ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হত্যার দায় স্বীকার করে সৌমেনের জবানবন্দী

প্রকাশিত: ২৩:২২, ১৫ জুন ২০২১

হত্যার দায় স্বীকার করে সৌমেনের জবানবন্দী

নিজস্ব সংবাদদাতা, কুষ্টিয়া, ১৪ জুন ॥ কুষ্টিয়ায় মা ও শিশুপুত্রসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে পুলিশের বরখাস্তকৃত এএসআই সৌমেন রায়। সে কুষ্টিয়া মডেল থানায় দায়ের করা ট্রিপল মার্ডার মামলার একমাত্র আসামি। সোমবার দুপুর সোয়া একটার দিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক নিশিকান্ত সরকার আসামি সৌমেনকে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক রেজাউল করীমের আদালতে হাজির করেন। বিচারকের খাস কামরায় শুনানি শেষে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয় সৌমেন। তার জবানবন্দী রেকর্র্ড করেন বিচারক। এরপর তা লিপিবদ্ধ করা হয়। আদালত পুলিশের পরিদর্শক সঞ্জয় রায় জানান, ‘বিজ্ঞ অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা ধরে আসামি সৌমেন রায় হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। স্বীকারোক্তির মধ্যে প্রধানত ছিল আসমা খাতুন ও সৌমেনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে সৃষ্ট ক্ষোভে সৌমেন এই হত্যাকাÐ ঘটিয়েছে।’ আসামি সৌমেনের জবানবন্দী রেকর্ড শেষে তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত। অপর একটি সূত্র জানায়, ‘আসমার সঙ্গে অন্য কোন পুরুষের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি সৌমেন। তাই ক্ষোভ থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে তার দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করা আসমা খাতুন ও শাকিল খানকে। তবে রবিনকে হত্যার জন্য অনুতপ্ত সৌমেন।’ কুষ্টিয়ার আদালতে বিচারকের সামনে দেয়া জবানবন্দীতে সৌমেন এসব কথাও বলেছে। এদিকে রবিবার বিকেলে খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থল কুষ্টিয়া শহরের কাস্টমস মোড় এলাকা পরিদর্শন করেন। আদালতের সূত্র জানিয়েছে, সৌমেন রায় খুলনা থেকে আসে মূলত আসমা খাতুনকে সেখানে নিয়ে যেতে। কুমারখালীর বাগুলাট ইউনিয়নের নাতুড়িয়া নানাবাড়ি অবস্থান করা আসমা রবিবার রবিনকে সঙ্গে নিয়ে শহরের বাসায় আসে। বাসায় যায় সৌমেনও। মালামাল গুছিয়ে তারা রওনা দেয়ার জন্য বের হলে আসমা পথের মধ্যে বাগড়া দেন। তিনি যাবেন না বলে জানায়। এ সময় কয়েকবার কথাকাটি হয়। পরে শাকিল খানের সঙ্গে যোগযোগ করে একসঙ্গে তারা কাস্টমস মোড়ে আসে। সেখানে বিতÐার এক পর্যায়ে গুলি করে হত্যা করে আসমা, শাকিল ও রবিনকে। প্রথমে কাউকে হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল না বলে জানায় সে। পরিস্থিতিতে পড়ে সে হত্যা করে আসমা ও শাকিলকে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর নিশিকান্ত আদালতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মামলার আসামি সৌমেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সে একাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বিস্তারিত বলেছে আদালতে। জবানবন্দী শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।’ আসমা খাতুনের মা হাসিনা বেগম জানান, ‘কুষ্টিয়া শহরের বাবর আলী গেটে আমাদের বাসা। এ বাসায় মাঝেমধ্যে আসত আসমা। রবিনও তার সঙ্গে থাকত। পরে তারা আলাদা আরেকটি বাসা ভাড়া নেয়। সৌমেনকে বিয়ে করার বিষয়টি আমরা জানতাম। এর আগেও আসমার কয়েকবার বিয়ে হয়েছিল। আসমার বাবার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর মূলত দূরত্ব তৈরি হয়। এরপর আসমা আমার মায়ের বাড়ি কুমারখালীর বাগুলাটে গিয়ে থাকত। মাঝে মধ্যে এখনে আসত। সে নানিবাড়িতে একটি ঘরও করেছে। রবিবার সকালে সেখান থেকেই শহরে আসে। খুলনা যাওয়ার বিষয়টি আমাদের কারও জানা ছিল না। মেয়ের আচরণ ও চলাফেরা নিয়ে আমরাও সন্তুষ্ট ছিলাম না। তারপরও মেনে নিয়েছিলাম। আসমার প্রথম পক্ষে একজন মেয়ে থাকলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। রবিনকে সঙ্গে রাখত সে। আসমার সব বিষয় জেনেও সৌমেন তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। আসমাকে বিয়ে করার দাবি করলেও বিষয়টি নিয়ে ধূম্রজাল রয়েছে। মুসলিম থেকে সনাতম ধর্মে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আসমার পরিবারের দ্বিমত রয়েছে। এদিকে নিহতদের মরদেহ সকালে স্বজনরা হাসপাতাল থেকে বুঝে নেন। এর আগে রবিবার সন্ধ্যার আগে লাশের ময়নাতদন্ত করেন কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার তাপস কুমার সরকার বলেন, ‘আসমা, শাকিল ও রবিনের দুটি করে গুলি লাগে। প্রত্যেকের মাথায় গুলি লাগার প্রমাণ মিলেছে। রবিনের একটি গুলি পেছন থেকে মাথায় বিদ্ধ হয়। আর অন্যদের সামনে থেকে গুলি চালানো হয় মাথায়। সব গুলি বের হয়ে যায়’। আসমা ও রবিনের মরদেহ দাফন করা হয়েছে তার বাবার বাড়ি যদুবয়রা ইউনিয়নের পিয়ারপুর গ্রামে। আর শাকিল খানের মরদেহ তার গ্রামের বাড়ি চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা গ্রামে দাফন করা হয়। শাকিলের মা নুরজাহান ও বাবা মেজবা জানান, তার ছেলে তো নিরীহ। তার কোন দোষ ছিল না। ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরি করে সংসার চালাত। তার মৃত্যু আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এ হত্যা পরিকল্পিত বলে দাবি করেন তারা। কারণ এর আগেও আমাদের বাড়ির ওপর এসে সৌমেন শাসিয়ে যায়। এরপর সে আমাদের ছেলেকে গুলি করে মারল। এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই আমরা। শাকিলকে হারিয়ে তার স্বজনরা বাকরুদ্ধ। একেবারে দরিদ্র ঘরের সন্তান শাকিল। তাই সংসার চালাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি বিকাশে চাকরি নেয়। শাকিলের পরিবারের লোকজন জানান, আসমার সঙ্গে তার কিভাবে পরিচয় আমরা জানতাম না। আমাদের বাড়িতেও আসমা এসেছে। ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে। কয়েক মাস আগে সৌমেন এসে হুমকি দিয়ে যায়। শাকিলকেও আমরা নিষেধ করে দিই। তারপরও এমন ঘটনা ঘটে গেল তা আমরা ভাবতেও পারছি না। দেখতে সুদর্শন শাকিলকে এলাকার মানুষ খুব ভাল বলে জানে। তারাও এটা মেতে নিতে পারছেন না। শাকিলের দাফনে এলাকার মানুষ ও স্বজনরা অংশ নেন। কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল সে। তারা তিন ভাই বোন। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম বলেন, থানায় মামলা হয়েছে। মামলার আসামি সৌমেনকে আদালতে তোলা হয়। সে দোষ স্বীকার করে আদালতে জবাববন্দী দিয়েছে। মামলাটি তদন্ত শুরু হয়েছে। দ্রæততম সময়ের মধ্যে আদালতে চার্জশীট দেয়া হবে। জবানবন্দী শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলায় বাদী ন্যায়বিচার পাবেন বলে আমরা আশা করছি। পুলিশ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।’ এদিকে রবিবার বিকেলে পুলিশ সদস্যের ছোড়া গুলিবিদ্ধ তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একে এম নাহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থল কুষ্টিয়া শহরের কাস্টম মোড়ের ওই মার্কেট পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে এই পুলিশ কর্মকর্তা গণমাধ্যমে বলেন, ‘বিষয়টি আটক সৌমেনের একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে ঘটেছে। এ ঘটনার সঙ্গে পুলিশের ভাবমূর্তির কোন সম্পর্ক নেই। ঘটনা যা ঘটেছে, পুলিশ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’। নিহত আসমা খাতুন এএসআই সৌমেন রায়ের বিধিসম্মত বৈবাহিক স্ত্রী কিনা এ বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিশিকান্ত সরকার। কুষ্টিয়ায় প্রকাশ্যে ট্রিপল মার্ডারের এই ঘটনায় গ্রেফতার ও সাময়িক বরখাস্তকৃত পুলিশের এএসআই সৌমেন রায়ের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা হয়েছে। রবিবার রাত ১১টার দিকে সৌমেনকে একমাত্র আসামি করে নিহত শাকিল খানের পিতা মেজবার রহমান বাদী হয়ে ৩০২ ধারায় এই হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৩৯। এর আগে এএসআই সৌমেন রায়কে বরখাস্ত করে নেপথ্যের কাহিনী উদ্ঘাটনের জন্য তদন্ত টিম গঠন করে খুলনা রেঞ্জ পুলিশ। তাছাড়া অন ডিউটি বা দাফতরিক অনুমোদন ছাড়া একজন পুলিশ সদস্য সরকারী অস্ত্র নিয়ে খুলনা থেকে কুষ্টিয়াতে এসে কিভাবে এই হত্যাকাÐ ঘটিয়েছে- সে বিষয়ে কার কতটুকু দায় বা কর্তব্য কাজে অবহেলা ছিল তার সবকিছু খুঁটিনাটি বিশ্লেষণসহ তদন্ত করতে কুষ্টিয়া ও খুলনা পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান কুষ্টিয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুস্তাফিজুর রহমান। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
×