ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল বারকাতের শোভন বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ১৫ জুন ২০২১

আবুল বারকাতের শোভন বাংলাদেশ

ড. আবুল বারকাত আমাদের দেশের সামনের সারির বরেণ্য অর্থনীতিবিদ। তার সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘বড় পর্দায় সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্র, ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ সকল সুধীজনকে ভাবিয়ে তোলার খোরাক দিয়েছে। সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র বিষয়ে তার চিন্তা ও কথা তাকে প্রশংসনীয় মাত্রায় একজন সাহসী চিন্তাবিদের পরিচিতিতে উদ্ভাসিত করেছে। ড. বারকাত এসব বিষয়ে তার গভীর ও ব্যাপ্ত চিন্তাসমূহ একীভূত করেছেন শোভন সমাজের সাধারণ তত্ত¡-এর অবয়বে। বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি তার তত্ত¡ সামগ্রিক বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য বলে উল্লেখ করেছেন। তার বিশ্লেষণে তিনি বিদ্যমান পুঁজিবাদকে শোষণ, লালসা, ব্যক্তি স্বার্থ ও মুনাফাভিত্তিক ব্যবস্থা বা সিস্টেম বলে বিশেষায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন এই সিস্টেম (১) গণতন্ত্রবিরোধী, (২) অসভ্য-বর্বর, (৩) অদক্ষ ও জাতীয় সম্পদ অপচয়কারী ও (৪) জ্ঞান বিজ্ঞান বিকাশবন্ধী। গণতন্ত্রবিরোধী এই সিস্টেমে উৎপাদনের ৯৯% উৎপাদনকৃত পণ্য সামগ্রী বা সেবার মালিক থাকেন পুঁজির মালিক আর ১% প্রযুক্ত হয় ৯৯% শ্রমিকের অনুক‚লে বা তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। পুঁজিবাদ বর্বর-অসভ্য এই কারণে যে, মুষ্টিমেয় পুঁজির মালিকরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সাধারণ জনগণের স্বার্থবিরোধী সকল দুষ্কর্ম করে থাকেন। সকল জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নে প্রযুক্ত হওয়ার বিকল্পে মুষ্টিমেয়রা উপযোগ, সম্পদ ও উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী পান বা ব্যবহার করেন বলে পুঁজিবাদ জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার ঘটায় এবং উৎপাদন ও সেবার ক্ষেত্রে সম্পদ অপচয় করে। মুনাফার আয় প্রবাহ ইতোমধ্যে উৎপাদনে প্রযুক্ত প্রযুক্তি অপরিবর্তিত রাখার অভিলাষে পুঁজিবাদ নিত্যনতুন উদ্ভাবন কিংবা সে উদ্দেশ্যে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশকে ব্যাহত করে। সুতরাং তার মতে, এ সিস্টেমকে বিকল্পায়িত করতে হবে ৩টি মৌল উপাদানভিত্তিক শোভন সমাজ ব্যবস্থা দিয়ে। ড. বারকাত বলেছেন, এই ৩টি উপাদান পরস্পর সম্পর্কিত ও পরস্পর নির্ভরশীল বৃহৎবর্গীয় ভিত্তিবিশিষ্ট। এর প্রথমটি হলো সামাজিক ভিত্তি উপাদান যার মূল অভীষ্ট হলো- আলোকিত মানুষ- জ্ঞান সমৃদ্ধ মুক্ত চিন্তার সৃজনশীল পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও সংহতি সমৃদ্ধ, কুসংস্কার, ক‚পমণ্ডকতা ও অপসংস্কৃতি মুক্ত বিজ্ঞান মনস্ক ও যুক্তিশীল মানুষ কর্তৃক সমাজ পরিচালনা। দ্বিতীয়টি হলো অর্থনৈতিক ভিত্তি- উপাদন যার অভীষ্ট হলো সাধারণের বৈষম্য থেকে মুক্তি। এই অর্জনে প্রকৃতি সৃষ্ট সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা হবে জনগণের তরফ হতে রাষ্ট্রের, মানুষের সৃষ্ট সকল উৎপাদনের উপায়ের মালিক হবেন জনগণ। রাষ্ট্র হবে নিপীড়নবিহীন সার্বভৌম জনগণের রাষ্ট্র, যেখানে গণতন্ত্র হবে প্রকৃত অর্থের জনগণের গণতন্ত্র, প্রভূহীন গণবিরোধী আমলাতন্ত্রবিহীন স্বাধীন মানুষের স্থানীয় সমাজ পরিচালিত নাগরিক শাসন এবং দেশ রক্ষা ও প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত হবে সাধারণ জনগণ। আর ৩য় ভিত্তি উপাদান হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়া সকল ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ারবাজারের বিলুপ্তি এবং এর সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিপতি ও ধনিক শ্রেণীর মুলোৎপাটন। উপরোক্ত প্রেক্ষিতে সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রকে দেখতে হবে বড় পর্দায়। ড. বারকাতের ভাষায়- ‘মানুষকে দেখতে হবে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। কিন্তু উল্টোটাই এতকাল আমাদের ভাবনা জগৎ ও কর্মকাণ্ড জগতে নিয়ামক-নির্ধারক ছিল। সে কারণেই ‘শোভন’ কোন সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র বিনির্মিত হয়নি। শোভন সমাজ- শোভন অর্থনীতি-শোভন রাষ্ট্র হলো শেষ বিচারে প্রকৃতির প্রতি অনুগত থেকে বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও উচ্চ নীতি- নৈতিকতা সম্পন্ন আলোকিত মানুষের জীবন ব্যবস্থা। এসব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একবিংশ শতকের এই সময়ে ‘সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র’ ত্রিমাত্রিক বিপর্যয়ের শিকার- আর্থিকীকরণকৃত রেন্টসিকিং-পরজীবী-লুটেরা পুঁজির নিরঙ্কুশ আধিপত্যে শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতার নিরন্তর ক্রমবর্ধমান উৎপাদন- পুনরুৎপাদন, যা অর্থনীতিতে অবশ্যম্ভাবী করেছে গভীর ও দীর্ঘমেয়াদী মহামন্দা (প্রথম বিপর্যয়), আর্থিকীকরণকৃত পুঁজিবাদ- ক্ষমতাকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছেদিত করেছে, অর্থাৎ রাজনীতি-সরকার থেকে ক্ষমতা অভিবাসিত হয়েছে (দ্বিতীয় বিপর্যয়), আর একই সময়ে ভাইরাসের (আপাতত কোভিড-১৯) কারণে বিশ্বব্যাপী মানুষ হয়েছে গৃহবন্দী-আতঙ্কিত-বিষণ্ণ-অবসাদগ্রস্ত-মানসিকভাবে চরম বিপন্ন-হতাশ-নিরাশ (তৃতীয় বিপর্যয়)। এই তিন বিপর্যয়ের মিথস্ক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এমন অবস্থা, যখন বড় পর্দায় প্রকৃতির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য-আস্থা-সম্মানভিত্তিক নতুন এক জীবন ব্যবস্থা ‘শোভন সমাজব্যবস্থা’- উদ্দিষ্ট আলোকিত মানুষের বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ সময়ের দাবি। এ পথে হাঁটা ছাড়া চলমান অশোভন পৃথিবীকে শোভন পৃথিবীতে রূপান্তরের বিকল্প কোন পথ নেই। পথটা দেখাবে শোভন রাজনীতি।’ ড. বারকাতের মতে এই হলো শোভন সমাজ ব্যবস্থার সাধারণ তত্ত¡। তার এই ভাষ্য পাঠককে মনে করিয়ে দেয় সমাজ বিবর্তনের অষ্টাদশ শতাব্দীর মার্কসীয় তত্ত¡ এবং মুদ্রা, সুদ ও কর্মসংস্থানের বিংশ শতাব্দীর কেয়েনসীয় সমাধান। গত ১০০ বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, ধনতান্ত্রিক দেশসমূহ সমাজতন্ত্রের কতিপয় জনসমর্থিত উপাদান গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হতে সচেষ্ট হয়েছে। এরূপ প্রচেষ্টা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা বিস্তারের মাধ্যমে সুযোগের সমতা সৃষ্টি করেছে, সামাজিক কুশল ও নিরাপত্তার পরিধি বাড়িয়েছে এবং নিপুণতর উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজনে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের লভ্যতা সৃষ্ট করেছে। তেমনি সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ তার অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তিবর্গের সন্দীপনের ভ‚মিকা স্বীকার করে সামাজিক সেবাসমূহ ব্যাপ্ত করার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র ব্যবসা, শিল্প ও অর্থযোগ সংগঠন সৃজন করছে। এই প্রক্রিয়ায় স্কান্ডিনিভিয়ান দেশসমূহ সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের উৎপাদনশীল মিশ্রণ গ্রহণ করে সমাজ থেকে অভাব অনটন দূর করার লক্ষ্যে পরিশ্রম, মেধা ও উদ্যমের সৃজনশীল ভূমিকা সৃষ্টি ও রক্ষণ করে চলেছে। অনুরূপভাবে উত্তর গোলার্ধের আইসল্যান্ড ও দক্ষিণ গোলার্ধের নিউজিল্যান্ড পরিমিত ধনতন্ত্রে সামাজিক প্রতিরক্ষণ ও সন্দিপণ বিকশিত করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। উপরোক্ত প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে মানব সমাজ যা অর্জন করেছে তা দুমড়িয়ে চাপড়িয়ে দূরে সরিয়ে বিপ্লবাত্মক শোভন সমাজ সৃষ্টি করা কতটুকু সম্ভব কিংবা মানব কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয়তা নিরিখকরণে ড. বারকাত যে বিপ্লবের রূপরেখা এই বইয়ে দিয়েছেন তা ঘটানো কিংবা অনুসরণ করা সম্ভব ও এমনকি সঙ্গত হবে বলে মনে হয় না। ২০০ বছর ধরে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তা স্থান বা স্তর বিশেষে সংস্কারের দাবি রাখে, কিন্তু উপড়িয়ে ফেলে দেয়ার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করে না। ড. বারকাতের প্রস্তাবনার বিপরীতে উদাহরণত আমরা বলতে পারি না যে, দেশ রক্ষার ভার পেশাদার পারদর্শী বাহিনী বিলুপ্ত করে জনগণের ওপর অর্পিত করা কার্যকরণ সূত্র অনুযায়ী গ্রহণীয় হবে। যেমন এও বলা যায় না যে, প্রশিক্ষিত আমলা নিযুক্ত বা প্রয়োগ না করে স্থানীয় সমাজ উৎসারিত প্রযুক্তি বা মনোযোগের ভিত্তিতে আমরা সমকালের বহু কাজ ও সামাজিক কুশলে নিযুক্তীয় আমলাতন্ত্র উঠিয়ে দিতে পারব। কিংবা সমাজে উৎপাদন বর্ধক বা সহায়ক সন্দীপনীয় শক্তি সম্পদের সমমালিকানা দিয়ে সৃষ্টি কিংবা সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। সমাজের সঞ্চয়কারীর অর্থ ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনিয়োগকারী বা উদ্যোগীর অনুক‚লে সঞ্চালিত করার সমকালীন যে ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা কার্যশীল তা উঠিয়ে দিয়ে সঞ্চয় ও উৎপাদনশীল বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয় বলেই আমরা মনে করি। এসব বলার পরও ড. বারকাতকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তিনি বলিষ্ঠভাবে বড় পর্দায় সমকালীন সামাজিক ও আর্থিক ব্যবস্থার ত্রæটিগুলো সামনে নিয়ে এসেছেন। একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ ও জ্ঞানতাপস সমাজে এসব ত্রæটি দ্রæত দূর করা, উৎপাদনের নতুনতর ক্ষেত্র শনাক্ত এবং সুযোগের সমতা বিস্তৃত করা এবং সমাজ ব্যবস্থাপনায় সমতা ও মানবতাবোধকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ ও ব্যবহার করার পথে ড. বারকাত আমাদের তার ভাষা, উপলব্ধি ও আনুগত্যবোধ দিয়ে উদ্দীপ্ত করেছেন সন্দেহ নেই এবং এই প্রেক্ষিতে তিনি বাংলাদেশের বড় পর্দার সংস্কারের তালিকা প্রণয়ন করেছেন। তার বিশ্লেষণে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, উগ্রত্ব, ফ্যাসিবাদ, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ, আধিপত্যবাদ, ধর্মভিত্তিক বর্ণবাদ শোভন রাষ্ট্র বিনির্মাণের মারাত্মক প্রতিপক্ষ প্রতিবন্ধক। কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ার লক্ষ্যে ও অনুক‚লে তিনি বলেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য কিংবা সামাজিক বৈষম্য কমায় না, দারিদ্র্য অলসতা কিংবা উদ্যোগের অপ্রতুলতায় সৃষ্ট হয় না, চাহিদা বাড়লেই দাম বাড়ে না কিংবা সরবরাহ বাড়লেই দাম কমে না, উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেই মূল্যস্ফীতি ঘটে না, টাকা ছাপলেই মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় না। তিনি বলেছেন আমাদের সমাজে সামাজিক প্রতিরক্ষণ বিস্তৃত না করণে আমরা প্রবৃদ্ধির সুফল সকল ঘরে পৌঁছাতে বা নিশ্চিত করতে সক্ষম হব না। এসবের প্রেক্ষিতে ড. বারকাত বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বিষয়ে ৫টি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। (১) কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি বাড়ানোর বিবেচনায় প্রবৃদ্ধির হার বার্ষিক ১.০১% থেকে ১.৯৯% এ সীমিত রাখা, (২) কর্মসংস্থানের হার ৯১% থেকে ৯৫% এ বাড়ানো, (৩) প্রবৃদ্ধির জন্যই প্রবৃদ্ধি অর্জন বা অনুসরণ না করা, (৪) আর্থসামাজিক বৈষম্য কমানো এবং (৫) সংবিধান অনুযায়ী সম্মানজনক কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ। তিনি বলেছেন, আর্থসামাজিক রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে এই ৫টি প্রস্তাব আমাদের গ্রহণ করতে হবে (বড় পর্দায় সমাজ, অর্থনীতি- রাষ্ট্র, আবুল বারকাত, পৃঃ ২৪৩-২৪৪)। তিনি বলেছেন, সমাজ থেকে আয় বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য, স্বাস্থ্য বৈষম্য ও শিক্ষা বৈষম্য বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে এবং প্রয়োজনীয় আইনী ও প্রশাসনিক সংস্কার ও পরিবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে দূর করতে হবে। তার প্রস্তাবনায় দেশের অনগ্রসর অঞ্চলসমূহের অধিকতর উন্নয়ন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, পাহাড়ী ও সীমান্ত এলাকা, আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায়, জেলে, বেদেদের দ্রæততর উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ থাকা অভিপ্রেত। এর সঙ্গে কৃষিপণ্যের বিনিময় হার দেশের শিল্পপণ্যের তুলনায় কৃষির প্রতিক‚ল যাতে না হয়, তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ অনুযায়ী বর্গাস্বত্ব আইন দ্রæত সংস্কার ও বাস্তবায়ন করা জরুরী বলে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এলাকা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের সমউত্তরাধিকারসহ আইন প্রণয়ন করার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। তার বিশ্লেষণে শিক্ষাকে ব্যয় হিসেবে না দেখে মানুষ ও সমতা সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তার মতে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে দ্রæততার সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় রূপান্তরিত করতে হবে, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের চারণ ভূমির বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্তি দিতে হবে। তার মতে, স্বাস্থ্য খাতকে অর্থনৈতিক উৎপাদনশীল খাত হিসেবে বিবেচনা করে এই খাতে বিনিয়োগ ব্যয় কমপক্ষে ৫ গুণ বাড়ানো সমীচীন হবে। ড. বারকাতের মতে, শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নব্য উদারবাদী মনোভাব ও কার্যক্রম বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় ও সমবায়ী উদ্যোগে দেশজ কৃষিভিত্তিক উৎপাদন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, হাল্কা শিল্প দিয়ে শুরু করে ভারি শিল্পের দিকে অগ্রসর হতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিল্পায়ন দেশের অভ্যন্তরীণ মোট চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে প্রধানত প্রযুক্ত করা এবং সরকারের প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা সমীচীন হবে। এই প্রেক্ষিতে বিদ্যুত উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা টেকসই করতে হবে। গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চায় বরাদ্দকে ব্যয় বিবেচনা না করে বিনিয়োগ হিসেবে বাড়াতে হবে। বাজেটকে জনকল্যানমূলক করার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ ক্ষেত্রে বাজেটের ১২ শতাংশ এবং গৃহায়ন খাতে ৪ শতাংশ বরাদ্দকরণ লক্ষ্যানুগ হবে। ড. বারকাতের প্রস্তাব অনুযায়ী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজকল্যাণ খাতে মোট বরাদ্দ বাজেটের সমকালীন ২৭ শতাংশ থেকে প্রায় ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। বাংলাদেশের সমকালীন কোভিড-১৯ উৎসারিত বিপর্যয়ের শিকার বিত্তহীন ও মধ্যবিত্তের জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর কর্ম প্রচেষ্টার নিরিখে ড. বারকাতের এ ধরনের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অবশ্যই প্রাণিধান ও গ্রহণযোগ্য। বড় পর্দায় সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র শীর্ষক বইয়ে গ্রন্থিত ড. বারকাতের উপরোক্ত সংস্কার ও পরিবর্তনসমূহ ইতিবাচক ভাবে বিবেচনা এবং নীতিবাচকভাবে গ্রহণ করে যথাসম্ভব পরিবর্তন ও সংস্কার আনলে দেশের সমাজ উন্নতর এবং প্রবৃদ্ধি দ্রুততর ও সাম্যধর্মী হবে বলে বলা চলে। প্রথাগত রাষ্ট্্র বিজ্ঞান ও অর্থ বিজ্ঞানের পাঠ থেকে তার বিশ্লেষণ ও বিধানপত্র নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল এবং আমাদের প্রথাগত সমাজ বিজ্ঞানের অনুশাসন থেকে সাহসিক মাত্রায় ভিন্নতর। সমকালীন সমাজ ব্যবস্থাপনার সাহসী বিশ্লেষক ও প্রতিষ্ঠিত সমালোচক সমাজ বিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি এজন্যই তাকে এই বই উপস্থাপনের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। ড. বারকাতের বিশ্লেষণ ও মত অনুযায়ী সরকারের সমকালীন উন্নয়ন ও সেবা কার্যক্রমে ক্রমান্বয়ে সংস্কার আনলে তা জনহিতকর ও কুশলধর্মী হবে বলে সমর্থন করা যায়। সেজন্য যে ভিন্নতর, জনকুশলধর্মী ও সাহসী বিশ্লেষণ ও সুপরিশসমূহ বড় পর্দায় ড. বারকাত উপস্থাপন করেছেন, সে জন্য তাকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×