ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ॥ জানা-অজানা

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ১৭ জুন ২০২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ॥ জানা-অজানা

(গতকালের পর) আমি আরসি মজুমদারকে কবির দেয়া যে চিঠিটির প্রতিলিপির ছবি তুলে এনেছি সেটির তারিখ ১৬ মাঘ, ১৩৩২ বঙ্গাব্দ। এই তারিখটি ৩০ অথবা ৩১ জানুয়ারি, ১৯২৬-এর সঙ্গে মিলে যায়। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন- ওঁ কল্যাণীয়েষু, ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ৬ তারিখে রাতে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাঁদের আতিথ্য ভোগ করে কর্ত্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনমতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে। তাই দুই নিমন্ত্রণ ক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল। ইতি ১৬ মাঘ ১৩৩২। শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ড. বিশ্বজিত ঘোষ এর লেখা প্রবন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে জানা যায় কবি যখন ঢাকায় এলেন তখন ঢাকার সাধারণ মানুষ তাঁকে অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছিল। তিনি ঢাকার নবাবদের পারিবারিক নৌকা বা বোট এ বুড়িগঙ্গায় রাত যাপন করেছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে তাঁর সম্ম্যানে ঢাকার নবাববাড়ী ‘আহসান মঞ্জিলে’ এক চা চক্রের আয়োজন করা হয়েছিল। ১৬ মাঘ, ১৩৩২ সালে মি. আর সি মজুমদারকে পাঠানো পত্রের এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেছেন ‘ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্য দূত এসেছিলেন ... আরো উল্লেখ করেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনমতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে।’ চিঠির এই অংশের পূর্বে তিনি লিখেছেন ‘১০ তারিখ পর্যন্ত তাদের (ঢাকার লোকের) আতিথ্য ভোগ করে কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যলয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব।’ কবির লেখা এই পত্র থেকেই জানা যায় কবিকে ঢাকার সাধারণ মানুষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। তখনকার সময় ঢাকাকে প্িরতনিধিত্ব করার ক্ষমতা ছিল ঢাকার নবাবদের। দূত পাঠানোও তাদের দ্বারাই সম্ভব ছিল। কোন রাজনৈতিক নেতা বা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ হলে সেটা কবি তাঁর চিঠিতে অবশ্যই উল্লেখ করতেন। তবে রাজনৈতিকভাবেও তখন ঢাকার নবাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। ঢাকায় আগমন, মিউনিসিপ্যালিটির গণসংবর্ধনা, নবাববাড়িতে তাঁর নিমন্ত্রণ, তাদের বোটে রাত যাপন- এ সবই প্রমাণ করে যে ঢাকার মানুষ ও নবাবরা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যথাযথ সম্ম্যান দিয়েই বরণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ৭ ফেব্রæয়ারি, ১৯২৬ সাল (বাংলা ১৩৩২ সাল), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ঢাকায় আসেন তখন ঢাকার নবাব ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহর ছেলে খাজা হাবিবুল্লাহ। নবাব সলিমুল্লাহ ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় ইন্তেকাল করেন। খাজা হাবিবুল্লাহ ১৯১৫ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও কলকাতা উভয় জায়গাতেই একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে সম¥ানিত ছিলেন। শুধু ঢাকার নবাব হিসেবে নয়, ঢাকা আসন থেকে তিনি একাধিকবার বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯৩৭ সালে তিনি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন। তথ্যগুলো থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালে ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে যখন এখানে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে খাজা হাবিবুল্লাহর সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তিনি তাঁরই আতিথেয়তায় নবাববাড়িতে চা চক্রে অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব সলিমুল্লাহর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯১২ সালেই তিনি এ মহতী কাজে উদ্যোগী হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বেশ কিছু জমি দান করেন। কিন্তু একথাও সত্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীসহ আরও অনেকের অবদান রয়েছে। নবাব সলিমুল্লাহর সঙ্গে সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীসহ পূর্ববঙ্গের আরও অনেক হিন্দু ও মুসলিম ধনাঢ্য ব্যক্তিই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক সেটি আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন। সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্িরতষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন ১৯১৭ সালে। পরবর্তীতে ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিষয়ক আইন পাস হয় এবং ১৯২১ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ দান শুরু করে। তিনি গরিব মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদানের জন্য তখন ১৬,০০০ (ষোল হাজার) রুপী দান করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর জমিদারীর কিয়দংশ বন্ধক রেখে ৩৫,০০০ (পঁয়ত্রিশ হাজার) রুপী দান করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় মাত্র তিনটি হল নিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়। সেগুলো হলো মুসলিম হল, জগন্নাথ হল ও ঢাকা হল (বর্তমানে ড. মুহম¥দ শহীদুল্লাহ হল)। উল্লেখ্য, জগন্নাথ হল প্রতিষ্ঠায় মানিকগঞ্জ জেলার বালিয়াটির জমিদার কিশোরি লাল রায় চৌধুরীর অবদান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন। ১৯৩১ সালে মুসলিম হলের নাম সলিমুল্লাহ মুসলিম হল রাখা হয়। কিছু অন্তরায় সত্তে¡ও বাস্তবে পূর্ববাংলার হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই চেয়েছিলেন ঢাকায় যেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই উদ্যোগের বিরোধিতা যারা করেছিলেন তারা একেবারেই তাদের স্বার্থে এটি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনও এ ধরনের ক্ষুদ্র স্বার্থের সঙ্গে সহমত হবেন এটা যারা চিন্তা করেন, তাদের ইতিহাসের আরও গভীরে যেতে হবে। জানতে হবে আরও অনেক তথ্য। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাদেরকে আরও বেশি করে অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে হবে। ১৯২৬ সালে ঢাকায় কবিকে যে সকল প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সেদিন সংবর্ধনা দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ, মুসলিম হল ছাত্রসংসদ, জগন্নাথ হল, জগন্নাথ কলেজ, হিন্দু মুসলিম সেবা সংঘ, ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিসহ আরও অনেক। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন একথা যদি সত্যি হতো তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এত সংগঠন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ও গড়ের মাঠের কথিত সভার চৌদ্দ বছরের মাথায় কবিকে এত বিপুল আকারে সংবর্ধনা দিত না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কার্জন হলে ১০ ও ১৩ ফেব্রæয়ারি সমসাময়িক সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ঢাকার সুধী সমাজ তা বহুদিন স¥রণে রেখেছে। এখনও সেই বক্তৃতার অনেক বচনই বেশ প্রাসঙ্গিক। সর্বোপরি ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখ কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডক্টর অব লিটারেচার বা ডি’লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তবে কবি শারীরিকভাবে ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে এই অনুষ্ঠনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই ধরনের মানুষের কাছে অপছন্দের মানুষ। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পাকিস্তানী ভাবধারায় বিশ্বাসী তথাকথিত কিছু বাঙালী মুসলমান বুদ্ধিজীবী ও ঐ ভাবধারার রাজনীতি সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর মানুষ। তারা মনে করেন যে, রবীন্দ্রনাথ মুসলিম ধর্মীয় সংস্কৃতিবিরোধী ছিলেন। তাদের প্রধান যুক্তি হলো রবীন্দ্রনাথের গান ও সাহিত্যকর্ম মূলত হিন্দু প্রতিমা ও উপাসনা কেন্দ্রিক, তাই এটি মুসলিমবিরোধী একটি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান এবং তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, তখন পূর্ববঙ্গেও কিছু মুসলিম সাহিত্যিক সরকারের এ হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেছিল। ভাবতে অবাক লাগে যার গান আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যার গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত এবং যিনি ব্যক্তিজীবনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, তাঁকে বাংলাদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর কেউ কেউ কী করে হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেন? কি যুক্তিতে, কি তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন? অবশ্য গোঁড়া এবং অতিবাম ঘরানার কিছু রাজনৈতিক কর্মীও রবীন্দ্রনাথকে সামন্ত প্রভুদের প্রতিভূ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা করেন। তাদের মতে রবীন্দ্রনাথের গান এবং চিন্তা শ্রমজীবী মানুষের বিপ্লবী চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। এই উভয় শ্রেণীর মানুষের অতীত ভূমিকা বিশেষ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কোন কোন ইস্যুতে অতিবাম এবং ধর্মাশ্রয়ী চিন্তাবিদদের কর্মকাÐ ও লক্ষ্যবস্তু একই রকম পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে উল্লিখিত শ্রেণীদ্বয়ের চিন্তা-চেতনা অনেকটাই একইসূত্রে গাঁথা। যেহেতু রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তারা আনতে পারে না, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেছিলেন এ রকম একটি অসত্য ও ভিত্তিহীন তথ্য, এই উভয় শ্রেণীর মানুষই প্রচার করে। এর মাধ্যমে অল্প শিক্ষিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উস্কে দিয়ে ফায়দা লুটতে চেষ্টা করে। এক অংশ মনে করে, এই রকম একটি চিন্তা সাধারণ মানুষের মনোজগতে গেঁথে দিতে পারলে রবীন্দ্রনাথ মুসলিম বিরোধী ছিলেন এই কল্পিত তথ্যটি প্রতিষ্ঠা করা যাবে। অন্য অংশটি মনে করে, রবীন্দ্রনাথকে খাটো করতে পারলে প্রকারান্তরে সামন্ত প্রভুদেরই খাটো করা যাবে এবং শ্রেণীসংগ্রাম ত্বরান্বিত হবে। সব তথ্য ও ঘটনা একত্রে মিলিয়ে দেখা যাবে যে, প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ কখনও সামন্তপ্রভু হিসেবে তাঁর প্রজাদের সামনে আবির্ভূত হননি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহ, শাহজাদপুর বা পতিসরে জমিদারির কার্যকলাপ তদারকি করতে আসতেন, তখন তিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় শ্রেণীর প্রজাদের সঙ্গেই সমান আচরণ করতেন। রবীন্দ্রনাথ গরিব কৃষকদের কথা চিন্তা করেই পতিসরে তাঁর নোবেল পুরস্কারসূত্রে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। যাতে কৃষকরা সেই ব্যাংক থেকে নামমাত্র সুদ ঋণ গ্রহণ করে তাদের কৃষিকার্য পরিচালনা করতে পারে। গরিব প্রজার সন্তানদের পড়াশোনার স্বার্থে পতিসরে তিনি তার ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে ১৯৩৭ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যা এখনও কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউশন নামে স্বস্থানে বহাল আছে। স্কুলে হিন্দু-মুসলমান প্রজা উভয়ের সন্তানরাই সম অধিকারেই পড়াশোনার সুযোগ পেত এবং এখনকার মানুষও সে সুযোগ পাচ্ছে। যারা রবীন্দ্রনাথকে মুসলিমবিরোধী হিসেবে চিত্রিত করতে চান তারা হয়ত জানেন না রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে স্কুল অব ইসলামিক হিস্ট্রি অব কালচার নামে একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পরপরই। তিনি তার এ কাজে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন হায়দ্রাবাদের মুসিলম শাসক নিজাম-উল-মুলক উসমান আলীর কাছ থেকে। মোদ্দা কথা হলো, যারা রবীন্দ্রনাথকে মুসলিমবিরোধী বা হিন্দু হিসেবে তুলে ধরতে চান তারা বিষয়টি হয়তবা অজ্ঞতা থেকেই করছেন। ঢাকায় যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ হিন্দু-মুসলমান সকলের জন্যই উন্মুক্ত ছিল। পশ্চিমবাংলার মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলোর ছাত্ররা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করত। কলেজ স্তরে অবিভক্ত বাংলার ভাল ছাত্ররা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ত। ঢাকায় জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ থাকার পরও অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মেধাবী ছাত্ররা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে নয়ত ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়ন করত। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বেঙ্গল মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা আবুল হাশেম যিনি বর্ধমানের মানুষ ছিলেন, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার পিতা আবুল কাশেম কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং তিনি কংগ্রেসের একজন নেতাও ছিলেন। আবুল কাশেম পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে সদস্যও ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুরের মানুষ ছিলেন। তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন। তার মামা হাসান সোহরাওয়ার্দী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ সাল নাগাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর আরও অনেকেই হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা ছাত্র হিসেবে অধ্যয়ন করেছেন। তাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবেও যোগদান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বাঙালী উপাচার্য ছিলেন যথাক্রমে স্যার এ এফ রহমান ও রমেশ চন্দ্র মজুমদার (আর.সি মজুমদার)। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ উপাচার্য ছিলেন। এই দু’জন মহান শিক্ষাবিদ ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যোগদান করেন। স্যার এ এফ রহমান ও রমেশ চন্দ্র মজুমদার উভয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের এক বছর সময়কালের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফর রহমান তাঁর ছেলেকে স্কুল এবং কলেজ জীবনের শিক্ষা শেষে ঢাকার কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি করেছিলেন। শেখ মুজিব পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তখনকার সময় বৃহত্তর ফরিদপুরের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ যত সহজ ছিল, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ তত ভাল ছিল না। আগেই উল্লেখ করেছি, দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত একটু অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের পিতামাতা ছেলেদের কলকাতায় রেখে পড়াশোনা করাতে চাইতেন। এর মানে এটি দাঁড়ায় যে, যেখানে থাকা-খাওয়া, যাওয়া-আসা এবং পড়ালেখার পরিবেশ অনুক‚লে ছাত্ররা সাধারণত সেখানেই ভর্তি হতো। বাংলাদেশের সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান সবার ওপর। সাধারণত রাজশাহী বা চট্টগ্রামের কোন মেধাবী ছাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর যদি সাধারণ বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি হতে চায় তবে অনিবার্যভাবেই তার কাছে প্রথম পছন্দের থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঠিক একইভাবে যখন অবিভক্ত বাংলায় দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল, তখন যার যার সুবিধামতো পছন্দ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে কৃত সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা ইলেক্ট্রোরাল কলেজ তৈরির বিরোধী ছিলেন। কংগ্রেস দলগতভাবেও এই ‘কমিউনাল এওয়ার্ড’ বা সংখ্যলঘুদের ইলেক্টোরাল কলেজ আইনের বিরোধী ছিল। মুসলিম লীগ ছিল তার বিপরীতে এবং এই ‘কমিউনাল এওয়ার্ড’ বাতিলের আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ সম্পৃক্ত ছিলেন এবং তখন ভাইসরয়-এর কাছে এটি বাতিলের যে আপীল করা হয়, সেটিতে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন। এই ঘটনাটি ঘটে ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যে। প্রত্যেকটি মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক চিন্তার স্বাধীনতা আছে, যা রবীন্দ্রনাথেরও ছিল। তা নিয়ে আমাদের কোন মন্তব্য নেই। কিন্তু যে বিশ্বকবি বাঙালীদেরকে বৈশ্বিকভাবে একটি মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন সেই কবির বিরুদ্ধে একটি অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে যারা তাঁকে খাটো করতে চান, তারা প্রকারান্তরে নিজেরাই খাটো হন। তাদের এই ভিত্তিহীন ভাবনা প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক বাঙালী সমাজ নিঃসন্দেহে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসরে তাঁকে দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি’লিট উপাধি প্রদানের যে সনদপত্রের প্রতিলিপিটি আছে, তার নিচে সনদ প্রদানকারী হিসেবে উপাচার্য স্যার এ এফ রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে ডি’লিট উপাধি দেয়ার সিদ্ধান্ত স্যার এ এফ রহমানের একক সিদ্ধান্ত ছিল না, এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত। রবীন্দ্রনাথকে ডি’লিটি উপাধি দিয়ে যতটুকু ধন্য করা হয়েছে, তার চেয়ে সেদিন বহুগুণে ধন্য হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৩৬ সালে যে কয়জন মনীষীকে ডক্টর অব লজ, ডক্টব অব সাইন্স ও ডক্টর অব লিটারেচার বা ডি’লিট উপাধি দেয়া হয়, তাদের মধ্যে যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন স্যার জন এন্ডারসান, সাবেক চ্যান্সেলার অব এক্সচেকার (ব্রিটিশ রাজ), স্যার আবদুর রহিম, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, স্যার যদুনাথ সরকার, স্যার মোহাম¥দ ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘স্যার’ উপাধিতেও ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল সংঘটিত জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর কবি তাঁকে দেয়া ব্রিটিশ সরকারের এই উপাধি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যদিও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে তাঁর মৃত্যু অবধি ‘স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ বলেই সম্বোধন করত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে কোনদিন এই উপাধি প্রত্যাখ্যানের পর তা আর ব্যবহার করেননি। আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাঁদেরকে সম্মান সূচক ডিগ্রী প্রদান করে তাঁদের মধ্যে শুধু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ছিলেন নোবেল বিজয়ী। যাদের তালিকাটি উপরে উল্লেখ করা হলো তাদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তাদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সকলেই পাক-ভারত উপমহাদেশেরই সন্তান। কিন্তু তাদের কেউ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের মতো ব্রিটিশ সরকারের অমানবিক, পৈশাচিক আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন তার এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। এমনকি তাৎক্ষণিকভাবে কংগ্রেস নেতারাও তেমন জোড়ালো প্রতিবাদ করেননি। কাউকে খাটো করার জন্য বলছি না, তাঁরা সকলেই যোগ্যতার মাপকাঠিতে অনেক ওপরে। তবে ইতিহাসের সত্য সবার জানা থাকা প্রয়োজন। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যারা নিহত হয়েছিল তাদের প্রায় সকলেই ছিল শিখ ধর্মাবলম্বী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্যার উপাধি প্রত্যাখ্যান যেমন প্রমাণ করে তিনি একজন জমিদারশ্রেণীর মানুষ হয়েও ব্রিটিশ রাজের অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে পিছপা হননি; একইভাবে এটিও প্রমাণ করে যে, অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনায় সেদিন কবির প্রাণ কেঁদেছিল। তিনি নিরীহ মানুষ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন। কারণ তিনি নিজে ছিলেন একজন মহান মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক মানুষ। আমাদের দেশের প্রিয় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধন চিরদিন অটুট থাকবে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পথচলায় কবিগুরু থাকতেন সদা উজ্জ্বল। (সমাপ্ত) লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, আপীল বিভাগ
×