেষক কাসরা নাজি বলেন, এ পর্যন্ত যেসব কথাবার্তা এব্রাহিম রাইসি বলেছেন, তাতে তিনি নিজের এমন কোন বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন নি, যা থেকে বোঝা যাবে, আগামী চার বছর ইরানের কেমন যাবে। কোন কোন পর্যবেক্ষকের মতে, তিনি হবেন আসলে আয়াতোল্লাহ আলি খামেইনির নির্বাহী কর্মকর্তা, তার নীতিই বাস্তবায়ন করবেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আয়াতোল্লাহ আলি খামেইনি এমনিতেই যথেষ্ট শক্তিশালী, কিন্তু মনে করা হয় তিনি এখন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে আরও বেশি করে এখন ইরানের আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করছেন। কাজেই এব্রাহিম রাইসির মতো একজন কট্টরপন্থী যখন ইরানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, তখন ভিয়েনা বৈঠকের ফল আসলে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। 'নতুন সুযোগ' তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসনের যে কূটনীতিকরা এখন পর্দার আড়ালে ইরানের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন, তারা বরং একে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন। এই কূটনীতিকদের উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, "এব্রাহিম রাইসির অভিষেকের আগে যে ছয় সপ্তাহ সময় রয়েছে, সেটি একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর একটি ভালো সুযোগ খুলে দিয়েছে।" ওয়াশিংটন এবং তেহরান, এই দুই রাজধানীতেই কর্মকর্তাদের ধারণা, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেইনি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি পুনর্বহাল করতে চান, যাতে করে ইরানের বিরুদ্ধে জারি করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের তেল আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা যাচ্ছে না, অথচ তেলের বাজার এখন বেশ চাঙ্গা। এই নিষেধাজ্ঞা ইরানের অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গু করে রেখেছে। ওয়াশিংটন এবং তেহরানের কূটনৈতিক মহলে এমন কানাঘুষো চলছে যে, আয়াতোল্লাহ খামেইনি চান, ইরানের বর্তমান মধ্যপন্থী সরকার ক্ষমতায় থাকতে থাকতেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়ে যাক, যাতে করে পরবর্তীতে তাদেরকে এই বলে দোষারোপ করা যায় যে তারা 'পশ্চিমা শক্তির' কাছে আত্মসমর্পন করেছে। আবার অন্যদিকে যদি এই সমঝোতার ফলে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়, এবং এতে করে ইরানের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠে, সেক্ষেত্রেও এব্রাহিম রাইসির নতুন সরকার এর সুফল পেতে পারে এবং এটিকে নিজেদের কৃতিত্ব বলে দাবি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র অবশ্য জানিয়েছেন, এব্রাহিম রাইসি দায়িত্ব গ্রহণের পরও ইরানের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনা অব্যাহত থাকবে। তবে সেই আলোচনার ফল কী দাঁড়াবে, সেটা আঁচ করা খুব কঠিন। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×