ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গড়ে উঠেছে অনেক অবৈধ স্থাপনা

কর্ণফুলী দখলের মচ্ছব

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ১৬ জুন ২০২১

কর্ণফুলী দখলের মচ্ছব

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ উচ্চ আদালতের কঠোর নির্দেশনার পরও কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ তো হয়ইনি, উল্টো নতুন করে দখলের রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। বাকলিয়া এলাকার কর্ণফুলী নদী অংশের মাঝ বরাবর গড়ে উঠা অবৈধ ফিশিং মার্কেট ও ভেড়া মার্কেট ইতোপূর্বে উচ্ছেদ করতে গিয়েও জেলা প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। রহস্যময় এ ঘটনা নিয়ে নানা জল্পনা চললেও অদ্যাবধি প্রশাসন কেন এগোতে পারছে না এবং নতুন নতুন অবৈধ স্থাপনা এ নদীকে কোন শক্তির বলে গিলে খাচ্ছে তাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চতর আদালত চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং এসিল্যান্ডকে সুনির্দিষ্টভাবে কর্ণফুলী নদীর এসব স্থাপনাসহ দু’পাড়ের সকল অবৈধ কাঠামো গুঁড়িয়ে দেয়ার নির্দেশনা প্রদান করে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে। এর আগে জেলা প্রশাসন থেকে অবৈধ স্থাপনার হিসাব চেয়েছিল উচ্চ আদালত। উত্তরে তদন্ত করে ২ হাজার ১১২টি অবৈধ স্থাপনার হিসাব দাখিল করা হয়। শুনানি শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এসব স্থাপনা অবিলম্বে উচ্ছেদের নির্দেশনা প্রদান করে। নদীর উত্তর পাড়ে মাঝিরঘাট এলাকায় কিছু স্থাপনা উচ্ছেদের পর থমকে যায় একটি পক্ষের রিট মামলার প্রেক্ষিতে। সেই মামলারও শুনানি হয়েছে। শুনানি শেষে আবারও উচ্ছেদের আদেশ হয়। কিন্তু সবই রয়ে গেছে কাগজকলমে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের মধ্যে উচ্ছেদের এ বিষয়টি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় সূত্রে জানানো হয়েছে, এটি জেলা প্রশাসকের কাজ। অপরদিকে জেলা পরিষদ দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, উচ্চ আদালত থেকে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং এসিল্যান্ডকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান এ কাজ কোন প্রশাসনের নেতৃত্বে হবে তা নিয়ে চলছে রীতিমত রশি টানাটানি। অপরদিকে, পুরনো স্থাপনার সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অবৈধ স্থাপনা যুক্ত হচ্ছে। বাকলিয়া অংশে নদীর মাঝখানে ইতোপূর্বে নির্মিত মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পাশে নদী ভরাট করে তৈরি হয়েছে নতুন একটি ট্রাক টার্মিনাল। এদিকে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন কমিটি সূত্রে জানানো হয়েছে, কর্ণফুলী নদীর তীরে বসবাস করে ১২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। হাজার বছর ধরে চট্টগ্রামের লোকজ সংস্কৃতি এ নদীকে ঘিরে আবর্তিত। সরকারের ১নং খতিয়ানের ৮৬৫১ দাগের ১৪৭ একর দশ শতাংশ এলাকা কর্ণফুলী নদী হিসেবে চিহ্নিত, যা ভরাট ও দখল করে মাছের বাজার ও বস্তি গড়ে উঠেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটি প্রণীত স্ট্রাটেজিক মাস্টারপ্ল্যানের তথ্য অনুযায়ী কর্ণফুলী ব্রিজের পাশে ভেড়া মার্কেট এলাকায় নদীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। বর্তমানে সেখানে নদী প্রবাহ ধারা মাত্র ৪১০ মিটার। অবশিষ্ট ৪৭৬ দশমিক ১২ মিটার নদী দখল করে ভেড়া মার্কেটের পাঁচ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। বিএসসি ও এডিপি মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, বাকলিয়ার রাজাখালী খালের মুখে কর্ণফুলী নদী ২০১৪ সালে প্রস্থে ৮৯৮ মিটার ছিল। বর্তমানে তা ৪৬১ মিটারে নেমে এসেছে। এছাড়া চাক্তাই খালের মোহনায় ২০১৪ সালে নদীর প্রস্থ ছিল ৯৩৮ মিটার। বর্তমানে সেখানে নদী রয়েছে মাত্র ৪৩৬ মিটার। উচ্চ আদালতের নির্দেশের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারী ৪৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৩০ দিনের সময় দিয়ে উচ্ছেদের নোটিস প্রদান করেছিল। এ ঘটনা নিয়ে অবৈধ দখলদারদের একটি পক্ষ উক্ত আদেশ প্রত্যাহার করার জন্য আবেদন করে। এসব ঘটনা নিয়ে সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রæয়ারি উচ্চ আদালতে এক রিট পিটিশন দাখিল করা হলে শুনানি শেষে আপীল আবেদন নিষ্পত্তির আদেশ প্রদান করা হয়। বর্তমানে জেলা প্রশাসন রিট মামলার আদেশের ভিত্তিতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে আর কোন বাধা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাদের এ ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব থাকায় প্রশাসন এগোতে পারছে না। ভেড়া মার্কেটটি ইতোমধ্যে সন্ত্রাসীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। পুলিশের কয়েকদফা অভিযানে এ মার্কেট অভ্যন্তর থেকে উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মাদক। গ্রেফতার হয়েছে সন্ত্রাসী দলের কয়েক সদস্যও। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাকলিয়া অংশে কর্ণফুলী নদী ভরাট করে এসব অবৈধ স্থাপনার কারণে জলাবদ্ধতাও প্রকট রূপ নিয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার যে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে তজ্জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (চউক) ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা প্রদান করেন। চউক এ কাজ সেনাবাহিনীর কাছে অর্পণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় খাল সংস্কারের বিষয়টি যেমন রয়েছে, তেমনি অবৈধ সকল স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়টিও জড়িত। ইতোমধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসন ও খাল সংস্কারের কাজ ৬০ শতাংশেরও বেশি সম্পন্ন হয়েছে বটে। কিন্তু পুরোপুরিভাবে প্রকল্প সম্পন্ন করতে আরও ন্যূনতমপক্ষে দুই বছর সময় যেমন নেবে, তেমনি ব্যয়ের পরিমাণও বাড়বে। যা আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে চউক সূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এদিকে বিশেষজ্ঞ সূত্রে প্রশ্ন উঠেছে, মহানগরের অভ্যন্তরে ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়া খাল সংস্কার ও উদ্ধার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কাজ। কিন্তু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বিলম্ব ঘটার কোন কারণ থাকতে পারে না। এছাড়া এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কড়া নির্দেশনাও রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারী দুই প্রশাসনের রশি টানাটানি কেন হচ্ছে এবং কোন রহস্যের কারণে উচ্ছেদ অভিযান থমকে আছে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ সুযোগে গড়ে উঠছে আরও নতুন নতুন অবৈধ স্থাপনা। অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কাজ এখন কর্ণফুলী সেতু সংলগ্ন স্থান পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ যেন বলার কেউ নেই, দেখারও কেউ নেই। রীতিমতো দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতাই চলছে। কর্ণফুলী নদীকে গিলে খাচ্ছে অবৈধ দখলবাজরা। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদী সংলগ্ন এলাকায় সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে নির্দেশনা প্রদান করে। এদিকে, উচ্চ আদালতের আরেকটি রায়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পতেঙ্গার লালদিয়ার চরে ২ হাজার ২শ’ পরিবারের বাড়িঘর উচ্ছেদ করে জমি দখলে নিয়েছে। এ কাজে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। অথচ, কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ প্রবাহিনী শিরা হিসাবে কাজ করে থাকে। এ নদীতে ক্রমশ চর পড়ে যাচ্ছে, উজান থেকে পলি আসতে থাকার কারণে নদীর গভীরতা ইতোপূর্বেকার চেয়ে ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এর মূল কারণ নদীর পাড় ঘিরে নদী ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ কাজ। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের জন্যও হুমকিস্বরূপ। কারণ, উজান থেকে বয়ে আসা পলি ক্রমশ বন্দর চ্যানেলের দিকে এগোচ্ছে। ইতোমধ্যে একনম্বর জেটি এলাকায় ব্যাপক পলির স্তর জমেছে, যা ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যায়ে উত্তোলন চলছে। কিন্তু মূল জায়গায় হাত দেয়া হচ্ছে না। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব অংশে অর্থাৎ কর্ণফুলী সেতু থেকে বাকলিয়া অংশে যে বিশাল এলাকা ভরাট হয়ে অবৈধ স্থাপনার জোয়ার বয়ে চলেছে সেটা নদীকে গিলে খাচ্ছে। আর এতে করেই বিষয়টি এ নদীর জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রায় পাঁচবছর সময় অতিবাহিত হতে চলেছে। প্রশাসন কেন উভয় পাড়ের এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়ে আছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। জানতে চাইলে শুধু তথ্য দেয়া হয়, এ সংক্রান্তে মামলা রয়েছে। অথচ, উচ্ছেদ করার মামলার পক্ষে যারা তাদের সূত্রে জানানো হয়েছে, উচ্চ আদালত স্পষ্টভাবে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও এসিল্যান্ডকে এসব অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ আদেশের পক্ষে যারা রিট মামলা করেছিল তাও শুনানি হয়ে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। অথচ, এরপরও উচ্ছেদের ব্যাপারে প্রশাসন নির্ভার। এ বিষয়টি চট্টগ্রামের সকল মহলকে উৎকণ্ঠায় রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে উভয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের রদবদল হয়েছে। নতুন বিভাগীয় কমিশনার, নতুন জেলা প্রশাসক দায়িত্ব নিয়েছেন। তারা এখন একে অপরকে দায়িত্ব সম্পাদনের তীর ছুটছেন। এ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। আর ওইদিকে দখলবাজদের দৌরাত্ম্য এগিয়েই চলেছে। কর্ণফুলীর দু’পাড়ে গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন অবৈধ স্থাপনা।
×