ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার ॥ নারী ইউএনওদের বিকল্প চাওয়ায় ক্ষোভ-প্রতিবাদ

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১৫ জুন ২০২১

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার ॥ নারী ইউএনওদের বিকল্প চাওয়ায় ক্ষোভ-প্রতিবাদ

অনলাইন ডেস্ক ॥ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প পুরুষ কর্মকর্তাদের খুঁজতে বলায় তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও নারী সংগঠন। গত রবিবার জাতীয় সংসদ ভবনে কমিটির বৈঠকে এই সুপারিশ করা হয়। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় সংশ্লিষ্ট জেলা বা উপজেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে থাকেন। কফিনে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। অনেক স্থানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে নারী কর্মকর্তারা রয়েছেন। গত রবিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার প্রদানের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় আয়োজন এবং নারী ইউএনওর বিকল্প পুরুষ কর্মকর্তা খুঁজতে বলা হয়। এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান বলেন, ‘কমিটির বৈঠকে নারীর বিকল্প একজন পুরুষ কর্মকর্তাকে দিয়ে গার্ড অব অনার দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাসহ অন্য যেকোনো কর্মকর্তা হতে পারেন। আমরা মন্ত্রণালয়কে এটা পরীক্ষা করে দেখতে বলেছি।’ তিনি আরো বলেন, নারীরা তো জানাজায় থাকতে পারেন না। তাই নারী ইউএনও গার্ড অব অনার দিতে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকে প্রশ্ন তোলে। এ জন্য কমিটির একজন সদস্য এই প্রস্তাব করেছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি এ বিষয়ে বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার দেওয়াটা জানাজা নয়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে এক করে ফেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ধর্ম হলো ব্যক্তিগত চর্চা। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নারীকে তাঁর সম্মান না দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। দুটিই সংবিধানবিরোধী কাজ। যারা এটা করছেন তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা বলে খ্যাত। তাঁদের কাছ থেকে এমন সিদ্ধান্তের কথা শোনা দুর্ভাগ্য ও লজ্জাজনক। নারী অধিকার কর্মী খুশী কবির বলেন, হঠাৎ করে ৫০ বছর পরে সংসদীয় কমিটির এই চিন্তা আসছে। এখানে ইউএনও পরিচয় নয়, পরিচয় নারী বলে দেখানো হচ্ছে। ধর্ম ও রাষ্ট্র দুটি বিষয় আলাদা। মুক্তিযোদ্ধা নারী-পুরুষ উভয়েই ছিলেন। এই সিদ্ধান্ত দেওয়াটা হলো নারীকে অসম্মান করা, বীর মুক্তিযোদ্ধা—যাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে তাঁকে অসম্মান করা, ইউএনও পদকে অবমাননা করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের পরিপন্থী। সংবিধানে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িকতা ও সবাইকে সম্মান করার বিষয়টি স্পষ্ট। এই ইউএনও পদে তিনি যোগ্যতায় এসেছেন। এখানে ইউএনও পদ ও ব্যক্তিকে অবমাননা করা হচ্ছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ এক বিবৃতিতে এ প্রস্তাবে বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘গার্ড অব অনার কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়, রাষ্ট্রের বিশেষ আনুষ্ঠানিক কর্মধারার অংশ মাত্র। আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সংসদীয় কমিটির এ ধরনের বৈষম্যমূলক বিভাজন গ্রহণযোগ্য নয়।’ সংসদীয় কমিটির ওই প্রস্তাবকে সংবিধানবিরোধী বলে দাবি করেছে সিপিবি নারী সেল। নারী সেলের পক্ষে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য লুনা নূর স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যাঁরা এ প্রস্তাব করেছেন তাঁরা দেশের সংবিধানকে লঙ্ঘন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী অবস্থান নিয়েছেন। কারণ রাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা কোন লিঙ্গের হবেন, সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। তিনি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, অতীতেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকার হেফাজতের দাবি অনুযায়ী ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১০’ থেকে সরে এসেছে। সরকার পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনসহ বিভিন্ন পরিকল্পনায় নারীকে পশ্চাৎপদ করার নানা মৌলবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি রওশন আরা রুশো ও সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু এক বিবৃতিতে ওই প্রস্তাবকে নারীর জন্য অবমাননাকর শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংবিধানবিরোধী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, গার্ড অব অনার আর জানাজা এক বিষয় নয়। গার্ড অব অনার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের সম্মান প্রদর্শনের একটি রীতি, কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়। তাই ওই প্রস্তাব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিকদের ক্ষুব্ধ ও আহত করেছে। কারণ এ ধরনের সুপারিশ নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রযাত্রার পথে বাধা। সমাজে নারীকে অধস্তন করে রাখার সামন্তবাদী পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির (৬৭টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম) এক বিবৃতিতে জানায়, এই ধরনের সুপারিশ স্বাধীন বাংলাদেশে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, সংবিধান পরিপন্থী, নারীর মানবাধিকার পরিপন্থী ও নারীর ক্ষমতায়ন পরিপন্থী। এ ধরনের সুপারিশ একজন নারীর জন্য যেমন অবমাননাকর, ঠিক একইভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্যও অপমানজনক। বাংলাদেশে নারী ইউএনও বলে কোনো পদ নেই। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার মাধ্যমে এ নিয়োগ দেওয়া হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এমন সুপারিশের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, কমিটির এমন সুপারিশ বৈষম্যমূলক, সমতা ও ন্যায্যতার মূলনীতি, সর্বোপরি নারীর মানবাধিকারের বিরোধী। এমন সুপারিশ সংবিধানের ১৯ (৩), ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদ এবং সরকারের নারীর ক্ষমতায়নসংক্রান্ত অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৫-এর (জেন্ডার সমতা) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য হাজেরা সুলতানা এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শিউলি সিকদার এক যুক্ত বিবৃতিতে ওই সুপারিশের তীব্র প্রতিবাদ জানান। তাঁরা বলেন, গার্ড অনার প্রদান একটি রাষ্ট্রীয় রীতিনীতির বিষয় আর জানাজা একটি ধর্মীয় বিষয়, দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এই সুপারিশ খুবই দুঃখজনক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
×