ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোবাইল ছিনতাই ও প্রসঙ্গ কথা

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২০ জুন ২০২১

মোবাইল ছিনতাই ও প্রসঙ্গ কথা

অপরাধ একটি চলমান প্রক্রিয়া। যে কোন সমাজে অপরাধের বহির্প্রকাশ দেখা যাবে এমনটাই স্বাভাবিক। তবে অপরাধের মাত্রা ও বিচিত্রতায় ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। কোন কোন সমাজে দেখা যায় কিশোররা সহিংস অপরাধ করছে প্রতিনিয়ত। আবার কোন জায়গায় কিশোরদের চুরি, ছিনতাই, মাদক পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে দেখা যায়। মূলত স্থানিক বৈশিষ্ট্য, অপরাধের সুযোগ, নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা, সামাজিক কাঠামো ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে অপরাধ এবং অপরাধীর তারতম্য হয়ে থাকে। ফলে আমাদের সমাজব্যবস্থাও অপরাধ এবং অপরাধীর বাইরে নয়। অর্থাৎ সমাজে এমন কিছু অনুষঙ্গ ও পরিস্থিতির তৈরি হয় যার প্রেক্ষিতে অপরাধ করার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে থাকে এবং সেসবের সুযোগ নিয়ে থাকে অপরাধীচক্র। সেক্ষেত্রে সমাজকে অপরাধীর কালোহাত থেকে দূরে রাখার প্রত্যয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সমাজ কাঠামো এমনভাবে বিনির্মাণ করতে হবে যে কাঠামোতে অপরাধীদের অপরাধ করার তেমন সুযোগ থাকবে না। সমসাময়িককালে বাংলাদেশে মোবাইল ছিনতাই একটি স্বাভাবিক ঘটনা। হরহামেশাই এ সংক্রান্ত ঘটনা গ্রাম এবং শহর উভয় জায়গায় ঘটে চলছে। সেদিকে দায়িত্বশীল কারোর নজর দেয়ার সুযোগ নেই কিংবা এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে এমন সময়ও অনেকের হয়ে ওঠে না। কিন্তু মোবাইল ছিনতায়ের ঘটনা যখন স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রীর ক্ষেত্রে ঘটে তখন সেটি আর আলোচনার মধ্যে থাকে না। বিষয়টি সমালোচনার জায়গায় চলে যায়। কারণ মন্ত্রীর মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার চিত্রও সামনে চলে আসে। স্বাভাবিকভাবে মন্ত্রীরা প্রটোকল নিয়ে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত। প্রটোকল অর্থাৎ পুলিশ প্রহরারত অবস্থায় মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনাটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন অবস্থাকেই নির্দেশ করে থাকে। যেখানে সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির নিরাপত্তা বিঘিœত হয় সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে ভয় এবং আতঙ্কের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক। শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে প্রকৃত অর্থে ছিনতাই কেন হয়? এক কথায় যদি উত্তর দেয়া যায় তাহলো ছিনতাই করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে, ছিনতাই করতে আগ্রহী এমন মানসিকতার একশ্রেণীর অপরাধী তৈরি হয় এবং সর্বোপরি প্রকৃত মালিকের রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায় কিংবা মালিক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অপরাধীরা সুযোগটি লুফে নেয়। প্রতিটি অপরাধ সংঘটনের পেছনে এ তিনটি উপাদানের সমন্বয় ঘটে থাকে। বাংলাদেশে সচরাচর ছিনতায়ের যে বিষয়গুলো ঘটছে তার কার্যকারণ অনুসন্ধান করলে সহজেই অবগত হওয়া যায় উপর্যুক্ত তিনটি উপাদানের মেলবন্ধনের সমন্বয় ব্যতীত কোন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয় না। উঠতি বয়সী ছেলেরা বিশেষ করে ত্রিশ বছরের উর্ধে নয় এমন বয়সের ছেলেরা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। ছিনতাই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নারীরাও জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ঘটনাস্থলে ছেলেরাই মূলত ছিনতাই করে থাকে। করোনাকালীন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে তলানির দিকে চলে যাচ্ছে। কর্মহীন অসংখ্য মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামে অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হয়ে পড়ছে লক্ষ্যচ্যুত। অভাবের তাড়নায় হতাশাগ্রস্তরাও জঘন্য অপরাধের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। কোভিড-১৯ ও লকডাউনের সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলাদেশে শ্রেণী কাঠামোগত বৈষম্য আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। ‘দিন আনে দিন খায়’ এ শ্রেণীর মানুষের লেনদেনভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা ক্রমশ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে তুলেছে। ইতোমধ্যে নিঃস্ব হয়েছে অনেকেই, সঞ্চয় ব্যয় করে খাচ্ছে, মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তদের অবস্থা দিশেহারা। এক কথায় দেশের সামগ্রিক শ্রেণীকাঠামো পরিবর্তন হয়েছে, সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। কাজেই লকডাউনের ফলে বেকার হয়ে পড়া বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনমানের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ব্যতিরেকে ছিনতাই ও অন্যান্য সামাজিক অপরাধ থেকে সমাজকে মুক্ত রাখা প্রায় অসম্ভব। অপরাধবিদদের মতে নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোররা স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। কেননা, পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ তাদের ওপর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তুলনায় কিয়দংশ হলেও কম রয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানকে বিবেচনায় নিয়ে সামনে পা ফেলতে হয় এবং ওই পরিবারের সদস্যরা সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহে সম্পৃক্ত থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজেই কিশোর অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়া অধিকাংশ তরুণ-তরুণী নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। আবার করোনাকালীন শ্রেণীকাঠামোর যে বিভাজন সেখানে একটা বিশাল শ্রেণী নিম্নবিত্তে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ছিনতাইয়ের ঘটনা করোনাকালীন বৃদ্ধি পাবে এটি সহজেই অনুমেয়। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা সহজে সমাজকে পরোয়া করে না। সমাজ যদি তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় তারাও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত না থেকে অপরাধ কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। মোদ্দাকথা হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরের সর্বশ্রেণীর মানুষকে সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। কেননা, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা যেমন করে বৃদ্ধি পায়, ঠিক তেমনিভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেও তাদের সহজেই আবদ্ধ রাখা যায়। অন্যদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীরা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য নানাভাবে অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকে। বিশেষ করে করোনার মহামারীতে ব্যাপকহারে শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে এবং এরা সংঘবদ্ধভাবে অপরাধে সক্রিয় হয়ে উঠছে এবং এ বয়সের শিক্ষার্থীদের আইন অমান্য করার ক্ষেত্রে উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়। উল্লিখিত বিষয়গুলো ছিনতাই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং প্রত্যেকটি বিষয়ের ব্যাপারে যথাযথ নজরদারি জরুরী। ছিনতাই হয়ে যাওয়া মোবাইল পুলিশ উদ্ধার করতে পারছে না ঢালাওভাবে এমন অভিযোগ করা যাচ্ছে না, কিন্তু উদ্ধারের হার খুবই কম। আবার এও স্বীকার করতে হবে যে, পুলিশের কাজের চাপ এবং কাজের ধরনের বহুমাত্রিকতা বিবেচনায় ছিনতাই হয়ে যাওয়া মোবাইল উদ্ধার করার বিষয়ে যথাযথ নজরদারি করতে পারছে না। আবার হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ট্র্যাক করতে যে ধরনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন তা সব থানায় সহজলভ্য নয়। মোবাইলের সিবিআর উদ্ধারের জন্য অভিযোগের কপি ঢাকাস্থ অফিসে পাঠাতে হয়। সারাদেশ থেকে আবেদনের পরিমাণ বেশি থাকায় যথার্থ সময়ে মোবাইল ট্র্যাক করার বিষয়ে কার্যত তেমন ফল পাওয়া যায় না। পাশাপাশি অপরাধীরা মোবাইলের আইএমইআর নম্বর পরিবর্তন করার কারণে মোবাইল উদ্ধার করা মুশকিল হয়ে পড়ে। আবার এমনও দেখা যায়, ছিনতাইয়ের অভিযোগগুলো পুলিশ ফেলে রাখে। অধিক তদন্ত করার ক্ষেত্রে কোনরূপ আগ্রহ দেখায় না। কাজেই অভিযোগ দায়েরের পর পুলিশকে বারবার তাগাদা দিতে হয় এবং এ কাজটি অনেক ভুক্তভোগীই সহজে করতে পারেন না। কেননা, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পুলিশ-পাবলিকের মধ্যকার দূরত্বের ধারাবাহিকতায় উদ্ধার কাজের ব্যাপারে তদবির করা সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে-মধ্যে এমনও অভিযোগ পাওয়া যায়, সাহায্যপ্রার্থী তথা ভুক্তভোগীর নিকট ঘুষ দাবি করা হয়। কাজেই দায়েরকৃত অভিযোগের তুলনায় উদ্ধারকৃত মোবাইলের হার খুবই কম। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের মোবাইল ফোন উদ্ধারকাণ্ডে পুলিশের যে প্রোএ্যাকটিভ ভ‚মিকা দেখা গেছে তা খুবই আন্তরিক ও ইতিবাচক। বিষয়টি খুবই ফলপ্রসূ হতো যদি যে কোন সাধারণ মানুষের মোবাইল হারানোর পর থানায় অভিযোগ দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে এহেন স্বতঃস্ফ‚র্ততা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ হতে প্রত্যাশা করা যেত। এমন পুলিশিং সাবকালচার তৈরি করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্যোগী হতে হবে এবং এক্ষেত্রে পুলিশকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পুলিশ হবে জনবান্ধব, যেখানে পুলিশের সঙ্গে পাবলিকের মধ্যকার দূরত্ব থাকবে না। ছিনতাই প্রক্রিয়াটি একটি চক্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। কেননা, ছিনতাইকারীরা যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এবং যেখানে মোবাইল ফোন কেনাবেচা হয় সেখানকার এজেন্টদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এমনও অভিযোগ পাওয়া যায়, ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারও কারও যোগসাজশ রয়েছে। কেননা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর ফাঁকি দিয়ে অপরাধ করা দুষ্করই বটে। এখনও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ^াস করে পুলিশ বাহিনী যদি নিরপেক্ষভাবে সততার সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ অচিরেই অপরাধমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। ছিনতাই প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের সচেতনতা ও ঐক্যের বিকল্প নেই। চোখের সামনে মোবাইল ছিনতাই করে ছিনতাইকারী পালাচ্ছে, এমন অবস্থায় অন্যরা প্রতিরোধ করার জন্য সামনে এগিয়ে এলে ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা সহজ হয়। বিশেষ করে গাড়ি থেকে মোবাইল ছিনতাই করার প্রাক্কালে সাধারণ নাগরিকরা যদি সামনে থেকে এসে প্রতিরোধ করার সৎসাহস দেখায় তাহলে ছিনতাইকারীরা উপর্যুপরি অপরাধ করার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, অপরাধটি আমার সঙ্গে না হলেই হয়। আমি নিজে কোনক্রমে নিরাপদে থাকলেই হলো- এমনটা ভেবে সচরাচর চোখের সম্মুখে ঘটে যাওয়া অজ¯্র অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকি আমরা। ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করি না চলমান পরিস্থিতি বহমান থাকলে আমরা যে কেউই আক্রান্ত হতে পারি। কাজেই, যে কোন অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে বলা যেতে পারে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, বিশেষ করে ছিনতাইকারী চক্রকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসতে হবে। ছিনতাইকারীর পক্ষে যে বা যারা সুপারিশ করতে যাবে তাদেরও আইনের নিকট সোপর্দ করতে হবে। কাজেই অপরাধ প্রতিকার এবং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আধুনিক ও যথোপযুক্ত ভূমিকা ব্যতিরেকে ছিনতাইকারী চক্রকে দমানো সম্ভব হবে না। পরিশেষে বলা যায়, ছিনতাই করার সকল সুযোগ সামাজিকভাবে বিনষ্ট করে দিতে হবে। অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক গণআন্দোলন তৈরি করতে হবে। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়
×