ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ পাকি সিরিয়ালে রবীন্দ্রসঙ্গীত

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ১৫ জুন ২০২১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ পাকি সিরিয়ালে রবীন্দ্রসঙ্গীত

পাকিস্তানেও হানা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সম্প্রতি পাকিস্তানের এক টিভি সিরিয়ালে ‘আমারও পরান যাহা চায়’ গানটি গীত হতেই ভাইরাল হয়ে যায়। এক সময়ে পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন পর সেই পাকিস্তানেরই জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে ব্যবহৃত হলো রবীন্দ্রসঙ্গীত। এমনই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের এক টিভি সিরিয়ালে পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে গাওয়া হয়েছে ‘আমারও পরান যাহা চায়’। আর তা দেখে উচ্ছ¡সিত আপামর বাঙালী দর্শক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি শেয়ার করেছিলেন পাকিস্তানী পরিচালক মেহরিন জাব্বার। তিনি আবার তাতে ইনস্টাগ্রাম লিঙ্কও সংযুক্ত করে দেন। যাতে দেখা যায় পুরনো একটি ভিডিওই নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে। মেহরিন জাব্বার পরিচালিত ‘দিল কেয়া করে’ ধারাবাহিকে ব্যবহার করা হয়েছিল গানটি। ক্যাপশনে মেহরিন জানিয়েছেন, গানটি গেয়েছিলেন শর্বরী দেশপাণ্ডে। পুরনো এই ভিডিওটিই আদিল হোসেন নামের এক বাঙালীর চোখে পড়ে। তিনি সেটি আবার বৃহস্পতিবার (৩ জুন) টুইটারে শেয়ার করেন। আবার একই দিনে ইউটিউবে একটি রঙিন ভিডিও শেয়ার করা হয়; যাতে দেখা যায় নায়কের অনুরোধে নায়িকা তাকে ‘আমারও পরান যাহা চায়’ গানটি গেয়ে শোনাচ্ছে। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের জিও টিভিতে সম্প্রচারিত হয় ‘দিল কিয়া কারে’ ধারাবাহিকটি। মেহরিন জাব্বারের পরিচালনায় এই সিরিজের সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন পাকিস্তানের জনপ্রিয় সঙ্গীত তারকা শাদাত আলী। ধারাবাহিকটির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফিরোজ খান, ইয়ুমনা জাইদি ও মির্জা জাইন বাগ। এই পরিবর্তন বা পরিবর্তনের বাঁক ইতিহাস কিভাবে নেবে? আমরা বাংলাদেশীরা পাকিদের রবীন্দ্র বিরোধিতার সবচেয়ে বড় শিকার। আইয়ুব খানের রোষানলে পড়ে বঙ্গদেশে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু। বাঙালী নামে পরিচিত কিছু মীরজাফর বাংলার দুশমন ছিল এ প্রক্রিয়ার হোতা। আজ যদি আমরা পেছন ফিরে তাকাই লজ্জিত হওয়ার বিকল্প থাকে না। স্বাধীনতার গান বা দেশপ্রেমের গান গেয়ে নামধাম করা গায়ক থেকে শুরু করে বিনোদন জগতের নায়িকা-গায়িকা, লেখক বুদ্ধিজীবী কতজন যে এ নিষিদ্ধকরণের পক্ষে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিলেন, তার তালিকা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। এখন এদের উত্তরসূরি কিংবা পরিবার-পরিজন হয় এসব কথা এড়িয়ে চলেন, নয়ত খোঁড়া যুক্তি দেন সরকারের চাপে বা তখনকার বাস্তবতায় এমন করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাদের পূর্বসূরিরা। আসলে কি তাই? মূলত এ ছিল সাম্প্রদায়িক বাংলা ও বাঙালী নির্মাণের অনিবার্য প্রক্রিয়া। যেসব মহারথী রবীন্দ্র বিরোধিতার জন্য মাঠে নেমেছিলেন, তাদের ছানাপোনাদের অনেকে এখন আবার সুযোগ বুঝে কবিগুরু বিরোধিতায় কসুর করে না। এবার তাদের ভাষা বা আক্রমণের ধারা ভিন্ন। তারা জানে নিষিদ্ধ করা অসম্ভব। তা ছাড়া এরা জানে আনন্দ-বেদনা-কষ্ট-সুখে তাঁর গান তাঁর সৃষ্টিতেই আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে হয়। তাই এখন তাদের আক্রমণ বা টার্গেট রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবির বিরোধিতার প্রমাণহীন সব যুক্তিতর্ক এখন এদের হাতিয়ার। মূল বিষয় একটাই, যেনতেন প্রকারে রবীন্দ্রনাথকে অবমাননা। বলাবাহুল্য এদের অপকৌশলের ভরসা পাকিস্তান। পাক প্রীতি আর সাম্প্রদায়িকতাই এখানে মূল পুঁজি। অবশ্যই স্মরণ করা উচিত সে সব বাঙালীকে যাঁরা সরকারের আক্রোশ আর পাকিদের হামলা-মামলাকে তোয়াক্কা না করে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন কবির গান। ছায়ানট থেকে শুরু করে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি লড়াইয়ে ছিলেন তাঁদের সহযোগী হয়েছিল তখনকার রাজনীতি। আওয়ামী লীগেরও নানা রূপ আছে। তখনকার রূপটি বাঙালী হওয়ার সংগ্রাম। আর সে আন্দোলনের রূপকার ও নেতা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। তিনি তাঁর কথার বরখেলাপ করেননি কখনও। দেশ স্বাধীন করে রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গানটিকে বেছে নেন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে। তা নিয়েও কত কথা। কত ষড়যন্ত্র। এখনও সে অপকৌশল চলছে। মাঝখানে বিএনপি ও জামায়াত জোটের সরকার এমন এক আবহ তৈরি করে ফেলেছিল যে, মনে হতো অচিরেই বদলে যাবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। শেখ হাসিনার শাসনকালে বর্তমানে তা আর সম্ভব নয় কোনদিন। তবে সময় সুযোগে দেশবিরোধীদের থাবা বিস্তারের দুর্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমাদের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের নিষিদ্ধকরণ ছিল পাকিস্তান পতনের শুরু। আজকের বাংলাদেশেও যারা নানা অজুহাতে তাঁর বিরোধিতা করেন, তাদের কোন ধারণা নেই কতটা গভীরে আছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ উপমহাদেশে দুটি দেশ- বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা। সরাসরি না হলেও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও তাঁর অবদানে ভাস্বর। তাঁকে মূর্খ, দালাল ও রাজাকারের দল ছাড়া সবাই ভালবাসেন। নতুন যেসব বুদ্ধিজীবী লাইনে আছেন তাদের বলি পাকিস্তানের দিকে তাকান। পাকিস্তানের নামে দিল ব্যাকুল আর যারা পাকিস্তান বলতেই নাক সিঁটকান সবাই জেনে রাখুন- সেখানকার নতুন প্রজন্ম বদলেছে, বদলে গেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে আর পরাজিতদের মনোভাব বুঝতে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন মুনতাসীর মামুন ও মহিউদ্দীন আহমেদ। তারা পৌঁছে গিয়েছিলেন আত্মসমর্পণকারী পাক সেনাপ্রধান নিয়াজীর বাড়িতে। জেনারেল নিয়াজীর দুই কন্যা তাদের বার বার অনুরোধ জানাচ্ছিল যেন ভারতকে বন্ধু মনে না করে। তারা এ উপদেশ দিতেও ভোলেনি, দরকার হলে ইসরাইলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেও ভারতের সঙ্গে নয়। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, তিনি কন্যাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন দেয়ালের ছবিতে যেখানে ছিল অজয় দেবগন, কাজল আর শাহরুখের পোস্টার। একটুও বিচলিত না হয়ে কন্যারা বলেছিল, সিনেমা, গানবাজনার জন্য ভারত জায়েজ। এটাই পাকিস্তান! তারা বিরোধিতা করার বেলায়ও অন্ধ। আজকাল সে দেয়াল ভাঙছে। আমাদের নবীন প্রজন্ম বাংলায় পিছু হটলেও অন্য সব দেশে তারা অন্ধত্বমুক্ত। আমি সিডনিতে দেখছি ভারত আর পাকিস্তানের ছাত্রদের গলায় গলায় ভাব। মনে রাখতে হবে তাদের ভাষা, পোশাক, দৈহিক গড়ন এক। আমরা খামোখাই এক দলকে সমর্থন করে আরেক দলের বিরোধিতা করি। কিন্তু এই ঘটনা এই সীমানা ডিঙানো মানুষটি বাঙালী, যিনি আমাদের আত্মার আত্মীয়। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে যদি ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ তাঁর গানের মালা গলায় জড়িয়ে বন্ধু হতে পারে, তবে তার চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না। মনে যাই থাক পাকিস্তানের টিভি সিরিয়ালে খাঁটি বাংলায় ‘আমারও পরান যাহা চায়-তুমি তাই’ মূলত বাংলার বাঙালীর এক প্রকার পাকিস্তান বিজয়। অবাধে উড়ুক এই জয়পতাকা। [email protected]
×