ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গতিহীন মেরিন ফিশিং সেক্টর

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ১৭ জুন ২০২১

গতিহীন মেরিন ফিশিং সেক্টর

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সমুদ্রে মৎস্য আহরণে নিয়োজিত সব ধরনের ভেসেল ও ইঞ্জিন বোটের অপারেশনাল কার্যক্রমে প্রণীত সামুদ্রিক মৎস্য আইন-২০২০ অকার্যকর হয়ে আছে। ২০২০ সালের ১৬ নবেম্বর এ আইন সংসদে পাস হয়। দশদিন পর অর্থাৎ ২৬ নবেম্বর রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে ২০২০ সালের ১৯ নং আইন হিসেবে গেজেট নোটিফিকেশন হয়। কিন্তু নতুন প্রণীত আইন এ সেক্টরে প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ আইন অফিসিয়াল নোটিসের মাধ্যমে এখনও জারি করতে পারেনি। ফলে ১৯৮৩ সালের সেই পুরনো আইনেই রেজিস্টার্ড ২৫২ ফিশিং ভেসেলকে সেইলিংয়ের (সমুদ্র যাত্রা) অনুমতি প্রদান করা হচ্ছে, যা নিয়ে আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হয়ে আছে। অপরদিকে, রেজিস্টার্ড ফিশিং বোট রয়েছে ৬ হাজার। কিন্তু এ সেক্টরে আনরেজিস্টার্ড বোটের সংখ্যা এখন প্রায় ৫০ হাজারের কাছাকাছি। এর ফলে ব্যাপক জটিলতা ও গোঁজামিল নিয়েই এ সেক্টর চলছে। ফলে এ সেক্টরের উন্নয়ন ও গতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়ে আছে। এ সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, নতুন আইনে অসামঞ্জস্যতা, অস্পষ্টতা, অগ্রহণযোগ্যতা, বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতার একাধিক ধারা রয়েছে। যা নিয়ে দফায় দফায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এ সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো তাদের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু গত প্রায় সাত মাস ধরে এ জটিলতার অবসান হয়নি। মেরিন সেক্টর দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রেখে আসছে। এছাড়া রাজস্ব প্রদানেও এ সেক্টরের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু এ সেক্টর নিয়ে নতুন আইন করেও মন্ত্রণালয় অফিসিয়াল নোটিস জারি করতে পারছে না। সার্বজনীনতার বিপক্ষে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়া হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ সূত্রসমূহের মত রয়েছে। সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ২৬ নবেম্বর সামুদ্রিক মৎস্য আইন-২০২০ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভের পর নোটিস জারি করতে গিয়ে মন্ত্রণালয় জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। আইন প্রণয়ণকালে প্রারম্ভিক ভূমিকায় বলা আছে সকল স্টেকহোল্ডার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত গ্রহণ করে চলমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জনক্রমে নতুন আইন প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় তা পালন করেনি, বরঞ্চ অবজ্ঞা করেছে। এর কারণ হিসেবে সূত্র জানায়, এ আইনের প্রণয়ন পূর্বে স্টেকহোল্ডার মেরিন ফিশিং জাহাজ মালিক সমিতি, মেরিন ফিশিং জাহাজ অফিসার সংগঠন, মেরিন ফিশিং জাহাজ নাবিক সংগঠনের সঙ্গে কোন আলোচনা বা মত বিনিময় হয়নি। কোন মতামত নেয়া হয়নি। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তথা ফিশিং ভেসেল সার্ভে, নিবন্ধন, সার্টিফিকেশন, ম্যানিং কার্যক্রমের দায়িত্ব পালনকারী নৌপরিবহন অধিদফতর ও সংশ্লিষ্টদের পরামর্শও নেয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, অনৈতিকতার সঙ্গে জড়িতরা অসত্য ভিত্তির মাধ্যমে নতুন এ আইন প্রণয়ন করেছে নেপথ্যে। সূত্রমতে, প্রথমত আইনের শুরুতে গ্রহণযোগ্য শিরোনাম কার্যকারিতা বাস্তবায়ন উল্লেখ থাকে। কিন্তু আইনের গ্রহণযোগ্য শিরোনাম হয়নি। কোন ক্ষেত্রে এ আইন প্রযোজ্য বা কার্যকর হবে তাও বলা হয়নি। এছাড়া কিভাবে অফিসিয়ালি কার্যকর করা হবে তার কোন ব্যাখ্যাও নেই। এছাড়া এ আইনে আর্টিসনাল নৌযান, অনুমতিপত্র, ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, গভীর সমুদ্র, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরিচালক, বাণিজ্যিক ট্রলার, সামুদ্রিক মৎস্য জলসীমা, মৎস্য, মৎস্য নৌযান, যান্ত্রিক মৎস্য নৌযান, স্কিপার, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এলাকা ইত্যাদিতে অগ্রহণযোগ্য ও বিভ্রান্তিকর সংজ্ঞা যুক্ত করা হয়েছে, যা আইএমও, এফএও গাইড লাইনের আলোকে সংশোধনের অপরিহার্যতা রয়েছে। অথচ এ আইনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, কোন কর্তৃপক্ষ দ্বারা আইনটি বাস্তবায়িত হবে। তবে আইনের একটি ধারায় ফিশিং ভেসেল নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব মহাপরিচালক পালন করবেন মর্মে উল্লেখ করা আছে। অপর একটি ধারায় পরিচালককে লাইসেন্স ইস্যু করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অথচ, এ কর্মকর্তাদের নিয়োগ যোগ্যতা কি হবে এবং ফিশিং মেরিটাইম যোগ্যতা থাকবে কিনা এর কোন উল্লেখ নেই। ফলে এ আইন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ নিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে আছে। বর্তমানে মেরিন ফিশারিজ অফিস থেকে ফিশিং ভেসেল লাইসেন্সিং ও সেইলিং পারমিশন ইস্যু করা হয়। যেহেতু এ আইনে মেরিন ফিশারিজ অফিস প্রতিষ্ঠার এবং উপরোক্ত দুই বিষয়ে দায়িত্ব পালন করা সরাসরি প্রভিশন যুক্ত হয়নি, ফলে নতুন আইনের গেজেট নোটিফিকেশনের পর থেকে মেরিন ফিশারিজ অফিস আইনত অকার্যকর দফতরে পরিণত হয়েছে এবং তখন থেকেই এ অফিসের ফিশিং ভেসেল সেইলিং পারমিশন ইস্যু অধিকার রুদ্ধ হয়েছে। বিশেষজ্ঞ সূত্রে আরও জানানো হয়, এ আইনে স্থানীয় মৎস্য নৌযান, বাণিজ্যিক ট্রলার, আর্টিসনাল নৌযান ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন অভিধায় ফিশিং ভেসেলসমূহকে উপস্থাপন করতে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত ধূম্রজাল এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভ্রান্তির অবসানকল্পে বিশেষজ্ঞ মেরিনারদের সমন্বয়ে আইএমও এবং এফএও গাইড লাইনের আওতায় ধারাসমূহ পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। নতুন আইনের আরেকটি অধ্যায়ে বিদেশী জাহাজ দিয়ে মৎস্য আহরণের বিষয়াবলী যুক্ত হয়েছে পাঁচটি ধারায়। অথচ, বাংলাদেশে বিদেশী মৎস্য জাহাজের প্রবেশাধিকার নেই। ফলে এ অধ্যায়টি বাতিলযোগ্য। নতুন এ আইনের আরেক অধ্যায়ের ধারাগুলোতে অনভিপ্রেত এবং অগ্রহণযোগ্য ও আপত্তিকর কিছু বিষয় তথা ফিশিং ভেসেল মালিক, অপারেটর, স্কিপারসহ সংশ্লিষ্ট যে কোন ব্যক্তিকে কথিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে যখন তখন হয়রানি, নাজেহাল, বিনা ওয়ারেন্টে দÐ দেয়া ও জরিমানা করার মতো ক্ষমতা প্রদান একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষয় বলে এ সেক্টরে আলোচিত হচ্ছে। এসব ধারা সংযোজন করে সুষ্ঠু মেরিন ফিশিং অপারেশনাল কার্যক্রমকে ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের সঙ্গে তুলনা করে ১৮৯৮ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (ব্রিটিশ আমলের ক্রিমিনাল অফেনস) এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মাধ্যমে জাহাজ মালিক, অপারেটর, স্কিপার এবং সংশ্লিষ্ট যে কোন ব্যক্তিকে মেরিটাইম আইনে অগ্রহণযোগ্য কর্মকর্তা দিয়ে হয়রানি করার সুযোগ অবারিত করা হয়েছে। এ বিয়য়টি মেরিন ফিশারিজ সংশ্লিষ্ট চূড়ান্তভাবে অপমানজনক এবং মেরিন সেক্টরের শান্তিপূর্ণ অবস্থানকে ধংস করার ইঙ্গিতসম বলে অভিযোগ উঠেছে।
×