ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাত পা বাঁধা লাশ উদ্ধার ॥ বড় মেয়ে গ্রেফতার

রাজধানীতে একই পরিবারের ৩ জন খুন

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২০ জুন ২০২১

রাজধানীতে একই পরিবারের ৩ জন খুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর কদমতলীর মুরাদপুরে একই পরিবারের তিনজন খুন হয়েছেন। তাদের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতরা হচ্ছেন মাসুদ রানা (৫০), তার স্ত্রী মৌসুমী ইসলাম (৪০) ও মেয়ে জান্নাতুল (২০)। এ সময় একই পরিবারের দুজনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ নিহত মাসুদ রানার বড় মেয়ে মেহজাবিন আক্তার মুনকে (২৪) গ্রেফতার করেছে। এদিকে ঘটনার পরপরই থানা পুলিশের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সিআইডি ক্রাইম সিন তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তের অংশ হিসেবে এ ঘটনার আগে ওই বাসায় বাইরে থেকে কেউ এসেছিল কিনা, তাদের ভেতর পারিবারিক কোন ধরনের দ্ব›দ্ব এবং তা কার কার সঙ্গে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেছে। ঘটনাস্থল থেকে বিষাক্ত কিছু প্রয়োগের আলামত পাওয়া গেছে। আলামতগুলো পরীক্ষার জন্য সিআইডির রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, শনিবার সকালে ৯৯৯-এ ফোন করে নিহতের বড় মেয়ে মেহজাবিন বলেন, তিনি তার মা, বাবা ও ছোট বোনকে হত্যা করেছেন। বলেন, আপনারা আসেন। এসে আমাকে ধরে নিয়ে যান। সংশ্লিষ্টরা জানান, পরকীয়ার জের ধরে এই তিন খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার সকালে জরুরী সেবা ৯৯৯ থেকে খবর পেয়ে কদমতলী থানা লাল মিয়া সর্দার রোডের ২৭৪/১ নম্বর ভবনের দোতলার ফ্ল্যাট থেকে বাবা-মা-মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। কদমতলী থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর বলেন, তিনজনের প্রত্যেকের হাত-পা বাঁধা ছিল। গলায় শ্বাসরোধের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ওসি জানান, ওই দম্পতির আরেক মেয়ে মেহজাবিন মুন। ধারণা করা হচ্ছে, এ হত্যার পেছনে তাদের কন্যা মেহজাবিন মুন জড়িত থাকতে পারেন। তিনি তার একমাত্র কন্যা সন্তান মারজান তাবাসসুম ও স্বামী শফিকুল ইসলামকেও বিষাক্ত কিছু খাওয়ান। তবে তাদের মৃত্যু হয়নি। তিন মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনাস্থল থেকে শফিকুল ইসলাম (৪০) ও মেয়ে মারজান তাবাচ্ছুম তৃপ্তিকে (৪) অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরে শফিকুল ইসলামকে স্টমাক ওয়াশ করে মিটফোর্ডে পাঠানো হয়। তার মেয়ে তৃপ্তিকে ‘স্টমাক ওয়াশ’ করে ঢামেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ২১০-এ ভর্তি করা হয়েছে। তাকে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কদমতলী থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আলম জানান, অসুস্থ শফিকুল ইসলাম গ্রেফতারকৃত মেহজাবিন আক্তার মুনের স্বামী। আর নিহত জান্নাতুল হলেন মুনের বোন। আর অসুস্থ তৃপ্তি মুনের মেয়ে। ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, কদমতলীর ঘটনায় দুজনকে অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের মধ্যে শিশু তৃপ্তিকে এখানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তার বাবা শফিকুল ইসলামকে মিটফোর্ডে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার বলেন, মা-বাবাসহ ছোট বোনকে হত্যা করে ৯৯৯ এ ফোন দেন মেহজাবিন মুন। চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার স্বামী শহিদুল ও সন্তান তৃপ্তিকে। ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর সবার হাত পা বাঁধেন মুন। মুন থাকেন আলাদা বাসায়। এখানে মায়ের বাসায় বেড়াতে আসেন তিনি। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এই খুন করা হয়। সূত্র জানায়, দুলাভাই শফিকুলের সঙ্গে শ্যালিকার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। শ্যালিকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক মা-বাবা জানত। কিন্তু বিচার না করায় ক্ষোভ থেকে এই হত্যা করেন মুন। এদিকে হত্যার রহস্য উন্মোচনে পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমেছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, মেহজাবিনের সঙ্গে তার বাবা-মায়ের সম্পর্ক ভাল ছিল না। প্রায়ই তাদের মনোমালিন্য ও দ্ব›দ্ব হতো। পরকীয়া ও অর্থ-সম্পত্তি নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল। এসব কারণে মেহজাবিন মাঝেমধ্যে বাবার বাড়িতে এসে কিংবা মোবাইল ফোনে তাদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়তেন। শনিবার দুপুরে মুরাদপুরের ওই বাসায় নিহত মৌসুমী ইসলামের একমাত্র ভাই সংবাদকর্মীদের জানান, সম্ভবত পারিবারিক কলহের কারণেই এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বলেন, ওই বাসার এক ভাড়াটিয়া প্রথমে আমাকে খবর দেন। ওই ভাড়াটিয়া জানান, আমার বোন, তার স্বামী ও মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। এ খবর পেয়ে আমি এই বাসায় আসি। এদিকে পুলিশের অভিযোগ নিহত মৌসুমী ইসলাম উচ্চবিত্তদের মেয়ে সাপ্লাই দিতেন। মুনের বাবা মাসুদ রানা দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি বিষয়টি জানতেন। এর রেশ ধরে মুন পরিকল্পিতভাবে সবাইকে হত্যা করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। এ ঘটনায় সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আটক মুনের স্বামী শফিকুল ইসলাম ও তাদের শিশুসন্তান তৃপ্তিকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে শফিকুলকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে তাদের শিশুসন্তান আশঙ্কামুক্ত রয়েছে। তাকে ঢামেকের ২১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। মুনের স্বামী শফিকুল ইসলাম জানান, তাদের বাসা রাজধানীর কদমতলীর বাগানবাড়ি এলাকায়। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যান। যাওয়ার সময় আম-কাঁঠাল কিনে নেন। রাতে মুন তাদের সবাইকে নুডুলসসহ অনেক কিছু খেতে দেন। তারা বাসার সবাই খেয়েছে। কিন্তু পরে কী হয়েছে এ বিষয়ে তার কিছুই স্পষ্ট মনে নেই। স্ত্রী মুনের সঙ্গে গত তিন মাস ধরে তার সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না। মুনের সঙ্গে তার বাবা-মায়েরও সম্পর্ক ভাল ছিল না বলে জানায় শফিকুল। মা-বাবা-বোনকে হত্যার কথা স্বীকার মুনের \ পুলিশ জানায়, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তিনজনকে হত্যা করেছে মেহজাবিন মুন। মা-বাবাসহ ছোট বোনকে হত্যা করে ৯৯৯-এ ফোন দেন তিনি নিজেই। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কদমতলীর মুরাদপুর হাজী লাল মিয়া সরকার রোডের ওই ফ্ল্যাট থেকে স্বামী, স্ত্রী ও মেয়ের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে। বিকেলে কদমতলী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, কদমতলীর মুরাদপুর এলাকায় একই পরিবারের তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বিষ ও নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। এসআই আবুল কালাম জানান, নিহতের বড় মেয়ে মেহজাবিন সকালে ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে জানান, তিনি তার মা, বাবা ও ছোট বোনকে হত্যা করেছেন। আপনারা আসেন। এসে আমাকে ধরে নিয়ে যান। পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, গত দুদিন আগে স্বামী শফিকুল ইসলাম ও শিশু সন্তান তৃপ্তিকে নিয়ে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন মেহজাবিন। এসেই তার ছোট বোন জান্নাতুলের সঙ্গে তার স্বামীর পরকীয়া রয়েছে বলে বাবা-মাকে অভিযোগ করেন। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। তার জেরেই হয়তো তিনি এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এছাড়া প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, সম্পত্তি নিয়েও পরিবারের সঙ্গে বিরোধ ছিল মেহজাবিনের। সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য বাবা-মাকে অনেক চাপ দিতেন তিনি। এ নিয়ে এর আগে বৈঠক সালিশও হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে।
×