ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বোরহান বিশ্বাস

নদী পারেই গড়ে উঠুক সুখনিবাস

প্রকাশিত: ২০:০০, ২১ জুন ২০২১

নদী পারেই গড়ে উঠুক সুখনিবাস

যমুনায় কান পাতলে এখনও নদী ভাঙনের শব্দ শোনেন আফজাল মিয়া। সাতবার ভাঙনের শিকার হয়েছেন। কোথাও স্থায়ীভাবে থিতু হওয়ার স্বপ্ন এখন আর দেখেন না। নদীপারের এই মানুষটি বার বার ঘর ভেঙে ঘর তুলেছেন। নদী যখন বাড়ির কাছে এসে ফণা তুলে দাঁড়ায় তিনি তখন ঘর সরানোর চিন্তায় থাকেন। জীবনের এই পড়ন্ত সময়ে এসে আবারও ঘর সরিয়ে অন্যত্র নিতে হবে ভাবতে পারছেন না। তবুও তাকে সরে যেতে হবে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, তারপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, রাত। সময় বয়ে যায়। ভাঙন তীব্র হয়। এক সময় নদীপাড় থেকে সরেই যেতে হয় আফজাল মিয়াকে। তার পরিবারের মতো অনেক পরিবারই ফসলি জমিসহ ভিটেমাটি হারিয়েছে। ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে পুরো গ্রামের পর গ্রাম। বাড়ি, বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয় আরও অনেক কিছু। নদীভাঙনকে বলা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নদীর পানি সমুদ্রে গিয়ে পড়ার সময় সমুদ্রের কাছাকাছি হলে তা তীব্র গতি পায়। তখন পানির তীব্র স্রোতে নদীর পাড় ভাঙতে থাকে। বর্ষা মৌসুমে উজানে তীব্র বৃষ্টিপাত হলেও নদীর পানি বেড়ে যায়। তখন নদীতে স্রোতও বেড়ে যায়। নদীর এ তীব্র স্রোত ভাটার দিকে চলার পাশাপাশি নদীর পাড়ে আঘাত করতে থাকে। পানির এই ক্রমাগত আঘাতে নদীতীরবর্তী ভূভাগ ক্ষয় হতে থাকে। এক সময় মাটি ক্ষয় হতে হতে যখন উপরের মাটির ভার সহ্য করতে পারে না, তখন নদীপাড়ের বিশাল অংশ নদীর মধ্যে ভেঙে পড়ে। আর এসব কারণে ভাঙন এলাকায় নদীর পানি ঘোলা হয়। নদীভাঙন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গবেষণায় দেখা গেছে, ফিবছর প্রায় ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙনে হারিয়ে যায়। এই ভাঙনের ফলে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাঙনে দেশে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ১৯৮৪-৯২ সময়কালে সর্বোচ্চ তীর ভাঙনের ঘটনা সংঘটিত হয় আরিচার উজানে। ১৯৭৩ সাল থেকে ৯০ দশকের প্রথম পর্যন্ত যমুনা নদী ক্রমাগত চওড়া হতে থাকে। গত ২৮ বছর সময়কালে নদীর এ প্রশস্তায়নের ফলে নদীর ২২০ কিমি দীর্ঘ বাংলাদেশ অংশে ৭০ হাজার হেক্টর প্লাবনভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় (গড়ে বছরে প্রায় ২ হাজার ৬০০ হেক্টর)। ঢাকার বস্তিগুলোর ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এসব ছিন্নমূল পরিবারের অধিকাংশই এসেছে ফরিদপুর (৩৪%), বরিশাল (২৫.৬%), কুমিল্লা (২৪.৩%) ও ঢাকা (১৪.৩%) থেকে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব বস্তিবাসীর অধিকাংশই আবার গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা নদীর ও এদের সম্মিলিত মোহনার আশপাশে অবস্থিত কয়েকটি থানা নিয়ে গঠিত সীমিত এলাকা থেকে এসেছে। নদীভাঙনের ফলে স্থানচ্যুতির ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরো পরিবারই পথে বসে। এক হিসাবে দেখা যায়, ওই এলাকার একটি পরিবার জীবদ্দশায় গড়ে ২.৩৩ বার ভাঙনের কবলে পড়ে। এদের মধ্যে অনেকে ৪-৫ বা ততোধিকবার এ দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। সূত্র : বাংলা পিডিয়া। নদী বিধৌত এই বাংলাদেশে জরাজীর্ণ বাঁধ মেরামত বা পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দের কমতি থাকে না। তবে, কথা থেকে যায়, সঠিকভাবে ব্যয় হলে বাঁধের এত দুরবস্থা কেন? ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পরবর্তীতে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে গেছে। পুনর্নির্মাণের কাজও চলছে। বাঁধগুলো অনেক পুরনো। এজন্য ডেল্টা প্রকল্পের আওতায় টেকসই বাঁধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। তার জন্য বাজেট বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে সব উপকূলীয় অঞ্চল টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। আসলেই টেকসই বাঁধের বড় প্রয়োজন উপকূল কিংবা নদী পারের মানুষদের জন্য। কিন্তু সেজন্য আরও ১০ বছর অপেক্ষা? জরুরী ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা নেয়াটা জরুরী। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বাঁধগুলোর অবস্থাই শোচনীয়। টেকসই বাঁধের বিকল্প যেমন নেই, তেমনি অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাঁধ, বেড়িবাঁধ সংস্কারের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। যখন পাশে কেউ থাকে না তখন বিপদ আসন্ন জেনেই সাধারণ মানুষ কোদাল হাতে, ঝুড়ি মাথায় বাঁধ রক্ষায় নামে। প্রাণান্তকর চেষ্টায় কখনও সফল, কখনও ব্যর্থ হন। এমন দৃশ্য সচরাচরই আমরা পত্র-পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে দেখে থাকি। এবার বর্ষা শুরুর আগেই সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও এনায়েতপুরে তীব্র নদীভাঙন দেখা দেয়। প্রতিদিনই বিলীন হতে থাকে বসতভিটা, গাছপালা ও ফসলি জমিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। বরাবরের মতোই ভাঙনরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন নদীপাড়ের আতঙ্কিত মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, ভাঙনরোধে তারা জরুরী ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছে। আশ^াস দিয়েছে, শুষ্ক মৌসুমে স্থায়ী বাঁধের কাজ হবে। যমুনায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে স্রোতের তীব্রতা। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে নদীপারে বসবাসরত মানুষের। এরই মধ্যে এনায়েতপুর থেকে শাহজাদপুর পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য ৬৪৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সম্প্রতি একনেকের বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মানে ভাঙনরোধে সরকারের চেষ্টার কমতি থাকে না। সমস্যা দেখা দেয় কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে। বাঁধের কাজ হয়তো এক সময় শেষ হয়। কিন্তু মন থেকে আতঙ্ক কাটে না নদীপাড়ের মানুষের। অজানা শঙ্কায় রাত কাটে, দিন কাটে। তাইতো টেকসই বাঁধের স্বপ্ন দেখা ভাঙন এলাকার সেসব দুর্দশাগ্রস্তরা প্রায়ই সরকারের কাছে ত্রাণ না চেয়ে নদীভাঙন থেকে রক্ষা পেতে টেকসই বাঁধের দাবি জানান। বর্ষা সবে শুরু হয়েছে। বৃষ্টি ও উজানের পানির তোড়ে দেশের নদ-নদীর পানি বাড়ছে। নদীভাঙনও শুরু হয়েছে কোথাও কোথাও। তবে, এ আশঙ্কার মধ্যে ইতিবাচক খবর হচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে নদীভাঙন কমে এসেছে। ২০১১ সালে দেশে বছরে ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর এলাকা নদীভাঙনের শিকার হয়েছিল। ২০১৮ সালে তা কমে ৩ হাজার ২০০ হেক্টরে নেমে আসে। ২০১৯ সালে তা আরও কমে ২ হাজার ৬০০ হেক্টরে নেমে আসে। পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাতের মতে, নদীভাঙন কমেছে, এটা ইতিবাচক খবর। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ এ খাতে সরকার প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে নদীর তীর রক্ষায় ও বাঁধ নির্মাণে প্রচুর অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। তবে, বিনিয়োগ অনুপাতে সাফল্য আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এনামুল হক বলেছেন, পর্যায়ক্রমে দেশের সব এলাকার নদীভাঙন কমিয়ে আনা হবে। নড়িয়ায় ২০১৭ সালে ৫ হাজারের বেশি ভবন ভাঙতে হয়েছে। এখন আর তা হয় না। নড়িয়ার মতো জটিল এলাকার ভাঙনের অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্য এলাকাগুলোর ভাঙনরোধে প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণকালে নদী শাসনের যে দৃষ্টান্ত সরকার স্থাপন করেছে, ঠিক সেভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের নদীর পাড়ও যেন আতঙ্কের না হয়ে আনন্দের সুখনিবাস হয় সেজন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগেই মিলবে নদী শাসন- এমন প্রত্যাশা নিশ্চয়ই অমূলক নয়! লেখক : সাংবাদিক
×