ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চোটগ্রস্ত নও মুসলিম শাটলার তুষারের পাশে কেউ নেই!

প্রকাশিত: ২০:৩০, ১৮ জুন ২০২১

চোটগ্রস্ত নও মুসলিম শাটলার তুষারের পাশে কেউ নেই!

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের সন্তান। আমিও গোপালগঞ্জের ছেলে। অর্থের অভাবে আজ আমি নিজের চিকিৎসা করাতে পারছি না। অনেকের কাছেই সাহায্য চেয়েছি। কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি। আজ আমি দারুণ অসহায়। আমি অপারেশন করে সুস্থ হয়ে আবারও খেলতে চাই। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ দৈনিক জনকণ্ঠকে ব্যাকুল গলায় ফোনালাপে কথাগুলো জানান গাজী নূর আলম তুষার। তিনি এতজন শাটলার। গত ১১ বছর ধরে খেলছেন জাতীয় দলের হয়ে। গত ৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমস ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ খেলতে গিয়ে (একক বিভাগে) মারাত্নকভাবে আহত হন ২৫ বছর বয়সী ও গোপালগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার তুষার। বা পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায় তার। এজন্য তিনি দায়ী করেন পল্টনের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ ইনডোর স্টেডিয়ামের মাঠকে, ‘উডেন ফ্লোর দিয়ে নির্মিত মাঠ। কাঠগুলো ছিল ভাঙা। এগুলোর ওপর কার্টন দিয়ে তার ওপর ম্যাট বিছিয়ে দেন আয়োজকরা। সেটার ওপরই আমাদের খেলতে হয়। আমার মনে হয় এতকিছুর পরও ম্যাট দেবে গিয়েছিল, আর তার ওপর খেলতে গিয়েই আমার পায়ের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। ফলে সিরিয়াস ইনজুরিতে পড়ি। ওই আসরে শুধু আমি না, এমন ত্রুটিপূর্ণ ম্যাটে খেলতে গিয়ে আরও দুই শাটলার বড় ইনজৃরিতে এবং আরও কয়েকজন ছোট ইনজুরিতে পড়েন।’ কদিন আগে ভারতের হায়দরাবাদের এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে ২০১৩ বাংলাদেশ গেমসে ব্যাডমিন্টনের এককে তাম্রপদক জেতা তুষারের। তিনি জানিয়েছেন ইতোমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে পায়ে অপারেশনের। আর দেরি না করে মেডিক্যাল ভিসায় আগামী মাসেই ভারতে চলে আসতে বলেছেন। কিন্তু কিভাবে আসবেন তুষার? তার তো সেই সামর্থই নেই! লাঠিতে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে পাঁচতলা বাসা থেকে নেমে তুষারকেই বাজার করতে হচ্ছে। বাকি সময়টা বিছানাতেই পড়ে থাকেন আর একরাশ হতাশায় ভোগেন। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে জন্ম নেয়া তুষার তিন বছর আগে গোপনে হিন্দু থেকে (তখন নাম ছিল তুষার কৃষ্ণ রায়) মুসলমান হন। ২ ভাই, ১ বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। গত বছর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার বিষয়টি পরিবারকে জানান তুষার। পরিণামে পরিবার তার সঙ্গে সম্পর্কছেদ করে। ফলে ঠিকানা পরিবর্তন করতে হয় তুষারকে। ব্যাডমিন্টন খেলেই জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ আনসারে যোগ দেন। এসএসসি পাশ করে আর পড়তে পারেননি। মাস তিনেক আগে লাভ ম্যারেজ করেন। ব্যাডমিন্টনপ্রেমী স্ত্রী মেহেরুন্নেসা সুজানা (খুলনা নিবাসী) পাঁচ বছর আগে ইউটিউবে তুষারের খেলা দেখে মুগ্ধ হন। দুজনের প্রথম দেখা ২০১৯ সালে। তারপর পরিচয়, প্রেম ও সবশেষে পরিণয়। তুষারের পরিবার এ বিয়ে মেনে না নিলেও সুজানার পরিবার মেনে নিয়েছে। এখন এই দম্পত্তি খুলনার সোনাডাঙায় একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। কিন্তু চোটে পড়ে খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তুষারের আয়ও বন্ধ। ফলে বাসা ভাড়া দেয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছে। বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ধার করে চলছেন আপাতত। আর চিকিৎসার খরচ? তার কথা তো ভাবারই সাহস পান না তুষার। দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘যে আসরে খেলতে গিয়ে আহত হই, সেই আসরে আমি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে খেলেছিলাম। কিন্তু যাদের হয়ে খেলি, তারা আমাকে কোন চিকিৎসা খরচ দেয়নি। গত মে তে আমি ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন, অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশন এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর কাছে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে লিখিত আবেদন করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউই কোন সাড়া বা আশ্বাস দেয়নি। তবে চোট পাবার পরই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ১০ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন ফেডারেশনের সেক্রেটারি কবিরুল ইসলাম শিকদার।’ ২০০৪ সালে ব্যাডমিন্টনে হাতেখড়ি তুষারের। জাতীয় দলে অভিষেক এর তিন বছর পরেই। আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে পথচলা শুরু ২০১১ সালে। ওই বছরেই জাপানে অনুষ্ঠিত অল জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন তুষার এবং আইমান ইবনে জামান। তুষারের দাবি, ‘ওই টুর্নামেন্ট আমরাই এখন পর্যন্ত প্রথম ও একমাত্র অংশ নিয়েছি বাংলাদেশী হিসেবে।’ ২০০৮ সালে জাতীয় আসরে দ্বৈতে, ২০০৯ সালে এককে এবং ২০১২ সালে অ-১৯ জুনিয়রে একক ও দ্বৈতে স্বর্ণজয়ী তুষারের এখন আর্থিক সঙ্কটে ক্যারিয়ারটাই হুমকির মুখে। সুখের সময়ে সবাই পাশে থাকে, দূঃখের দিনে সবাই ভুলে যায়, এই নির্মম সত্যকে সঙ্গে নিয়েই দিনাতিপাত করছেন জাতীয় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় তুষার। কেউ এগিয়ে না এলেও প্রধানমন্ত্রী ঠিকই সাহায্য করবেন, এই আশাতেই বুক বেঁধেছেন তুষার।
×