ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ শাখায় চিঠি আলোচনার পর চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত

বিশেষ অভিযান চালাতে চায় ইন্টারপোল ॥ সন্ত্রাসবাদ ও মানবপাচার পর্যবেক্ষণে

প্রকাশিত: ২২:৫০, ১৬ জুন ২০২১

বিশেষ অভিযান চালাতে চায় ইন্টারপোল ॥ সন্ত্রাসবাদ ও মানবপাচার পর্যবেক্ষণে

শঙ্কর কুমার দে ॥ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও মানব পাচার পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে চায় আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা-ইন্টারপোল। আন্তর্জাতিক এই সংস্থা বাংলাদেশ পুলিশ এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছে। সম্প্রতি ইন্টারপোলের ইন্টিগ্রেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্সের (আইবিএমটিএফ) পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে ইন্টারপোল বাংলাদেশ (এনসিবি) শাখা অফিসে। বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চিঠি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে বলেছেন, সংশ্লিষ্ট সবকটি সংস্থা হোম ওয়ার্ক করে এ ব্যাপারে মতামত গ্রহণ করবে, কীভাবে তাদের সহায়তা করা যায়। করোনার প্রকোপ হ্রাস পেলে আইবিএমটিএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে বিশেষ অভিযান পরিচালনার বিষয়টি চ‚ড়ান্ত করা হবে। আইবিএমটিএফের চিঠিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, মাদক চোরাচালান ও মানবপাচার, নারী ও শিশু পাচার, চোরাচালান কার্গো ফ্লাইটে অবৈধ পণ্য পাচার, অবৈধ উপায়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের বিদেশ গমনে জড়িতদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য তারা বিশেষ অভিযান চালাতে চায়। এই ধরনের অপরাধীরা বিচারের মুখোমুখি না হয়ে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে বলে সংস্থাটি মনে করে। বিশেষ অভিযান পরিচলনার আগে বাংলাদেশের স্থল, নৌ, আকাশ পথের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাতায়াত করবে। বিশেষ করে হযরত শাহজালাল বিমান বন্দর ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর পরিদর্শন করবে এবং আলাপ আলোচনায় মিলিত হবে সংস্থাটির প্রতিনিধি দল। এনসিবি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা-ইন্টারপোল মূলত ইমিগ্রেশন পয়েন্টে এসে ডাটা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে শনাক্ত করে যে, কীভাবে অপরাধীরা যাতায়াত করে। অভিযানের আগে তাদের একটি কমিটি দুটি বন্দর পরিদর্শন করতে চাচ্ছে। আইবিএমটিএফের সমন্বয়কের পক্ষ থেকে গত ২২ এপ্রিল ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা অফিসে (এনসিবি) একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক অপরাধীরা কীভাবে অন্য দেশে যাতায়াত করছে, মানবপাচার কিংবা অবৈধ পণ্য পরিবহন হচ্ছে সেসব বিষয় শনাক্তসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ হবে অভিযানের মূল কাজ। এ নিয়ে পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। আলাপ-আলোচনার পর কিভাবে কোথায় বিশেষ অভিযান পরিচালিত হবে সেই বিষয়ে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। চিঠিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগদানে বাংলাদেশ থেকে নারী-পুরুষরা সংঘাতময় অঞ্চলে গমন করছে। নারী-শিশু পাচারসহ পাচারকারীরা নিজ দেশে অবাধে যাতায়াত করছে। বৈশ্বিক ক্রস বর্ডারের সুবিধা নিয়ে চোরাচালানি এবং পাচারকারীরা কার্গো ফ্লাইটে অবৈধ পণ্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাচার এবং অবৈধ উপায়ে অভিবাসন প্রত্যাশীরা বিদেশ গমনে মরিয়া। বাংলাদেশকে উদ্দেশ করে ইন্টারপোলের চিঠিতে আরও বলা হয়, বিচারের মুখোমুখি না হয়ে অপরাধীরা বিভিন্ন দেশে পলায়ন করছে। সমন্বিত সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমেই কেবল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন এবং আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনে কার্যকর ভ‚মিকা রাখা সম্ভব। এজন্য পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত বা বর্ডার পয়েন্টগুলোয় নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে চায় আইবিএমটিএফ। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে জাপান সরকার। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ইন্টারপোলের ইন্টিগ্রেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্সের (আইবিএমটিএফ) পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপিন্সে ইন্টারপোলের নেতৃত্বে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ফিলিপিন্সে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রুদ্রিগো দুতেতে ক্ষমতা গ্রহণের পর মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘোষণা করেন। এরপর আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান, মানবপাচারসহ নানা অভিযোগে ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার এবং ফিলিপিন্সে অভিযান চালায় ইন্টারপোল। ওই তিন দেশে অভিযানকালে পুলিশ এবং ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ২১ লাখেরও বেশি ডাটা সংগ্রহ করে ইন্টারপোল। এসব ডাটা যাচাই করে ১৪৮টি গুরুত্বপূর্ণ হুমকি শনাক্ত করা হয়, যার মধ্যে ইন্টারপোল ঘোষিত ৪৯ জন আন্তর্জাতিক মোস্ট ওয়ানটেড অপরাধীর তথ্যও ছিল। এ সময় চারজন পলাতক অপরাধী ইন্টারপোলের হাতে গ্রেফতার হয়, যারা হত্যা ও প্রতারণা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা-ইন্টারপোলের কাছে বাংলাদেশের বিমানবন্দর ব্যবহার করেও বিভিন্ন অপরাধীর যাতায়াতের তথ্য আছে। ইতোমধ্যে দুবাই-লিবিয়া ভিত্তিক কয়েকজন মানবপাচারকারী গ্রেফতারের পর সেই তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি ১৬৪ জন বাংলাদেশীকে আটক করেছে লিবিয়ার কোস্টগার্ড। আগেরদিন ইউরোপের দেশ উত্তর মেসিডোনিয়াতে যাওয়ার সময়ে ২০ বাংলাদেশীকে আটক করেছে মেসিডোনিয়ার পুলিশ প্রশাসন। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে দুই লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু পাচার হয়েছে। প্রতিবছর ২০ হাজার নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যায়। অপর এক হিসাবে দেখা যায়, ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্য দেশে ৫০ হাজার নারী পাচার হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জিরো টলারেন্স নিয়ে মানবপাচারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছে। ইন্টারপোলের ইন্টিগ্রেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্সের (আইবিএমটিএফ) পক্ষ থেকে দেয়া চিঠিতে মানবপাচারের সঙ্গে মাদকপাচারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ বাংলাদেশে কোকেন, এমফিটামিনক, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনইথাইলামিনসহ মূল্যবান প্রাণঘাতী মাদক উৎপন্ন হয় না। অথচ এই ধরনের মূল্যবান ও প্রাণঘাতী মাদকের চালান আটক হচ্ছে বাংলাদেশে। আটক করা মাদকের চালানগুলো মিয়ানমার, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে। মাদকের চালানগুলোর গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে। মূল্যবান ও প্রাণঘাতী মাদক পাচারের ট্রানজিট রুট হিসাবে গড়ে উঠছে বাংলাদেশ। কোটি কোটি টাকার মাদক পাচারের জন্য ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ডন চক্র। বাংলাদেশে গত ৫ বছরে প্রায় অর্ধশতাধিক কোকেন, এমফিটামিনক, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনইথাইলামিনসহ মূল্যবান ও প্রাণঘাতী বড় ধরনের মাদকের চালান আটক করা হয়েছে। আটক করা মাদকের চালানের মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। আকাশ পথে ও নদী পথে এসব মাদকের চোরাচালান আসে বাংলাদেশে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করেছে আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী মাফিয়া ডন ও গডফাদার চক্র। আটক করা মাদকের চালানের সঙ্গে যারা জড়িত সেই আন্তর্জাতিক মাফিয়া ডন বা গডফাদার চক্র ধরা পড়েনি। ধরা পড়েছে শুধুমাত্র বাহক শ্রেণীর মানুষজন। সাক্ষ্য, প্রমাণের অভাবে আটক করা মাদকের চালানের মামলায় বাহক শ্রেণীর মানুষজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দেয়া হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) প্রকাশনা ‘ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক’ এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (আইএনসিবি) এর বার্ষিক প্রতিবেদনে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মাদক পাচারের ট্রানজিট দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত ও মিয়ানমারের রুট ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশকে রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী ও মাফিয়া চক্র। সিআইএ এর ‘ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক’ অনুযায়ী ভৌগলিক সীমারেখার কারণে অবৈধ সীমান্ত বাণিজ্য সুবিধার মাধ্যমে মাদক উৎপাদনকারী দেশগুলোর মাদক ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে মাদক পাঠায়। আইএনসিবি এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হেরোইন পাচারের জন্য বাংলাদেশকে গুরুত্ব¡পূর্ণ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। আইবিএমটিএফ পক্ষ থেকে দেয়া চিঠিতে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কথা বলা হলেও বাংলাদেশে কেবলমাত্র জঙ্গীবাদ ছাড়া আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের তেমন কোন কর্মকাÐ নেই। জঙ্গীবাদের মধ্যে যারা গোপনে বাংলাদেশ থেকে সিরিয়া-ইরাকে গিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটস-আইএস এর হয়ে যুদ্ধ করেছে তারা দেশে আসলেই গ্রেফতার হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশে আর কোন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কোন অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় না।
×