ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ ফারুক হোসেন

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও এলএসডি

প্রকাশিত: ১৯:৫৯, ২১ জুন ২০২১

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও এলএসডি

করোনাকালেও থেমে নেই ভয়াবহ মাদকের আগ্রাসন। ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে। টার্গেট করা হচ্ছে তরুণদের। মাদকের নেশায় আসক্ত হচ্ছে তারা। করোনার সময় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষার্থীদের অনেকেই অবসাদগ্রস্ততা ও হতাশার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। এই সময় ঘরে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের টার্গেট করছে মাদক কারবারিরা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আলোচনায় এসেছে ক্ষতিকর মাদক লাইসার্জিক এসিড ডাইথ্যালামাইড। সংক্ষেপে মাদকটি এলএসডি নামে পরিচিতি। এলএসডি সাইকাডেলিক মাদক হিসেবে চিহ্নিত। এলএসডির প্রভাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। এই মাদক সেবন করেই শিক্ষার্থী হাফিজুর আত্মঘাতী হয়েছেন বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের। তদন্তে নেমে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা রাজধানীর ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া এলাকা থেকে হাফিজের বন্ধুসহ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তিন তরুণকে ২০০ পিস এলএসডিসহ গ্রেফতার করেছে। ডিবি পুলিশ বলছে, এই তরুণরা ফেসবুকে গ্রুপ তৈরি করে গাঁজাপাতার নির্যাস মেশানো কেক এবং এলএসডি বিক্রি করছিল। সম্প্রতি মোবাইল এ্যাপে গোপন যোগাযোগ করে পার্সেলে নেদারল্যান্ডস থেকে এলএসডি সংগ্রহ করে চক্রটি। বেশ দামী এই মাদকের প্রচলন ইউরোপ-আমেরিকায় থাকলেও এ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এলএসডি উদ্ধার হয়েছে বলে ডিবির দাবি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, ২০১৯ সালেও দেশে কয়েক গ্রাম এলএসডি জব্দ করা হয়েছে। এলএসডি সাধারণত অন্যান্য মাদক থেকে অনেক ক্ষতিকর। এটি ব্যবহারে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয় যেটি সেবনকারীকে ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। এটি গ্রহণের ফলে ব্যক্তির চোখের সামনে অনেক কিছু ভাসবে, তবে সেটির বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। যেমন- সে ঘরে বসে দেখছে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে কিংবা উড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত হ্যালুসিনেশনের কারণে এমনকি আত্মহত্যাও করতে পারে। এসব মাদক সাধারণত অল্প বয়সের ছেলে-মেয়েরা গ্রহণ করে থাকে, যেটি সামাজিক প্রেক্ষাপট ভয়ানক। এলএসডি মাদক যারা নিচ্ছে বা যারা এ মাদক গ্রহণে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে তাদের চিকিৎসা অন্যান্য মাদক সেবনকারীর মতোই। তবে এলএসডি এমন ভয়ানক মাদক যেটি বেশি মাত্রায় গ্রহণের ফলে হিংস্রতা বেড়ে যায়। অনেক সময় গ্রহণকারীর অতীত মনে পড়ে যায়, কখনও কখনও নিজেকে অতিমাত্রায় শক্তিশালী মনে করে। রাগান্বিত হয়, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং ডিপ্রেশন বেড়ে যায়। এসব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। সাধারণত ধীরে ধীরে মাদক থেকে সরিয়ে আনতে হয় অথবা একেবারে সম্পূর্ণরূপে মাদক থেকে বিমুখ রাখতে হয়। এ রোগের কিছু এন্টিবায়োটিক দেয়া হয় যেন শারীরিক কোন নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। যদি এ রোগী ওষুধ নেয় আবার মাদকও নেয় একসঙ্গে তাহলে কোন কাজ হবে না, বরং রোগীর ক্ষতি হবে। কারণ ওষুধ নেয়ার পর তার সাময়িক সময়ের জন্য হ্যালুসিনেশন কিছুটা কমবে, কিন্তু আগের মতোই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন ফার্মাসিউটিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া ড্রাগস ডটকমের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, লাইসারজিক এসিড থেকে তৈরি করা হয় এলএসডি। এই এসিড বিভিন্ন দানাদার শস্যে থাকা এরগোট ছত্রাকে পাওয়া যায়। ১৯৩৮ সালে বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণে প্রথম এলএসডি তৈরি হয়। এটি এতই শক্তিশালী যে, এর ডোজগুলো সাধারণত মাইক্রোগ্রাম হিসেবে নেয়া হয়। এটি মনের ওপর প্রভাব ফেলে। কখনও কখনও এর প্রভাবে ভীতিকর অনুভূতি তৈরি হয়। এমনটা ঘটলে একে ‘ব্যাড ট্রিপ’ বলা হয়। নানাভাবে এলএসডি বাজারজাত করা হয়। যেমন- পেপার বা নকশা করা বিশেষ কাগজে এলএসডি মেশানো হয়। এভাবেই এলএসডি বেশি সহজলভ্য। এছাড়াও ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল আকারে, তরল বা কিউব আকারেও পাওয়া যায়। দেশজুড়ে বিভিন্নরকম মাদকের ছড়াছড়ি হলেও দেশে এই প্রথম নতুন মাদকের সন্ধান মিলেছে। এলএসডি নামের এ মাদকের ভয়াবহতা অন্যান্য মাদকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আশির দশকের প্রথম দিকে এমন মাদকের সন্ধান পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় পর আবারও আলোচনায় আসে এটি। উচ্চবিত্তদের তরুণ-তরুণীরাই এ মাদক সাধারণত সেবন করে থাকে। মাদকটি সেবনে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়- একটি সেবনকারীকে সাময়িক আনন্দ দেয়, অন্যটি হ্যালুসিনেশন ও ইলুনেশন তৈরি হয়। আর হ্যালুসিনেশনটা যখন দীর্ঘায়িত হয় তখন সৃষ্টি হয় বড় সমস্যা। এমনকি ব্যক্তি পাগল পর্যন্ত হয়ে যায়। চিকিৎসকরা বলছেন, মাদকটি অতিমাত্রায় গ্রহণে অনেকে সুইসাইড পর্যন্ত করে বসে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ মাদক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ এবিউজের তথ্য অনুযায়ী ডি-লাইসার্জিক এসিড ডাইথ্যালামাইড বা এলএসডি রাসায়নিক সংশ্লেষের মাধ্যমে তৈরি একটি পদার্থ, যা বিভিন্ন ধরনের শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ধরনের ছত্রাকের শরীরের লাইসার্জিক এসিড থেকে তৈরি করা হয়। এটি স্বচ্ছ, গন্ধহীন একটি পদার্থ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে এটি পাউডার, তরল, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের আকারে পাওয়া যায়। এলএসডিকে ‘সাইকাডেলিক’ মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধরনের মাদকের প্রভাবে সাধারণত মানুষ নিজের আশপাশের বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে এবং কখনও কখনও ‘হ্যালুসিনেট’ বা অলীক বস্তু প্রত্যক্ষ করে থাকে। আশির দশকের প্রথম দিকে এলএসডি মাদকদ্রব্যটির প্রচলন হয়েছিল। সারা পৃথিবীতে এ মাদকদ্রব্যটি অবৈধ এবং নিষিদ্ধ। মাদকটি খুবই ছোট আকারের। এটি গ্রহণের পর সেবনকারী এক ধরনের কল্পনার জগতে চলে যায়। এ মাদক গ্রহণে বিভিন্নরকম খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ মাদক গ্রহণে হ্যালুসিনেশন যদি কোন কোন ব্যক্তির জীবনে দীর্ঘায়িত হয় তাহলে মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং মানসিক রোগী বা পাগল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে অভিভাবকদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যেন ছেলেমেয়ারা মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। কারও কারও ধারণা, এলএসডি নতুন কোন মাদক নয়। বাংলাদেশে এই মাদকের ব্যবহার বহু বছর আগেই শুরু হয়েছে। তবে এর ব্যাপক বিস্তার হয়নি। কেননা, এই মাদকের দাম বেশি এবং এটি ইউরোপের দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে। নব্বইয়ে দশকে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক দেশে আসায় এলএসডির ব্যবহার সেভাবে দেখা যায়নি। তবে কিছু তরুণের মধ্যে এই মাদক নেয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ইউরোপের বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট রিসার্চগেইটে ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ীী ১৯৫৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় মোট ৬৪ জনের মৃত্যু হয় এলএসডি গ্রহণের পরবর্তী জটিলতায়। বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তায় ভোগা ব্যক্তিরা এলএসডি গ্রহণের পর আরও বেশি বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হতে পারেন বলেও উঠে এসেছে অনেক গবেষণায়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলছে, এলএসডি গ্রহণের পর অনেকে মনে করেন যে, তিনি সবকিছু পরিষ্কার দেখছেন এবং তার শরীরে অতিমানবিক শক্তি এসেছে। এরকম বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার ফলেও অনেকে নানা ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। অতিরিক্ত আতঙ্কের কারণে মানুষ অনেক সময় মনে করতে পারে যে, সে শীঘ্রই মারা যাবে বা মারা যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতেও মানুষ আতঙ্কের বশবর্তী হয়ে নানা ধরনের কাজ করে থাকে, যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আতঙ্কিত হওয়ার পাশাপাশি অতি দ্রুত অনুভূতির পরিবর্তন হওয়ার কারণেও মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করতে পারে বলে বলছে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন। সংস্থাটি বলছে, এলএসডি গ্রহণের আগে এটা বোঝা সম্ভব নয় যে, আপনার অভিজ্ঞতা কেমন হতে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষের হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা এবং শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এছাড়াও অনেকের ক্ষেত্রে অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, অতিরিক্ত ঘামসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যাও তৈরি হয় বলে জানাচ্ছে ন্যাশনাল লাইব্ররি অব মেডিসিন। মাদকাসক্তরা নিজেদের ধ্বংস করছে, পরিবারকেও ঠেলে দিচ্ছে বিপর্যয়ের দিকে। নানারকম অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ার ফলে সামাজিক স্থিতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে ঘুরে না দাঁড়ালে সামনের দিনের ভয়ঙ্কর পরিণতি রোধ করা যাবে না। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। মাদকের কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তুলতে হবে। মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে ঘরেও সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ। মাদক প্রতিরোধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়ার কোন বিকল্প নেই। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×