ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবার এসেছে বরষা, নবীনা বরষা

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ১৫ জুন ২০২১

আবার এসেছে বরষা, নবীনা বরষা

মোরসালিন মিজান ॥ এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,/ গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা...। বাঙালীর ভীষণ প্রিয় ঋতু বর্ষা এসেছে। আজ মঙ্গলবার ১ আষাঢ়, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। আষাঢ়স্য প্রথম দিবস থেকে আনুষ্ঠানিক শুরু হলো বর্ষার। করোনাকাল অব্যাহত থাকায় সকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে রাজধানীতে বর্ষা উৎসবের আয়োজন করা হবে। চারুকলার বকুলতলার পরিবর্তে এবার উৎসব হবে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ় ও শ্রাবণ এ দুই মাস বর্ষাকাল। প্রিয়ঋতু ঘিরে বাঙালীর আবেগ উচ্ছ¡াসের কোন শেষ নেই। বর্ষাকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলেÑ/মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা।’ নজরুলের ভাষায়: ‘রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে।’ ভাটি বাংলার লোকসাধক উকিল মুন্সির গানেও খুঁজে পাওয়া যায় বর্ষাকে, যেখানে তিনি সুরে সুরে বলছেন, ‘যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে/অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে...। অবশ্য আজ আনুষ্ঠানিক শুরু হলেও, গত কয়েকদিন ধরে কম বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে মূলত বর্ষার আগমনী বার্ত ঘোষণা করছিল প্রকৃতি। আর মূল যে শুরু, সেটি আজ থেকে হলো। আবহাওয়াবিদদের মতে, বর্ষায় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। নিয়মিত বর্ষণে বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ। এ সময় ধুলো জমা প্রকৃতি তার শরীর ধুয়ে নেয়। পরিচ্ছন্ন হয়। বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাস্লাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। আর মিষ্টি হাসি হয়ে ফোটে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ বর্ষা ঘিরে এক ধরনের চিত্ত চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। কেউ বৃষ্টি হতে দেখলে জানালার কাছে ছুটে যান। কেউবা গিয়ে দাঁড়ান বারান্দায়। হাত বাড়িয়ে শীতল বৃষ্টির ফোটা স্পর্শ করেন। আর বৃষ্টিস্লান তো বাঙালী মাত্রই প্রিয়। বর্ষা নিয়ে সাধারণ মানুষের এই প্রেমানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কবিগুরু লিখেছেন, হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে...। ময়ূরের মতোই বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে কাটে বাঙালীর শৈশব। গাঁয়ের দুরন্ত ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। বর্ষা অদ্ভুত শিহরণ জাগায় মনে। প্রেমের বোধ উস্কে দেয়। কবিগুরুকে তাই লিখতে হয়, তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা...। একই অনুভ‚তি থেকে নজরুল লিখেছেন, রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা।/গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা।/ঘুমন্ত ধরা মাঝে/জল-নূপুর বাজে,/বিবাগী মন মোর হলো পথহারা...। ঠিক পরের স্তবকে প্রিয়ার সান্নিধ্য লাভের আকুলতা থেকে কবি লিখেছেন: চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে,/অতীত স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।/এমনি ছলছল ভরা সে-বাদরে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা...। কবি নির্মলেন্দু গুণ বেশ মজার কথা বলেছেন। তার মতে, বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছে মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব! বর্ষায় একইসঙ্গে বিরহ জাগানীয়া ঋতু। পুরনো বিয়োগ ব্যথা যা নতুন করে বুকে বাজে এসময়। বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির কথাই যদি বলি, তিনি লিখেছেন: এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা ভাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর...। একই কারণে মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন। এমনদিনে সবচেয়ে আপনজনকে কাছে না পাওয়ার বেদনা থেকে লোককবি দুর্বিন শাহ গেয়েছিলন: প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দুটি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া...। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বলাটি এ রকম- বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে/ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল...। আর নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো সকল বিরহীর- শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না...। কবি অন্যত্র লিখেছেন, অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই...। এভাবে অসংখ্য কবিতারও জন্ম হয় বর্ষায়। বলা হয়ে থাকে, বর্ষা ঋতুতেই জীবনের প্রথম কাব্য রচনা করেন বাংলার কবিরা। পরিণত কবিও বর্ষাকে আশ্রয় করেন। আলাদা করে বলতে হয়, হাওড় এলাকার কথা। বর্ষায় হাওড়ের চেহারা আমূল বদলে যায়। গ্রীষ্মে হাওড়ের যে অংশ পায়ে হাঁটার পথ, বর্ষায় তা অথৈ জল নদী। শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় হালচাষ করে কৃষক, ভরা বর্ষায় সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরে জেলে। বর্ষায় ভাটি অঞ্চলের বাবা-মায়েরা নৌকোয় করে তাঁদের মেয়েকে নাইওর আনার ব্যবস্থা করেন। সেই দৃশ্য দেখে ভাটির বাউল উকিল মুন্সি গেয়ে ওঠেনÑ গাঙে দিয়া যায়রে কত নায়-নাইওরির নৌকা সখি রে/মায়ে-ঝিয়ে বইনে-বইনে হইতেছে যে দেখা রে...। বর্ষায় এসব অঞ্চলে প্রচুর বিয়ের প্রচলন আছে। নৌকো করেই বর যান বিয়ে করতে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এই সাতটি জেলার লোককবিরা বর্ষা দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁদের কালজয়ী সৃষ্টি সে কথা বলে। অবশ্য বর্ষার সবই উপভোগ্য এমন নয়। ভারি বর্ষণে, পাহাড়ী ঢলে গ্রামের পর গ্রাম যে ভাসিয়ে নেয় সে-ও বর্ষা! বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষ তাই আতঙ্কে পার করে বর্ষা। একই কারণে সারাবছরের অর্জন ফসল তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। শাহ আবদুল করিম তাই গান: আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না/ বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়...। একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকোটিও ফেরে না কত দিন! আর কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্পতো প্রতিদিনের। বর্ষার কাছে তাই প্রার্থনা: ‘এমন দিনে সকলের সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধারায়,/বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরণ-ঢালা...।’ বর্ষা উৎসব ॥ আজ সকালে বর্ষা উৎসবের আয়োজন করবে বর্ষা উদ্যাপন পরিষদ। সকালে গেণ্ডারিয়ায় এ উৎসবের আয়োজন করা হবে। আয়োজক সূত্র জানায়, সকাল সাড়ে সাতটায় হাসানুর রহমান বাচ্চু গিটারে বর্ষার সুর বাজিয়ে সূচনা করবেন উৎসবের। পরে একক ও দলীয় সঙ্গী নৃত্য ও কবিতার ভাষায় প্রিয় ঋতুকে বরণ করে নেয়া হবে। উৎসবে লোকসঙ্গীত পরিবেশন করবেন আবু বকর সিদ্দিক। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করবেন মহাদেব ঘোষ, অনিমা রায়। নজরুলের গানে বর্ষার বন্দনা করবেন প্রিয়াঙ্কা গোপ, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি, নবনীতা জাইদ চৌধুরী। এ ছাড়াও গাইবেন টিটু আলী ও শ্রাবণী গুহ রায়। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবেন ওয়াইজটের বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা) ও সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করবে বাফা ও স্পন্দন। একক আবৃত্তি পরিবেশন করবেন বেলায়েত হোসেন, নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলি ও আহসান উল্লাহ তমাল। সবই স্বাস্থ্যবিধি মেনে করা হবে বলে জানিয়েছেন আয়োজক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।
×