ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ২২:২১, ১৯ জুন ২০২১

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা

অপূর্ব কুমার ॥ রাজধানীসহ সারাদেশে দ্রুত ছড়াচ্ছে করোনা। ডেল্টা ধরনের অতি সংক্রমণের ক্ষমতা ও মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার উদাসীনতায় মারাত্মক আকার ধারণ করছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউটি। সতর্ক না হলে দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুক্রবারে সারাদেশে দুই মাসে শনাক্তের হারের দিক দিয়ে সর্বোচ্চ সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। গত ১ ও ২ জুন সারাদেশে করোনা পরীক্ষায় নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ১০ শতাংশ। ৩ জুনে তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৮ শতাংশে। ৪ জুন তা ফের বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশে। ৫ জুন তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ শতাংশ। পরপর ৬ ও ৭ জুন একই হারে সংক্রমণ ঘটে। ৮ জুন তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশে। ৯ জুনও ১২ শতাংশ হারে সংক্রমণ ঘটে। ১০ জুন মোট ১৩ শতাংশ হারে সংক্রমণের ঘটনা ঘটে। ১১ জুন নমুনার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ১৩ শতাংশ। ১২ জুন সংক্রমণের হার ছিল ১৪ শতাংশ। ১৩ জুন রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৩ শতাংশ। ১৪ জুন রোগী শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ। ১৫ জুন কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৪ শতাংশে। ১৬ জুন করোনা শনাক্তের প্রায় ১৭ শতাংশে পৌঁছে যায়। ১৭ জুন ফের কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে। তবে ১৮ জুন নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। যা প্রায় দুই মাসের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯ এপ্রিল প্রায় ১৯ শতাংশ সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, বিভাগওয়ারি রাজশাহী ও খুলনাতে সংক্রমণের হার বেশি। সীমান্ত জেলাগুলোর হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। সেই হিসাবে তুলনামূলক রাজধানী ঢাকাতে চাপ কিছুটা কম আছে। তবে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে। নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, পরিস্থিতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সেটি নির্ভর করছে বিদ্যমান যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রয়েছে সেই অনুপাতে রোগীর সংখ্যার ওপর। আমাদের যা সক্ষমতা রয়েছে, সেই মুহূর্তে ৭ হাজার ডেডিকেটেড শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। সেখানে যদি রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার হয়ে যায়, তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিবেদনে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩ হাজার ৮৮৩ জনের করোনা শনাক্ত হওয়ার কথা জানানো হয়েছে। নমুনার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। যা আগের দিন ছিল ১৫ শতাংশ। একদিনেই হঠাৎ করেই ৪ শতাংশের ওপর করোনা শনাক্তের হার বাড়া যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। দেশব্যাপী করোনার সংক্রমণ বাড়লেও সেই হারে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়েনি। তবে যতটুকু পরীক্ষার হার বেড়েছে, তাতেই শনাক্তের হার বেড়েছে। দেশের ৬৪ জেলার গত ৪৮ ঘণ্টার পরীক্ষার রিপোর্টে তুলনামূলক চিত্রে এটা পর্যবেক্ষণ করা যায়। তাতে এও দেখা গেছে, যে পরীক্ষার হার কমে গেলে শনাক্তের হারও কমে যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু এলাকায় কম পরীক্ষার মাঝেও বেড়ে যাচ্ছে রোগী শনাক্তের সংখ্যা। এছাড়া দিনাজপুর, সিলেট, নীলফামারী, নোয়াখালী, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরে উর্ধমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো তো আছেই। টাঙ্গাইলে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৪৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তের এই হার ৪৩.২৮ শতাংশ। শুক্রবার জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এ নিয়ে জেলায় এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৯৭০ জনের করোনা শনাক্ত হলো। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের মধ্যে টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় আছেন সর্বোচ্চ ৮২ জন, কালিহাতীতে ৩৪ জন, মির্জাপুরে নয়জন, দেলদুয়ারে চারজন, ধনবাড়িতে ১৪ জন ও ভূঞাপুরে দুজন। রাজশাহী বিভাগে রেকর্ড রোগী শনাক্ত ॥ রাজশাহী বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ডসংখ্যক করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৮১৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর আগে ১০ জুন বিভাগে একদিনে সর্বোচ্চ ৮১৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। নতুন ৮১৮ জন নিয়ে বিভাগে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৮৮৯। শুক্রবার দুপুরে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নাজমা আক্তার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজশাহী বিভাগে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত ৪ হাজার ৪৫০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৮১৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আরটি-পিসিআর, র‌্যাপিড এ্যান্টিজেন ও জিন এক্সপার্ট এই তিন পদ্ধতিতে এসব নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর আগের দিন ৪ হাজার ২৯০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬৪৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ছিল ১৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার বেড়েছে। খুলনা বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সংক্রমিত হয়ে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৩৩ জনের। গত বছরের ১৯ মার্চ বিভাগে প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রথমবারের মতো ২৪ ঘণ্টায় এক হাজারের ওপর করোনা শনাক্ত হলো। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের ১০ জেলায় আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১ হাজার ৭২৪টি, র‌্যাপিড এ্যান্টিজেন পরীক্ষা হয়েছে ৭৩০টি এবং জিন এক্সপার্ট পদ্ধতিতে ৭১টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই ৩ পদ্ধতিতে মোট ২ হাজার ৫২৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ৩৩ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ। আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪৪৭টি নমুনা বেশি পরীক্ষা হয়েছে। আগের দিন শনাক্তের হার ছিল ৩৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। এর আগে গত বুধবার একদিনে সর্বোচ্চ ৮১৮ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। করোনা রোগী বেড়ে যাওয়া নিয়ে সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেছেন, ঈদের পরপর সীমান্ত এলাকায় করোনার যে প্রকোপ শুরু হয়েছিল, তার প্রভাব পড়েছে রাজধানীসহ অন্যান্য জেলায়। ধীরে ধীরে বন্যার মতো এটা ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসাসহ নানা কারণে মানুষের ঢাকামুখী হওয়া এখানে প্রভাব রেখেছে। মুশতাক হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, যারা পাসপোর্ট নিয়ে ভারত থেকে এসেছেন তাদের হয়ত প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে যারা সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা সেভাবে হয়নি। এটাও ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সংক্রমণ বৃদ্ধির একটা বড় কারণ হতে পারে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় তুলে ধরে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, করোনা শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। জনসমাগম যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটি হলো করোনার টিকা দেয়া। কিন্তু টিকা যেহেতু সবাইকে দেয়া যাচ্ছে না, সে কারণে আমাদের অন্য উপায়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। করোনা রোগীদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে এলাকায় এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক তৈরি এবং হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এই বিশেষজ্ঞ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুযায়ী, কোন দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা তা বোঝার একটি নির্দেশক হলো রোগী শনাক্তের হার। কোন দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম নতুন করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়। পরে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। গত বছরের শেষ দিকে এসে সংক্রমণ কমতে থাকে। এ বছরের মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ আবার বেড়ে যায়। মার্চের প্রথমার্ধেই দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হাজারের ওপরে চলে যায়। বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যাও। গত ২৬ মার্চের বুলেটিনে আগের ২৪ ঘণ্টায় ৩৪ জনের মৃত্যুর খবর দেয়া হয়, সেখানে ১৯ এপ্রিলের বুলেটিনে আগের ২৪ ঘণ্টায় ১১২ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ওই দিনই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় ৫ এপ্রিল থেকে মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যা এখনও বহাল। এ বিধিনিষেধের মাঝে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। গত ১৬ জুন সরকার বিধিনিষেধের সময় আরও এক মাস বাড়িয়ে দেয়।
×