ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক বিচ্যুতি

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২০ জুন ২০২১

মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক বিচ্যুতি

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আদিকাল থেকে সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে মানুষ তার প্রয়োজনে সামাজিকভাবে জীবনযাপনের লক্ষ্যে কিছু নিয়মনীতি শৃঙ্খলাবোধ আইন প্রথা মেনে চলে। যদিও জনগণের কল্যাণ মূলত আইনের উদ্দেশ্য, তবুও সব সময় সর্বক্ষেত্রে আইনকে ন্যায়বিচার ও নীতির ওপর অটল থাকতে দেখা যায় না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে আইনের দৃষ্টিতে সমান কথাটি বলা হলেও তা সব সময় পরিলক্ষিত হয় না। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আইনের শাসন ও মানবাধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নিজেকে সভ্য করার চেষ্টা করছিল সেই আদিকাল থেকে যা এখনও নিরন্তর। আদিকালে মানুষের ভাষাজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে যুগের মানুষকে বর্বর বা অসভ্য ভাবা হলেও তারা বর্তমানের এক শ্রেণীর মানুষের মতো অমানবিক ছিল না। সামাজিক নীতিশাস্ত্র একটি ধারণা যা ব্যক্তির নৈতিক আচরণের পাশাপাশি তার সম্মিলিত বাস্তবতা এবং তার ব্যক্তিত্বের সংমিশ্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত। মূল্যবোধের দীনতা এবং নৈতিকতার বিচ্যুতি সমাজে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনায় প্রায়শই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পরিবার ও সমাজের দায় এবং আমাদের বিপরীতমুখী যাত্রার প্রবণতা ও বাসনা। মুরারিচাঁদ কলেজের ধর্ষণকাণ্ড, ফেনীর নুসরাত হত্যা, সাব-রেজিস্ট্রারের ছেলে দিহানের লাগামহীন জীবন এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গুলশান ট্র্যাজেডি কিসের ইঙ্গিত বহন করছে? এ সমাজের সবাই উচ্চাভিলাষী এবং চাকচিক্যময় জীবন উপভোগ করতে চায়। যুগের পরিবর্তনে এ চাওয়াটা অমূলকও নয়। প্রত্যেক সমাজ, পরিবার এবং সম্প্রদায়ই তার পথ চলায় বেশ অলিখিত আচার-আচরণ নৈতিক মানদণ্ড প্রথা বিধি মূল্যবোধে আভীষ্ট হয়ে অকৃত্রিম তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি পাওয়ার মানসে নিয়ত নিযুক্ত। এসব বিধি-বিধান, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অনুশীলন সমাজ-সংসারে বেঁচে থাকার অক্সিজেন এবং রসদ যুগিয়ে মানব মনে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে। এ যেন এক অকৃত্রিম বন্ধন। যেখানে আত্মীয়তার সম্পর্ক সব সময় না থাকা সত্তে¡ও সবার মাঝেই আন্তরিকতা ও ভালবাসার প্রতিধ্বনিত অনুরণিত হয়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সামাজিক সম্পর্ক রীতিনীতি বন্ধন ভালবাসায় কোথায় যেন আজকাল ছেদ পড়েছে। কেন জানি মনে হয় সমাজ কি পারছে তার নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি, অলিখিত বিধি আঁকড়ে ধরে সম্মুখ পানে নিজেদের নিয়ে যেতে? কোথায় যেন অসামঞ্জস্যতা? এ কিসের আলামত? মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি হলো যূথবদ্ধভাবে পারস্পরিক মিলেমিশে সুখে-দুখের সঙ্গী হয়ে সহযোগিতা, সহানুভূতি, ভালবাসা, আবেগকে পুঁজি করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা। সামাজিক জীবের তকমায় ভূষিত মানব জাতি। যারা কিনা সমাজের বিবর্তনের নানা পথ বেয়ে বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যের সুফল ভোগ করে সময়ের ধারাবাহিকতায় গেøাবাল ভিলেজের বাসিন্দার পরিচয়ে অজান্তেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। এ সমাজে ঘুষ ও দুর্নীতিকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। যেসব লোক এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল সমাজের অন্যরা তাদের সঙ্গে মেলামেশায় দূরত্ব বজায় রাখত। গ্রামে অনেকটা এক ঘরে বসবাস করত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ কি দেখছি? এসবের উৎস না খুঁজে অবলীলায় তাদের সঙ্গে অভিযোজন ঘটিয়ে অজান্তেই সুদ ঘুষকে বৈধতা দিয়ে এসবের চর্চায় মগ্ন থাকছি। এসব মানুষই কিনা নামে-বেনামে দান-খয়রাত উপঢৌকন এবং সামাজিক কাজে নিজেদের জড়িয়ে হাতেম তাইয়ের লকব গায়ে মাখছে। সমাজ কি পারছে তার কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে? ইগো দ্ব›দ্ব এ সমাজে নানাভাবে জেঁকে বসেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতামতকে পায়ে পিষে নিজের দৈন্য এবং দাম্ভিকতার প্রভাবে অনেক সময় কর্তাব্যক্তিদের মিথ্যার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কেননা, যে করেই হোক নিজের বাসনা চরিতার্থ করতেই হবে। সমাজ-সংসার কি এভাবে চলতে পারে? সমাজ, পরিবার, সংসার অবাধ যৌনতাকে কখনও সমর্থন দেয়নি। সব সমাজেই নানা কানুন ও অলিখিত প্রথা মূল্যবোধ ও নৈতিকতার দ্বারা এসব নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছিল। কিন্তু হালে আমরা কি দেখছি? পাশের বাড়ির বিবাহিত যুগল যার স্বামী কিনা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও ভবিষ্যত সুন্দরের প্রত্যাশায় মধ্যপ্রাচ্যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে নানা স্বপ্ন বুনছে। তার প্রেয়সীই কিনা সমাজ সংসারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবলীলায় পরকীয়ায় মত্ত থেকে সংসারে অশান্তি ও অনিশ্চয়তা আমদানি করছে। সমাজ কি পারছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে? আজকাল দেখা যায় অনেকেই লিভ টুগেদার করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি কি এসবকে অনুমোদন দেয়? তাহলে এসব কিভাবে হচ্ছে? ভাবার সময় এসেছে। ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির আশীর্বাদের সুফল সব বয়সের শ্রেণী-পেশার মানুষেরই ভোগ করার অধিকার রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ ব্যবহারের সুযোগে অসম সম্পর্ক অপরাধের বিস্তৃতি বল্গাহীন চলাফেরা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। প্রজন্মের হাতে এসব তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবার কি একবারও ভেবেছে এসবের পরিণতি কী হতে পারে? পরিবারের প্রয়োজনীয়তা এবং অস্তিত্বের কারণেই মানবসমাজের এক বিশেষ স্থান রয়েছে। মানুষ সারা জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভ করে। এমন কি মৃত্যু অবধি সে ভুল করে এবং শিখে। পারিবারিক আবহে এবং পরিমণ্ডলে শিশুরা যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা পায় তা পরবর্তী জীবনে চলার বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। পরিবার কি পারছে তার কাক্সিক্ষত দায়িত্ব পালন করতে? ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বপ্ন বাসনা এবং ব্যস্ততার সুযোগে আমরা পারস্পরিক ভালবাসা ও আন্তরিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। এসব ভাল লক্ষণ নয়। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এ তকমা এবং লকবটুকু আজ প্রশ্নবিদ্ধ। হেন কোন অনিয়ম স্বার্থপরতা এবং পাপাচার নেই যার সঙ্গে মানবকুলের সম্পর্ক নেই। নৈতিকতার বিচ্যুতি সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা রীতিনীতি নিয়ম প্রথার যথার্থ অনুশীলনের ঘাটতির সুবাধেই এসব হচ্ছে। সময় এসেছে ভেবে দেখার এবং এক্ষেত্রে পরিবারই পারে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে। যার হাত ধরেই সমাজ-সংসারে সুদিন ফিরতে পারে। পারিবারিক বন্ধন, ভালবাসা, শাসন, পরিচর্যা মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার মাঝেই এ দৈন্যের অবসানের স্বপ্ন দেখা যেতে পারে। চাটুকারিতা, কারসাজি এবং দালালি প্রবণতা যেন আমাদের অস্তিত্ব এবং মজ্জায় বাসা বেঁধে ফেলেছে। যার প্রভাবে সাদাকে সাদা বলার পরিবর্তে নানা রঙ্গে ভূষিত করছি এবং অন্যরা অবলীলায় দেখেও না দেখার ভান করে প্রকারান্তরে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে। যার কারণে শিক্ষক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক স্ব স্ব অবস্থানে থেকে সত্য বলতে পারছে না বা চায় না। এবং অনেক ক্ষেত্রে সাহস পায় না। অনেকেই একে ঝামেলা ভেবে এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা দেখায়। এমন কি হওয়ার কথা ছিল? আমরা একটি মানবিকতাশূন্য প্রজন্ম পেতে পারি। প্রযুক্তি ডিভাইস আবিষ্কৃত হয়েছিল জরুরী প্রয়োজন মেটানোর জন্য। সারারাত ধরে কথা বলার জন্য নয়। তবে প্রযুক্তি ব্যবহার বন্ধ নয়, কিছু কিছু বিষয় অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং এটা সম্ভব। মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন মাদকের সরবরাহ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হয়, তেমনি প্রযুক্তির খারাপ জিনিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মোবাইলে একজন মানুষ কতটুকু কী দেখতে পারবে, কী কী কাজে এর ব্যবহার হবে সেক্ষেত্রেও একটা সীমা আরোপ করা উচিত। সব কিছু সবার হাতে তুলে দেয়া উচিত নয়। এখন মোবাইলের মধ্যে সবকিছু ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাই এর ব্যবহারের সঠিক তদারকি করা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ নৈতিক গুণাবলি, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে এমন বিষয় শেখানোর প্রতি উৎসাহ দিতে হবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো আইনের প্রতি বিশ্বাস হারানো। এটি ঘটলে মানুষ তখন আইন নিজের হাতে তুলে নিতে থাকে এবং সমাজে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মধ্যে আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাস অটুট রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি যথেষ্ট অবাধ আর সহজ করে দেয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার এখানে মহামারী আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ১৮ বছরের নিচের ছেলেমেয়েদের ফেসবুক ব্যবহারের বিষয়ে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে ঘরে ঘরে ওয়াইফাই ঢুকে গেছে আর শিশুর হাতে রয়েছে এর পাসওয়ার্ড। এসব প্রতিকারের উপায় হিসেবে রাষ্ট্রকে সবার আগে ঠিক করতে হবে আমরা আসলে কি চাই, কোথায় যেতে চাই। সেজন্য আজ দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি ঐক্যের জায়গায় আসতে হবে এবং সবাই মিলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ও পরিণতি থেকে রক্ষা করতে হবে। সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষের কাছে এখন চাহিদা পূরণই আসল বিষয়। কিভাবে পূরণ করা হলো সেটা মুখ্য বিষয় নয়। নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষ তার আকাক্সক্ষা পূরণের ক্ষেত্রে এখন সামনে কোন বাধা এলেই হত্যাকে বেছে নিচ্ছে সহজ পথ হিসেবে। ভোগের আকাক্সক্ষা তীব্র আকার ধারণ করছে আমাদের মধ্যে। আজকে অবাধে ছড়িয়ে পড়া তথ্যপ্রযুক্তি, গণমাধ্যম নানামুখী চাহিদা এবং ভোগের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করছে মানুষের মধ্যে। পাশাপাশি সন্তানদের প্রতি মা-বাবার মনোযোগের অভাব, ধর্মীয় এবং নীতি-নৈতিকতা চর্চার অভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নানাবিধ অনাচার। এ ছাড়া ভোগবাদিতা, অধিক পাওয়ার আকাক্সক্ষা, সবটাতে তীব্র প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক অনিয়ম অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, নৈতিকতা চর্চার অভাব, সমাজে ছড়িয়ে পড়া অন্যায়-অনাচারের কম বেশি শিকার আজ সবশ্রেণীর মানুষ। ফলে, মানুষ সহজেই বিবেকশূন্য হয়ে হিং¯্রতায় লিপ্ত হয়ে পড়ছে। লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]
×