ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে

প্রকাশিত: ২১:০১, ১৬ জুন ২০২১

আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে

অনুষঙ্গহীন উপলক্ষ নিয়ে হাজির হয়েছে এবারের বর্ষা। অবিরাম বৃষ্টির বদলে খাঁ খাঁ রোদে অনেকটা ছন্নছারা প্রাণ-প্রকৃতি। আবহমান বাংলার পরিচ্ছন্ন এ ঋতু হারিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক রীতি রেওয়াজ। এবারকার বর্ষা তার শীতল পরশে দূর করতে পারেনি প্রকৃতির উষ্ণতা। রিনিঝিনি ছন্দে বর্ষা এবার ভরিয়ে দিতে পারেনি উচাটন মনের অপূর্ণতা। গ্রীষ্মের প্রখরতায় উত্তপ্ত চারপাশে নেই স্বস্তির আয়োজন। বর্ষার বারি ধারায় সবকিছু তলিয়ে পানিতে টইটম্বুর হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো দিকে মোড় নিয়েছে। বাংলার চিরচেনা প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বর্ষাসহ অন্যান্য ঋতুর গীতি গৌরব। আগের মতো রীতি মেনে বাংলায় বৃষ্টির ঝঙ্কার তুলতে পারছে না বর্ষা, ঋতুরাজ বসন্ত ফিরিয়ে আনতে পারছে না কাঠফাটা রোদ, শীত কাবু করতে পারছে না প্রাণিজগতকে। পাশাপাশি শরতও তার নিজস্ব সৌন্দর্যে বাঁধতে পারছে না প্রকৃতিকে। সবকিছু মিলে ঋতু পরিক্রমায় ছন্দপতন ঘটেছে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলার প্রকৃতিতে এসেছে বৃষ্টি বাদলহীন এক অচেনা বর্ষা। আষাঢ়ে বারি ধারায় ভেসে ওঠেনি বর্ষার প্রকৃত রূপ। গ্রাম্য পরিবেশে এবারের বর্ষা শুরু হয়েছে বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহ নিয়ে। বর্ষানুষজ্ঞ কদম্বের পাপড়িতে নেই বৃষ্টিফোঁটার মণিমুক্তা ঝিলিক। হিজল ফুলের আলতা দলে ছিল না নতুন পানিতে সাঁতার কাটার নিঃশব্দ প্রতিযোগিতা। বর্ষা বরণের আয়োজনে শামিল হতে অধীর অপেক্ষায় থাকা চালতা ফুলের ধবল দুষ্টুমিও থেমে গেছে বর্ষাহীনতার বিবর্ণ ধারায়। বর্ষা বিরহে কাতর কদম্ব, চালতা, হিজলের বাদল তৃষ্ণা মিটেনি। পরিশুদ্ধ এ ঋতুর অপেক্ষা করতে করতে হয়ত কদম্ব হারিয়ে ফেলবে তার অগণিত পাপড়ি, চালতায় ভর করবে নিস্তেজতা আর আলতাবর্ণা হিজলে লুপ্ত হবে রঙের বাহার। বিগত কয়েক বছরের হিসাব কষলে দেখা যায়, বর্ষার আগমন ও প্রস্থানে ব্যাপক গরমিল ধরা পড়েছে। কখনও গ্রীষ্মেই বর্ষার বিস্তৃতি, আবার কখনও বর্ষা গড়িয়ে গেলেও বর্ষার দেখা মিলছে না। আবার অকাল বন্যার বেরসিক বেহায়াপনায় বর্ষার উপকারিতাকে কলঙ্কিত করছে। প্রকৃতির খিটখিটে অঙ্গে সতেজ ভাব ফুটিয়ে তুলতেই বর্ষার আগমন। রুক্ষ প্রকৃতির ব্যাকুলিত বুক থেকে ধুলাময় আস্তরণ সরিয়ে সজীবতা ফিরিয়ে আনে এই স্যাঁতসেঁতে শীতল ঋতু। গ্রীষ্মের গা ছমছমে উষ্ণতায় অনুষ্ণ পরশ বুলাতে তার জুড়ি নেই। দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠকে সুজলা-সুফলা করতে সর্বত্র ডানা মেলে বর্ষার বৃষ্টিবিধৌত জল। পথ-ঘাট তলিয়ে বাংলায় একচ্ছত্র আদিপত্য বিস্তার করে বর্ষা। প্রিয় বর্ষার রিনিঝিনি রূপ দর্শনে বরাবরই মোহিত হয়েছেন কবি-সাহিত্যিকরা। ঋতুরাজ বসন্তকে নিয়ে তাদের ভাবনা যতখানি বিকশিত হয়েছে, বর্ষাও তার থেকে কোন অংশে কম নয়। বৃষ্টিস্থাত জলমগ্ন বর্ষার শ্রীরূপ দর্শনে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গল্প, গান। বর্ষা ভাবুকেরা বর্ষার মাঝে অপার সৌন্দর্যের মোহনীয় লীলা খুঁজে পেয়েছেন। কখনও বর্ষাকে আহ্বান করে লেখা হয়েছে গান, কখনও কবিতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে টাপুরটুপুর বর্ষার কথা। আবার কখনও বর্ষা-বাদলকে প্রেমিক-প্রেমিকা আখ্যায়িত করে লেখা হয়েছে রসবোধক প্রেমের গল্প। সবকিছু মিলে বর্ষা যেন জয় করেছে কবি-সাহিত্যিকের লেখিয়ে মন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনের ব্যাকুলিত কথা প্রিয়জনকে বলতে বর্ষার ভীষণ মেঘাচ্ছন্ন মুহূর্তকেই বেছে নিয়েছেন। বলেছেন- ‘এমন দিনে তারে বলা যায় / এমন ঘনঘোর বরষায়।’ এ ছাড়া কবিগুরুর ভাবনায় বর্ষা যেন ভাল লাগা না লাগার এক উদাসীন কাল। এ মুহূর্তে কেন জানি মন ভাল নেই তাঁর। তাই তিনি বৃষ্টিভরা ব্যগ্রচিত্তে বলেছেন, ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে জানিনে জানিনে / কিছুতে কেন যে মন লাগে না / ঝরঝর মুখর বাদল দিনে।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় বর্ষা বন্দনা করেছেন এমন করে, ‘সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি / চলিতে চলিতে চমকি’ উঠ না কবরী উঠে না দুলি! / সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্ন তাপসিদী অচপল, / তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ‘ফটিক-জল’!’ প্রেম ও দ্রোহের কবি নজরুল হয়ত বর্ষারানীকে প্রেমিকা হিসেবে কল্পনা করে বলতে চেয়েছেন- তুমি কোথাও গেলে পায়ের শ্রæতিমধুর অলঙ্কারটুকু খোলে যেও। যেন তোমার চলে যাওয়ায় কেউ চমকে না ওঠে। হয়ত তোমার অপেক্ষায় এখানে বসে কাঁদবে কেউ স্বচ্ছ জলে। বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ প্রিয়জনকে আহ্বান করেছেন এই বর্ষায়। বর্ষামোহিত এই সাহিত্য সম্রাট কবিতা-গানে বলেছেন- ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, চলে এসো, এক বরষায়। এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে, জল ভরা দৃষ্টিতে, এসো কোমল শ্যামল ছায়।’ বর্ষার বৃষ্টিবদ্ধ নিভৃত সময়ে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকুতিই জানান দেয় তার কাছে বর্ষা কতখানি প্রিয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন- ‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর / উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর / রমণীর মন লয়ে / সুখে কেলি করে / দানবাদি দেবযক্ষ সুখিত অন্দরে।’ তার চিন্তা বলছে- বর্ষায় যেমন আনন্দ সজীবতায় জেগে ওঠে প্রকৃতি, তেমনি মানুষও যুক্ত হয় সেই প্রমোদবিহারে। বর্ষার সৌন্দর্য অবলোকনে দেবতাগণ বসে থাকে না। তাঁরাও অন্তরালে থেকে বর্ষার স্বরূপ দর্শন করে চলে। প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান বর্ষাবাদল নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন- ‘হঠাৎ আকাশ সাদা মুখটি কালো করে, / কালো মেঘে বুকটি ফুঁড়ে পানি পড়ে। / ঝর ঝর ঝর একটানা বৃষ্টি ঝরে, / বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি ঝরে।’ কবি অত্যন্ত সাবলীলভাবে বর্ষার বর্ণনা করেছেন। বর্ষা নিয়ে কত কবিতা কত গান রচিত হয়েছে। তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বর্ষার অপরূপ সৌন্দর্যের নানা দিক। তবে অতীতের বর্ষা ভাবনা বর্তমান ভাবনার সঙ্গে কিছুটা গরমিল খুঁজে পাওয়া যায়। এখনকার বর্ষায় তার চিরচেনা রূপ নেই। এই তো গত দুই যুগ আগেও বর্ষা মানে ছিল অবিরাম বৃষ্টি। তখন সপ্তাহে একবার সূর্যের দেখা পায়নি প্রকৃতি ও মানুষ। কিন্তু বর্তমানে সে রকমটা নেই। এখন যে কোন সময় বৃষ্টি বাগড়ায় পড়তে হয় মানুষকে। আবার যে কোন সময়ে বয়ে যেতে পারে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ। প্রকৃতির এই পরিবর্তনের জন্য মানুষই অনেকাংশে দায়ী। মানুষের প্রকৃতিবৈরী আচরণে লুপ্ত হচ্ছে প্রতিটি ঋতুর বৈশিষ্ট্যগত দিক। বৃষ্টিস্থাত বর্ষাও এর বাইরে নয়। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×