ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

সাইবার পথে তরুণী পাচার ও প্রতারণা এ্যাপ বন্ধ করুন

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১৭ জুন ২০২১

সাইবার পথে তরুণী পাচার ও প্রতারণা এ্যাপ বন্ধ করুন

সত্যি বলতে কি এটা গভীর হতাশা ও আশ্চর্যজনক বিষয় যে, কন্যা হয়ে জন্ম নেয়ার পর থেকে তার জন্য প্রাচীন যুগ বা আধুনিক যুগ কোন যুগই তাকে নির্যাতনের কোন পন্থা থেকে মুক্তি দিতে পারল না! অথচ মানবসভ্যতার কত উন্নতি সাধিত হয়েছে। কত রকম প্রযুক্তি, যন্ত্র মানুষের নতুন নতুন সেবা দিয়ে মানুষকে চমৎকৃত করে চলেছে। কিন্তু এই সবকিছুর পাশে মেয়ে সে শিশু হোক, তরুণী হোক, প্রৌঢ়-বৃদ্ধা-তার ওপর প্রাচীন পন্থার নির্যাতন চলতেই থাকছে। অবশ্য বলতে হয়, দরিদ্রের শিশু পুত্র, এমনকি যে যুবক শ্রমিক তার দৈহিক শ্রম বিক্রি করে পরিবারের অন্নের সংস্থান করে, সেও কোন না কোন রকম শ্রমদাসে পরিণত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এটা ভাবতে পারি না, এই যুগে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সেফটি ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে নামা তরুণ শ্রমিক বিষাক্ত গ্যাসে মারা যাচ্ছে না! সেফটি ট্যাঙ্কের ঢাকনা কয়েক ঘণ্টা আগে খুলে রাখতে কোন রাজমিস্ত্রি বা প্রকৌশলী বাড়ির মালিককে বলে দিতে পারে না? তার ওপর শ্রমিকের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার পদ্ধতিও বলে দেয়া দরকার। নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত শ্রমিকের নিজের এ জ্ঞান থাকার কথা নয়। তবে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবলে প্রায় প্রতিদিন ধনীর অট্টালিকার নির্মাণ শ্রমিক ছাদ থেকে, মই থেকে পরে মারা যেত না। অথচ রোজই এ ঘটনা ঘটছে! শুরুতে কন্যা শিশুর চিরকালীন এক মন্দ ভাগ্য তাকে সাথী করে যা নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের সংসারে সে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উড়িয়ে দিতে পারে না। স্বজন প্রতিবেশী, বখাটে, এমনকি ধনী পুরুষের হাত থেকেও শিশু, কিশোরী, তরুণীরা রক্ষা পায় না। গরিবের শিশু কন্যা ধর্ষিতা হবে না, এ যেন এক অলীক অসম্ভব স্বপ্ন! সংসারে পরিবারে ‘তেঁতুল হুজুর’ জাতের পুরুষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ক্ষমতাহীন কন্যাদের জন্য কঠিন। আবার কর্মস্থলে-দেশে হোক, বিদেশে হোক-তার ওপর দৈহিক ও যৌন নিপীড়ন যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণের ফলে সন্তান ধারণ বালিকা, কিশোরী, প্রবাসী নারী শ্রমিকদের জন্য কতটা বিশাল সমস্যা তৈরি করে সেটি তাদের বাবা, মা এবং সে নিজে ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করে না। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে অন্তত প্রশিক্ষণের সময় প্রবাসী নারী শ্রমিকদের এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শিক্ষা দিতে পারে। রাষ্ট্রকে নারীবান্ধব হতে গেলে দরিদ্র এবং সব শ্রেণীর নারীদের যৌন নির্যাতনসহ সব রকম নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নতুবা নারীবান্ধব রাষ্ট্র বা সরকার হওয়া সম্ভব হয় না। সম্প্রতি জনগণ ‘টিকটক’ নামের এ্যাপের মাধ্যমে সুন্দরী কিশোরী, তরুণীদের আকৃষ্ট করে বিদেশে চড়া দামে পাচার করে দিচ্ছে বলে জানতে পেরেছে। শুনে প্রথম মনে হয়েছিল, হয়ত দু’চারজন কিশোরী-তরুণী ওই নারী পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছে। কিন্তু পরে জানা যাচ্ছে, এই পাচারকারী হৃদয়-রাফি গ্রæপটি এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচ হাজার তরুণীকে দেশ থেকে বিদেশে পাচার করেছে! এরা পার্টি করার নাম করে তরুণীদের ক্রমে বর্ডারের কাছের কোন জেলায় নিয়ে যায়, যেখানে দু’পাশেই দুই দেশের দালালরা প্রস্তুত থাকে। তারপর হোটেলে তুলে চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন-দৈহিক ও যৌন নির্যাতন, চলে এর ভিডিও ধারণ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন। এরাও মানুষ আর যাদের ওপর চরম নির্যাতন করছে, তারা তাদের কাছে কিন্তু আর মানুষ গণ্য হয় না, হয় পণ্য- বিক্রির জন্য অন্যান্য প্রাণহীন পণ্যের সমান! ভাবা দুঃসাধ্য হলেও ভার্চুয়াল জগতে ‘টিকটক’ এ্যাপের মাধ্যমে বাস্তব দুনিয়ায় ঘটছে এসব ঘটনা! প্রশ্ন উঠেছে, নাচ-গানের পার্টির কথা শুনে দূরের কোন জেলায় এ্যাপের মাধ্যমে সদ্য পরিচিত অচেনা এক তরুণের সঙ্গে এসব তরুণী চলে যায় কেন? কেন ওরা অচেনা তরুণ তাদের প্রতি ভয়ঙ্কর ফাঁদ পাতছে-এমন সন্দেহ বা আশঙ্কা না করে তার সঙ্গে দূর যাত্রায় সম্মত হয়? তারা কি নারী পাচারের নানা রকম ফাঁদের কথা শোনেনি কোন দিন? নিশ্চয়ই শুনেছে। তারা কেউ বালিকা নয়। একটি বিষয়ে পাচারকারী এবং পাচার হওয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মিল রয়েছে। এরা স্বল্প শিক্ষিত, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, যাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল, খুব ঘনিষ্ঠ নয়, দারিদ্র্যের কারণে বাবা-মা, নানা শ্রমভিত্তিক কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। এরা শহরের বাসিন্দা, সরকারী শিক্ষাবৃত্তির আওতায় এরা পড়ে না। বেশি দিন লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ তাদের থাকে না। কেননা লেখাপড়ায় ফল ভাল করার পরিবেশ বাড়িতে তারা পায় না। লেখাপড়ায় যারা ভাল করে তারা শিক্ষা চালিয়ে যায়। তাহলে ওদের মন কি ধরনের বিনোদন পিয়াসী হয়? বাড়িতে টিভি সম্ভবত নেই। সিনেমা নেই, ছোট যন্ত্র, মোবাইল ফোনের পর্দায় এত সহজে অল্প টাকার বিনিময়ে এক অদ্ভুত সিনেমার মতো দৃশ্য শুধু দেখা যায় না, এতে অংশগ্রহণও করা যায়! সিনেমায় তো অংশ নেয়া অসম্ভব। কিন্তু এখানে নায়ক, নায়িকার সঙ্গে নায়ক-নায়িকাদের মতো নাচে অংশ নেয়া যায়! নিজেকে নায়ক-নায়িকার পার্যায়ে দেখা ওদের কাছে স্বপ্নসম হয়ে ওঠে। ভার্চুয়াল জগত তো বাস্তবে নেমে আসে, সেটা ওরা ভিডিও তোলার সময় দেখে। এর আকর্ষণ অন্য বিনোদনহীন দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের মলিন সবকিছুর ওপরে অগ্রগণ্য হয়ে ওঠে। ওরা খুব সহজে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের সহজ ও ভাল আয়ের চাকরি ও উন্নত জীবনের টোপটি থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারবে না, এটা খুব স্বাভাবিক। সবারই ইচ্ছা থাকে একটি ভাল বেতনের কাজ করে ভাল মানের জীবন ধারণ করা। এটা তো অবশ্যই যে কোন নাগরিকের অধিকার। কিন্তু ওরা নারী বলে ওদের যে ব্যবহার করা যায় ভোগ্যপণ্য হিসেবে, তা ওদের মনে আসে না। ওরা ‘টিকটকে’র রঙিন ভিডিওতে নিজেদের দেখে ভেবে নেয় ওদের পক্ষে ভাল আয়ের কাজ পাওয়া সম্ভব। এই ‘টিকটক’ হৃদয়-রাফির ঘটনার বছর চার পাঁচ আগে জানা গিয়েছিল দুবাইয়ের হোটেলে নাচের জন্য তরুণী পাচার হচ্ছে এবং তাদেরও একইভাবে নির্যাতন-ধর্ষণ করে হোটেলে নাচ ও যৌনকর্ম করতে বাধ্য করত কয়েক নারী পাচারকারী। এদের মধ্যে একজন বিখ্যাত নৃত্য পরিচালকের নামও জড়িত হয়েছিল এবং ওই ব্যক্তি শাস্তি পেয়ে জেলে অন্তরীণও ছিল! উক্ত দুই ঘটনায় এবং ‘লাইকি’সহ আরও ইন্টারন্যাট এ্যাপ ব্যবহার করে পাচারকারীদের লাখ লাখ টাকা আয়ের সংবাদ শোনা যাচ্ছে! অর্থাৎ এই নিম্নবিত্ত পরিবারের সুন্দরী তরুণীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধরে রাখতে না পারার কারণে এই তরুণীরা অনাকাক্সিক্ষত পথে পা বাড়াচ্ছে উন্নত জীবনের আশায়, যা তাদের দিতে পারত শিক্ষা এবং পেশাগত বৃত্তি বা কর্ম শিক্ষা। সেটিতে রাষ্ট্র ওদের ধরে রাখতে পারছে না! জানি, বর্তমানে বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও করোনা জনিত কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব চলছে। এর মধ্যে সরকারকে বার বার ধনী গার্মেন্টস মালিকদের প্রণোদনা দিতে হচ্ছে, যা এক বিশাল অঙ্কের অর্থ। তার পাশে টিকা কেনার জন্য রাখতে হচ্ছে বিপুল অর্থ। এদিকে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ চলছে অনেক বিশাল অঙ্কের মেগা প্রকল্প। তার সঙ্গে সরকারী সব রকম কর্মকর্তা-শিক্ষকদের বেতন হয়েছে দ্বিগুণ! তার ওপর সামাজিক সুরক্ষা খাতে লাখ লাখ মানুষকে সহায়তা দিতে গিয়ে রাখতে হচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। এই সামাজিক সুরক্ষা খাতে শহরের নিম্নবিত্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া তরুণ-তরুণীদের জন্য কোন ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা এসব পাচার ও প্রতারণা চলতেই থাকবে। যেহেতু রাষ্ট্র নাগরিকের অভিভাবক সে হিসেবে সমাজে নারীরা পুরুষের হাতে পর্যুদস্ত হওয়ার এসব ভয়াবহ অসম্মানজনক নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেয়ার কোন এক বা একাধিক পন্থা সন্ধান রাষ্ট্রকে করতে হবে। খুব সৃজনশীলভাবে এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান-কৌশলকে বিশেষত-শিক্ষাবিদদের, সমাজ চিন্তকদের সহায়তায় কিছু পথ উদ্ভাবন করা সম্ভব বলে মনে করি। এ ছাড়াও ইন্টারনেটে জুয়া খেলার মাধ্যমে তরুণদের এক বিশেষ ধরনের অর্থ আয়ের লোভের কাছে আসক্ত করে বিশাল আরেক প্রতারণার ক্ষেত্র তৈরি করেছে দেশী-বিদেশী প্রতারক চক্র। তারা হাতিয়ে নিচ্ছে সহজ সরল যুবকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা। কেন চলবে এসব চরম অন্যায় ও চরম প্রতারণার ফাঁদ? এ ছাড়াও ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়ে অতি দ্রæত মেয়েরা প্রতারকদের কাছে বিয়ের প্রতিশ্রæতি নিয়ে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে, যার পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ। কেননা, কম শিক্ষিত তরুণীরা নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না নিয়েই সম্পর্কে জড়িয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ছে, আসছে অনাকাক্সিক্ষত শিশু! সমাজে, পরিবারে এই অল্প শিক্ষিত তরুণী ও তার শিশু অতিরিক্ত বোঝা হয়ে ওঠে। গ্রামীণ বা শহুরে বস্তিতে, পাড়ায় নানা রকম ঝামেলার ওপর অতিরিক্ত এ বোঝা কোন পরিবারও নিতে চায় না। এরা কোথায় যাবে, ভেবে মন ভারাক্রান্ত হয়। এদিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নির্যাতিতা হয়ে শিশু সন্তান কোলে ফিরে আসছে যেসব তরুণী, তাদেরও ওই একই পরিণতি ঘটে। আরব মালিক ধর্ষণ করে তরুণী গৃহকর্মী গর্ভবতী হলে জেলে পাঠায়, সেখানে প্রসব হয়। চাকরি হারা তরুণীদের ফেরত পাঠায় দেশে! এই একবিংশ শতাব্দীতে এসব ঘটনায় মনে হয় বর্বর যুগের নারী বিরোধী অবস্থার কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। অন্তত মধ্যপ্রাচ্য সেই প্রাচীন যুগেই পরে আছে। অবশ্য আমাদের দেশেও গৃহকর্মী বালিকা, তরুণী হলেও অনেক গৃহকর্তার অসঙ্গত অন্যায় ধর্ষণ জনিত দৈহিক নির্যাতনের ঘটনাও কম ঘটে না। এক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষা ও রুচি এবং গৃহকর্মী বা যে কোন শ্রমজীবী তরুণীর প্রতি প্রাচীনপন্থা দৃষ্টিভঙ্গি এসব লজ্জাজনক ঘটনার জন্ম দেয়। পরিবারের সংঘটিত ঘটনাগুলো গৃহকর্ত্রীরা অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ করতে পারে বুদ্ধি ও কৌশল ব্যবহার করে। বর্তমানে জনগণ, বাবা, মা, যাদের বৃহত্তর অংশ এসব টিকটক, ভিডিও, ফেসবুক সম্পর্কে অজ্ঞ বা অসচেতন, তারা অসহায়। সুতরাং রাষ্ট্রকে এই বিপুলসংখ্যক তরুণ, তরুণীকে ইন্টারনেটে সংঘটিত অপরাধ, প্রতারণা থেকে সুরক্ষা দিতে অন্তত ‘টিকটক’, ‘লাইকি’ বন্ধ করে দিতে হবে। ইন্টারনেটে জঙ্গীদের ঘৃণা-বিদ্বেষ-মিথ্যা প্রচার, ভার্চুয়াল জুয়ার প্রতারকদেরও তৎপরতা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আসলে ভার্চুয়াল জগতেও পুলিশ নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়মিত নজর রাখতে হবে এবং প্রতারকদের দ্রæত বিচারের আওতায় আনতে হবে। দরিদ্র উন্নয়নশীল, বেশি জনসংখ্যার ও অল্প শিক্ষিত দেশে সাইবার অপরাধ বাস্তব অপরাধের অনুসরণে সৃষ্টি করেছে একদল প্রতারক। এসব বিষয়ে প্রচার চালানো, সভা-সমাবেশ করা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এবং এনজিওদের কর্মতৎপরতা শুরু করা আশু প্রয়োজন। তা ছাড়া টিকটক, লাইকি ইত্যাদি এ্যাপগুলো বন্ধ করতে হবে অবিলম্বে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×