ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভ্যাক্সিনেশন জটিলতা ও করোনা সঙ্কটে করণীয়

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ২০ জুন ২০২১

ভ্যাক্সিনেশন জটিলতা ও করোনা সঙ্কটে করণীয়

ভ্যাকসিন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক কথা বলায় এবং বহুদিন যাবত টিকা প্রদান বন্ধ থাকায় মানুষের মনে সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যার প্রতিদিন হ্রাস-বৃদ্ধি এই শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই শঙ্কার হাত থেকে কবে কখন মুক্তি পাওয়া যাবে আকার-ইঙ্গিতেও তা বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। অপরদিকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যাপারে সরকারী পদক্ষেপ প্রয়োজনের তুলনায় এখনও ভয়ানকভাবে অপ্রতুল। দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের কথা বহুদিন থেকে শোনা গেলেও বাস্তবে কাজ যে আদৌ এগোয়নি তা অতি সহজেই বোঝা যায়। এবারের বাজেটে এই ভ্যাকসিন দেশে উৎপাদনের জন্য বিশেষ কোন অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে কিনা সুষ্পষ্টভাবে তা বোঝা যায়নি। তবে হয়ে থাকলে ভাল। কিন্তু তাহলে টিকা তৈরির কাজ কতদিনে সুরু হবে, কতদিনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি হবে, কতদিনে বিশেষজ্ঞরা তা নিয়ে সেটি মানুষের ওপর পরীক্ষা শুরু করতে পারবেন, উৎপাদিত পণ্য মানসম্মত হবে কি না, তার প্রাণীদেহে প্রয়োগ এবং অবশেষে সে প্রয়োগ সফল হলে মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি কতদিনে পাওয়া যাবে, পাওয়ার পর তা সফল হলে তার বাজারজাতকরণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনইবা কতদিনে পাওয়া যাবে- এসবই অস্পষ্ট। অপরদিকে ভারতের সঙ্গে এ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি আংশিকভাবে পালনের পর আর কোন বিকল্প উৎস সময়মতো অনুসন্ধান ও চুক্তি না করা ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হয়েছে। বলতে গেলে টিকাদান কার্যকলাপ প্রায় বন্ধই হয়ে রয়েছে। চীন যে কয়েক লাখ ডোজ উপহার হিসেবে দিয়েছেতার একাংশ এদেশে কর্মরত চীনাদের জন্য সংরক্ষিত রাখার পর হয়ত আরও কয়েক লাখ ডোজের মতো বাংলাদেশের নাগরিকদের দেয়া হবে। দুই ডোজ করে প্রত্যেককে দেয়ার ফলে ওই ভ্যাকসিন মাত্র দুই লাখ লোককে দেয়া যাবে। ভারতের যে ভ্যাকসিন এসেছিল তা সম্ভবত ৬০ লাখের মতো মানুষকে দুই ডোজ করে দেয়া সম্ভব হয়েছে। ফলে এ যাবত মাত্র এক কোটির কম মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। অতঃপর, চীনের সঙ্গে দেড় কোটি ডোজের যে চুক্তি হয়েছে স্বাস্থ্য অধিফতরের অতি উৎসাহী কর্মকর্তার দায়িত্বহীন উক্তির ফলে তা যথাসময়ে সম্পন্ন হতে পারেনি। সংবাদমাধ্যম সূত্রে যতদূর জানা যায় তাতে বাংলাদেশ সরকার এটি স্বীকার করে এবং ভবিষ্যতে আর এমন কিছু ঘটবে না বলে নিশ্চয়তা দিয়ে চীন সরকারকে পত্র লিখেছে যার কোন সদুত্তর আজও না মেলায় চুক্তি স্বাক্ষর আদৌ হবে কি না বা হলে কবে নাগাদ হবে তা জানা যাচ্ছে না। তবে জানা গেল শীঘ্রই নাকি চীন থেকে আরও টিকা উপহার হিসেবে আসছে। যদি আসে তবে তা দিয়ে আরও কয়েক লাখ লোককে টিকা দেয়া যাবে এবং তা যদি হয় তবে মোট টিকাপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা আরও বাড়বে। তবে আশার কথা এই যে, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে টিকা আমদানির বিষয়টি চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই অনিশ্চয়তা এবং এতদিনে মাত্র প্রায় ৭০ লাখ মানুষের টিকাদান, বাদ বাকি বারো কোটি (শিশুদের বাদ দিয়ে) মানুষকে টিকা দিতে যে আরও কতদিন লাগবে তা কল্পনায় আনতেও শিউরে উঠতে হয়। তবু স্তাবকদের স্তাবকতা থেমে নেই, বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ সরকার যে অসাধারণ দক্ষতা ও আন্তরিকতা দিয়ে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ‘সাফল্য দেখালো’ তাদের মতো গোটা বিশ্বে এমন নজির নেই বললেই চলে। মৃত্যু ও সংক্রমণের দৈনন্দিন প্রকাশিত তথ্যে অবশ্য সত্যই দেখা যায়, অপরাপর দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা সংকমণ ও করোনায় মৃত্যু অনেক কম। কিন্তু এই তথ্য কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। যেমন- অপর দেশগুলোতে বিনা পয়সায় প্রায় শতভাগ মানুষের করোনা টেস্ট করা বাধ্যতামূলক এবং এ কাজটি সব দেশই কমপক্ষে ৯০ ভাগ ইতোমধ্যেই শেষ করেছে। অনেক দেশ শতভাগ সম্পন্ন করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে করোনা টেস্ট করাটাই হলো প্রাথমিক কাজ। আর সেই কাজটি আমাদের দেশে আজও চরমভাবে অবহেলিত। বহু জেলা আছে যেখানে টেস্টিং কিট সরবরাহ নেই প্রয়োজনানুরূপ। আবার টেস্টিং কিট থাকলেও সেই নমুনা পরীক্ষার জন্য ভিন্ন জেলায় নমুনা পাঠাতে হয়। ফল আসতে সময় লাগে তিন থেকে সাতদিন। এই গেল জেলাগুলোর চিত্র। কিন্তু উপজেলাগুলোর কথা তো মনে হয় কারও হিসাবেই নেই। সেখানে কিটসের প্রচণ্ড অভাব। দারিদ্র্যের কারণে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার শক্তি তাদের নেই। আর পিসিআর ল্যাব? তা হলো স্বপ্নের জিনিস। অথচ প্রতি উপজেলায়ই ওষুধ থাক বা না থাক, ডাক্তার-নার্স প্রয়োজনমতো থাকুন বা না থাকুন, ৩০ শয্যার হাসপাতাল ঠিকই আছে। করতে চাইলে পিসিআর ল্যাব প্রতি উপজেলা হাসপাতালগুলোতেই বসানো যায়। গ্রামের লোকের কি করোনা হয়? সম্ভবত সবাই বা অনেকেই ভাবেন গ্রামে তো করোনা নেই। এমন ধারণ বিস্ময়কর। এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। একটি কারণ অবশ্য উল্লেখ করা যায়, গ্রামের মানুষ কায়িক পরিশ্রম অনেক বেশি করেন। পরিবেশ দূষণও অপেক্ষাকৃতভাবে কম। টাটকা শাক-সবজি খেত থেকে তুলে খেতে পারেন। ফলে তাদের দেহে করোনা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম থকে। তবে বর্তমানে এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। এ ধারণা আংশিক সত্য হলেও করোনা যেহেতু একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ, গ্রামাঞ্চলে যেহেতু মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রশ্নও ওঠে না। কারণ সপ্তাহের প্রায় সাতদিনই তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে নানা হাট-বাজারে যেতে হয়। সেহেতু তাদের কাছে দূরত্বের প্রশ্নটি অবান্তর। কিন্তু করোনা প্রতিরোধে এগুলো আবশ্যিক। তদুপরি আজও ঘনঘন সাবান জলে হাত ধোয়া, বাইরে থেকে এসে পরনের যাবতীয় পোশাক আধঘণ্টা সাবান জলে ভিজিয়ে রাখা এবং স্থান না করে ঘরে ঢোকা, স্যানিটাইজার ব্যবহার না করার চিত্র গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র। অথচ সেখানেই মোট জনসংখ্যার ৮৫ ভাগের বাস। এমতাবস্থায় বিশাল গ্রামাঞ্চলে প্রতিদিন যে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটছে তাদের মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করারও কোন সুযোগ নেই। ফলে বিষয়টি জরুরীভিত্তিতে ভেবে এবং করোনা মোকাবেলার বিজ্ঞানসম্মত আয়োজনের যে প্রচণ্ড অভাব দেশজুড়ে আজও বিরাজ করছে সেই অভাব পূরণ না করে আত্মতুষ্টি প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। যেহেতু ৯০ ভাগ মানুষ এখনও করোনা পরীক্ষার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন, তাই স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রচারিত প্রতিদিনকার করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা যে এ ব্যাপারে পূর্ণ সত্য প্রকাশ করে না তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং কার্যকরভাবে করোনা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন- এক. দ্রæততম সময়ের মধ্যে সকলের করোনা বিনামূল্যে পরীক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে সম্পন্ন করা; দুই. প্রতি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা হাসপাতলগুলোতে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা; তিন. প্রতি জেলা ও উপজেলার সরকারী হাসপাতালগুলোতে পিসিআর ল্যাব যথেষ্ট সংখ্যক প্রতিষ্ঠা করে দ্রæততার সঙ্গে ফল জানার ব্যবস্থা করা; চার. উপজেলা হাসপাতালগুলোতে কমপক্ষে ২০ শয্যা এবং জেলা হাসপাতালগুলোতে ন্যূনতম ৫০ শয্যাবিশিষ্ট করোনা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা এবং উপজেলা হাসপাতালে কমপক্ষে ৪টি করে ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ন্যূনতম ২৫টি করে আইসিইউ বেড স্থাপন, যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন সকল হাসপাতালে সংরক্ষণের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরী। পাঁচ. করোনা ভ্যাকসিন অতিশয় দ্রæততার সঙ্গে কমপক্ষে ৫ কোটি ডোজ আমদানি করা এবং দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের যাবতীয় ব্যবস্থা অত্যন্ত দ্রæততার সঙ্গে শেষ করা; ছয়. একই সঙ্গে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে দুর্নীতি ও অব্যবস্থা বিরাজ করছে কঠোরহস্তে তার উৎপাটন করা। নইলে সব ইতিবাচক প্রচেষ্টা ভেস্তে যেতে পারে। লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক [email protected]
×