ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ১৫ জুন ২০২১

ঢাকার দিনরাত

সুসংবাদ দিয়ে আজকের লেখা শুরু করতে চাই। চীনের দেয়া দ্বিতীয় দফা উপহারের ছয় লাখ টিকা নিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দুটি পরিবহন বিমান ঢাকার পথে রওনা দিয়েছে। চীন গত ১২ মে সিনোফার্মের তৈরি পাঁচ লাখ টিকা বাংলাদেশে পাঠায়। সিনোফার্মের তৈরি ওই টিকার ৩০ হাজার অবশ্য বাংলাদেশে কর্মরত চীনের নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গত ২১ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে ফোনালাপের সময় আরও ছয় লাখ টিকা উপহার দেয়ার কথা জানান। এবার যে টিকা চীন উপহার পাঠাচ্ছে, তাও সিনোফার্মের তৈরি। এবার খারাপ খবর। বাঙালী চরিত্রের আরেকটি দৃষ্টান্ত। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ‘এয়ারপোর্ট রেস্টুরেন্ট’-এ মরা মুরগি জবাই করার সময় রেস্তরাঁটির ব্যবস্থাপকসহ হাতেনাতে ৭ জনকে আটক করা হয়। জব্দ করা হয় ১১৯টি মরা মুরগি। শনিবার বিকেলে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এ অভিযান চালায়। গোপন খবরের ভিত্তিতে এপিবিএন ঢাকা কাস্টমস হাউস ভবনের পাশে এয়ারপোর্ট রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায়। এ সময় এপিবিএন সদস্যরা দেখতে পান, রেস্তরাঁর ভেতরে ১১৯টি মরা মুরগি পড়ে আছে। সেগুলো জবাই করা হচ্ছে। হাতেনাতে সাতজনকে আটক করে এপিবিএন। খবর পেয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আলী আফরোজের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত ঘটনাস্থলে যান। কথা হচ্ছে সব ক্ষেত্রে গোপন সংবাদ কি আর মেলে? ঢাকাবাসী কতজন যে কত জায়গায় এমন মরা মুরগি / গরু/ খাসির মাংস খেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কে তার খবর রাখে! ওইসব কুলাঙ্গারদের বড় ধরনের শাস্তি দিয়ে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করতে হবে। বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায়... আমাদের রাজধানী শহর যে বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ১ ধাপ ওপরে উঠেছে এটাকে আগে ইতিবাচক ধরে নিয়ে তারপর কাজের কথায় আসতে হবে। বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের নতুন র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। এই তালিকার শেষ দিক থেকে চার নম্বর স্থানে রয়েছে ঢাকা। বিভিন্ন দেশের শহরের ওপর জরিপ চালিয়ে ১৪০টি শহরের র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়েছে। এ তালিকায় ১৩৭ নম্বরে রয়েছে ঢাকা। ইকোনমিস্ট গত বছর বসবাসযোগ্য শহরের যে র‌্যাঙ্কিং করেছিল, তা বাতিল করা হয়েছিল। এ কারণে সর্বশেষ র‌্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। সেই তালিকা অনুসারে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। বসবাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ওই বছর ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৮তম। সেই হিসাব অনুসারে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে ঢাকার। জোর গলায় ঢাকাবাসীকে বলতে হবে এত ধীরগতিতে উন্নতি হলে পুরো এক শতাব্দী লেগে যাবে ঢাকার সুনাম অর্জন করতে। তাই চাই গতি বাড়ানো। নতুন জরিপ অনুসারে ২০২১ সালে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপানের ওসাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার এ্যাডিলেড। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে বসবাসযোগ্য শহরের ক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা এ তালিকায় শীর্ষে ছিল ২০১৮ সাল থেকে। কিন্তু এবার শীর্ষ ১০ শহরের মধ্যে স্থান পায়নি ভিয়েনা। ২০১৯ সালে ভিয়েনার সঙ্গে একই পয়েন্টে নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থান ছিল অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। সেই মেলবোর্নই এবার আট নম্বরে নেমে এসেছে। করোনার মোকাবেলায় কোন্ দেশ কেমন পদক্ষেপ নিয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায়। করোনা মোকাবেলায় বিশ্বজুড়ে এবার নন্দিত হয়েছে নিউজিল্যান্ড। ইআইইউর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে নিউজিল্যান্ড কঠোর লকডাউন আরোপ করেছিল। এর ফলে দেশটির অকল্যান্ড, ওয়েলিংটনসহ বিভিন্ন শহরের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়েছে। এসব শহরের মানুষ করোনাপূর্ববর্তী জীবনে ফিরে যেতে পেরেছে। এবার বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় একেবারে তলানিতে রয়েছে সিরিয়ার দামেস্ক। ১৪০টি শহরের তালিকায় এর অবস্থান ১৪০তম। ১৩৯তম অবস্থানে রয়েছে নাইজিরিয়ার লাগোস। ১৩৮তম অবস্থানে পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরেসবি। এ ছাড়া ১৩৬তম অবস্থানে আলজিরিয়ার আলজিয়ার্স, ১৩৫তম অবস্থানে লিবিয়ার ত্রিপোলি ও ১৩৪তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের করাচী। বসবাসের যোগ্যতার দিক থেকে শহরগুলোর মোট পাঁচটি বিষয়কে সূচকে আমলে নেয়া হয়। এর জন্য মোট ১০০ নম্বর ঠিক করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা পেয়েছে ৩৩ দশমিক ৫ নম্বর। এর মধ্যে শহরের স্থিতিশীলতার দিক থেকে ৫৫, স্বাস্থ্যসেবায় ১৬ দশমিক ৭, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৩০ দশমিক ৮, শিক্ষায় ৩৩ দশমিক ৩ এবং অবকাঠামোতে ২৬ দশমিক ৮ নম্বর পেয়েছে ঢাকা। আমরা সাংবাদিকরা ঢাকার বসবাসযোগ্যতা বাড়াতে নানা সময়ে অনেক কথা বলেছি, নগরবিদদের অভিমত তুলে ধরেছি। এবার একজন স্থপতির মতো তুলে ধরছি। তিনি কিন্তু বলেছেন একেবারে বসবাসের অযোগ্য শহর হলে সেখানে দুই কোটি মানুষ বাস করে কীভাবে? ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিয়ে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যে র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে তার কোন ভিত্তি নেই। ঢাকা এমন একটি শহর না যে বসবাসযোগ্যতার দিক দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত কোন শহরের নিচে নিয়ে যাওয়া হবে। ঢাকা অত্যন্ত সহনশীল ও টেকসই একটি শহর না হলে দুই কোটি মানুষ এটুকু শহরে বাস করতে পারত না। এই ধরনের পরিসংখ্যানগুলো আসলে ভূ-রাজনৈতিক। কোন দেশ বা গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই এমনভাবে করা হয়। শুধু দিল্লীর সঙ্গে তুলনা করলেই দেখা যায়, সেখানে দূষণের কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিতে হয়। সেই তুলনায় ঢাকার বায়ুদূষণ অতটা তীব্র নয়। খ্যাতিমান স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ আরও বলেছেন, ঢাকা শহরকে আরেকটু বসবাসযোগ্য করতে এটাকে বিস্তৃত করে জনঘনত্ব কমাতে হবে। ঢাকায় প্রতি বছর ৩ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। ১০ বছরে ৩০ শতাংশ বেড়ে যাবে। মানুষকে তো বিদায় করা যাবে না, শহর বড় করতে হবে। আমরা ফ্লাইওভার বানাচ্ছি, এক্সপ্রেসওয়ে বানাচ্ছি। সবই ঢাকার মধ্যে করছি। এই একটা এক্সপ্রেসওয়ে যদি ঢাকা থেকে বিস্তৃত হয়ে নরসিংদী যেত, আরেকটি মানিকগঞ্জ যেত, মানুষ আধা ঘণ্টায় নরসিংদী গিয়ে সেখানে থাকতে পারত, তখন মানুষ সেখানেই থাকত। জীবনযাত্রার ব্যয়ও কমত। ঢাকাকে যদি পূর্ব-পশ্চিম দিকে একটু বিস্তৃত করা হয়, বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় তাহলে সঙ্কট অনেক কমে যাবে। অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় আছে ঢাকায়, যেটা ঢাকায় থাকার কোন দরকার নেই। সেগুলো সরিয়ে দিতে হবে। তাহলে ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমবে। আর চাপ কমলেই আমরা বুঝতে পারি। ঈদের সময় ঢাকা অন্য নগরীতে পরিণত হয়। অর্থাৎ জনসংখ্যা কমলে সব সমস্যা কমে যাবে। মহামারী নিয়ে সাহিত্য এবং করোনা আলবেয়ার কামু আস্ত একটা উপন্যাসই লিখেছিলেন মহামারী বিষয়ে প্লেগ নামে। মহামারী নিয়ে বিশ্বসাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠলে কামুর নামটিই বেশি উচ্চারিত হয়। যদিও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং হোসে সারামাগো, এ দুজনের দুটি এ সংক্রান্ত উপন্যাস বহুল পঠিত। উপন্যাস দুটির নাম যথাক্রমে ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ ও ‘বøাইন্ডনেস’। বাংলা উপন্যাসে কি সর্বপ্রথম শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের দ্বিতীয় পর্বে এসেছিল প্লেগের সংক্রমণের ভয়ে রেঙ্গুনে কোয়ারেন্টাইনের কথা? বঙ্কিমের রচনায় যদিও রয়েছে মড়কের বিবরণ। তবে দেশী হোক বা বিদেশী, এসব উপন্যাসই বাস্তব পরিস্থিতিরই বিবরণ। কোনটিই কল্পিত মহামারী নয়। কল্পনায় অভিনব মহামারীর বিবরণের প্রসঙ্গ উঠলে সবার আগে আসবে নিশ্চয়ই দস্তয়েভস্কির নাম। অবশ্য এটির উল্লেখ বিশেষ একটা দেখি না। আমার প্রিয় লেখক, অন্যতম বিশ্বসেরা ঔপন্যাসিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির জন্মই এক অর্থে ভয়ঙ্কর মহামারীর অভিঘাতের ভেতর। ১৮২১ সালে তাঁর জন্মের আগের বছর কলেরা চূড়ান্ত রূপ নিলেও মহামারীটির সূচনা হয়েছিল দস্তয়েভস্কির নিজের দেশ রাশিয়া থেকেই। তাঁর দশ লাখ স্বদেশবাসীকে কেড়ে নেয় কলেরা, আর গোটা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ছিল তেইশ লাখের মতো। লেখকের জীবদ্দশায় আরেকটি মহামারী হয়েছিল, সেটি ১৮৫৫ সালে। এই তৃতীয় প্লেগ মহামারী শুরু হয়েছিল অধুনা করোনার মতোই চীন থেকে। দেড় কোটি মানুষ তার শিকার হয়, তবে ভারতবর্ষে মহামারীর রূপ ছিল মহাপ্রাণঘাতী। রাশিয়ান ফ্ল মহামারীটি হয়েছিল অবশ্য ফিওদরের মৃত্যুর আট বছর পর। এই মহান লেখকের লেখায় গত সপ্তাহে এক মহামারীর উল্লেখ পেয়ে যাব, এমনটি ভাবিনি। চলমান করোনা মহামারীকালে তাঁর ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসটির ভেতর তাই ‘কল্পিত’ মহামারীর বয়ান আমাকে স্তম্ভিত করেছে। পরে জানতে পারি তুরস্কের লেখক ওরহান পামুকও বিষয়টি তুলে ধরেছেন তাঁর একটি আত্মআলোচনাধর্মী লেখায়। মহামারী বিষয়ক উপন্যাস লিখতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তিনি কথাসাহিত্যে মহামারীর বিবরণ সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। তবে দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে বর্ণিত মহামারীটিকে পামুক ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, সেটি মোটেই প্লেগ নয়, অন্যকিছু। একেবারে অভিনব ও রক্তহিম করে দেয়ার মতো আজব এক মহামারী। রীতিমতো বিভীষিকা। যেখানে ভাইরাস নয়, মানুষই মানুষকে হত্যার নৈরাজ্যে মেতে ওঠে। সে প্রসঙ্গেই আসছি। মনে হতে পারে একেবারে অযাচিতভাবেই মহামারী প্রসঙ্গটির প্রবেশ বা অনুপ্রবেশ ঘটেছে দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে। যদিও নির্বাসন দণ্ড ভোগরত এবং অসুস্থতার শিকার নায়কের দুঃস্বপ্নে এই অভিনব মহামারীর বিস্তার নিয়ে কী আর বলা যায়, বাতিলই বা কীভাবে করা চলে! উদ্ধৃতি দিলে পরিষ্কার হবে বিষয়টি। ঢাউশ উপন্যাসটির একবারে শেষ প্রান্তে রয়েছে এর বিবরণ। সারা পৃথিবীতে গুটিকয়েক মানুষই কেবল ওই মহামারী থেকে অব্যাহতি পেলেন, ‘তাঁরা ঈশ্বরের মনোনীত, শুদ্ধচরিত্রের মানুষ।’ জ্বর ও বিকারের ঘোরে রাস্কোল্নিকভ্ স্বপ্নে দেখেছে এই মহামারীর বিস্তার। লেখা হয়েছে: ‘কোথা থেকে এক ধরনের সূ²াতিসূ² রোগজীবাণু দেখা দিয়েছে, মানুষের দেহের ভেতর তারা বাসা বাঁধছে। কিন্তু ঠিক জীবাণু এরা নয়, এরা প্রেতযোনি, যথেষ্ট বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। যে সমস্ত মানুষের দেহে এরা বাসা বাঁধছে তারা সঙ্গে সঙ্গে ভূতগ্রস্তও উন্মাদ হয়ে পড়ছে। একের পর এক লোকবসতি, শহরের পর শহর, পুরোপুরি একেকটা জাতি এই রোগের কবলে পড়ে গেল, উন্মাদ হয়ে গেল। সবাই আশঙ্কাগ্রস্ত, কেউ কাউকে বুঝতে পারে না, প্রত্যেকে ভাবছে সত্য একমাত্র তারই অধিগত। একে অন্যকে দেখে কষ্ট পাচ্ছে, বুক চাপড়াচ্ছে, কাঁদছে, অসহায়ের মতো হাত-পা ছুড়ছে। কেউ জানে না কার বিচার করবে, কীভাবে করবে। কোনটা ভাল কোন্টা মন্দ এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে একমত তারা হতে পারছে না। অর্থহীন বিদ্বেষের জ্বালায় একে অপরকে হত্যায় মেতে উঠছে। বিশাল বিশাল সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়ে এক দল আরেক দলের ওপর আক্রমণের উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু সেনাবাহিনী অভিযানে নামার পথেই আচমকা নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে মেতে উঠছে, বাহিনীর সারি ভেঙ্গে পড়ছে, সৈন্যরা একে অন্যকে আক্রমণ করছে, নিজেদের মেরে-কেটে সাফ করছে, কামড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলছে।...’ লক্ষণীয় দস্তয়েভস্কি বর্ণিত মহামারীর ভাইরাসটির লক্ষ্য হলো মানুষের মস্তিষ্ক। তাতে মানুষ উন্মাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং নিজেরাই নিজেদের মেরে সাফ করছে ঝাড়েবংশে। লেখকের কল্পনাশক্তিকে ইন্টারেস্টিং মনে না হওয়ার কারণ নেই। তৃতীয় প্লেগ মহামারীর সময়ে তিনি পরিণত যুবক, সাইবেরিয়ায় দণ্ড ভোগ করে আসা মানুষ, যিনি কয়েক বছরের মধ্যেই হাত দেবেন এই ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসটি রচনায়। সেখানে শেষভাগে থাকবে সাইবেরিয়ার কারাগারের গল্প এবং চকিত ‘কল্পিত’ মহামারীর উল্লেখ। মহামারীর অভিঘাত লেখকদের লেখায় আসবে, হয়ত আগামীতে এই করোনাভাইরাস নিয়ে রচিত হবে মহৎ কোন উপন্যাস। সে বাংলা ভাষাতেও হতে পারে। বৃষ্টিতে ভিজে তার অপেক্ষা গত সপ্তাহের লেখায় প্রসঙ্গক্রমে পোষা বিদেশি কুকুর হেক্টরের মৃত্যুর কথা লিখেছি। এর পর পরই পড়লাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাবেরী গায়েনের নিচের লেখাটি। পাঠকের সঙ্গে শেয়ার না করে পারলাম না। ‘যে ব্যক্তি মানুষকে ভালবাসে, সে দুঃখের দ্বারা ঘিরে থাকে এবং যে কাউকে ভালবাসে না, তার কোন সঙ্কট নেই। কষ্টকেই ভালবাসতে শেখো। মহামতি গৌতমের এমন কথা এই এত রাতে কোন উস্কানি ছাড়াই কেন মনে পড়ে, তার কোন উত্তর নেই। বাতাসের চেয়ে দ্রæতগামী মন, ধর্মের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন যুধিষ্ঠির। মন শুধু দ্রæতগামীই নয়, মন বড় অবিন্যস্ত ও অস্থির এবং বুদ্ধের কথা এই গভীর রাতে মনে পড়ার সঙ্গে কেন দুজন কুকুরের ভালবাসার ছবি, যা তুলে রেখেছি মাসখানেক আগে এক ঝমঝমে বৃষ্টির প্রায় দুপুরে, মনে পড়বে এমন কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টাও বুঝি বৃথা। অথচ আমার মনে আকাশছেঁচা বৃষ্টির পানির সঙ্গে একাকার হয়ে থাকা সারমেয়প্রেম/বন্ধুত্বের উদ্বেগময় কয়েকটি মুহূর্ত স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে। প্রায় মাসখানেক আগে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছি অফিসের দিকে। আমার এমফিল গবেষক আমার জন্য অপেক্ষা করছেন অফিসে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম আকাশ ঘোর থমথমে। তবুও ভাবলাম, দ্রুতই হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যাবে। বর্ষাতি নেই। কারণ বর্ষাতি নিয়ে বের হওয়া মানে ওটা হারিয়ে আসা। বিধি বাম। আমাদের কম্পাউন্ডের গেট অবধি যেতেই ঝুম বৃষ্টি নেমে গেলে গেটের দারোয়ানরা জায়গা দিলেন দাঁড়ানোর। চরাচর ভিজে যাওয়া বৃষ্টি। আবছা হয়ে পড়েছে সমস্ত দৃশ্যপট। হঠাৎ গেট পেরিয়ে রাস্তায় চোখ পড়তে দেখি সেই বৃষ্টির মধ্যে চুপচুপে ভিজে যাওয়া এক কুকুর চারপাশ দেখছে রাস্তার একেবারে মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। পেছনে গাড়ি কিন্তু কোন ভ্রæক্ষেপ নেই। আমার চোখ ওখান থেকে সরে গেছে ততক্ষণে। গেটের ভেতরে কম্পাউন্ডের বৃষ্টির দিকেই মনোযোগ। খানিক পরে রাস্তায় চোখ যেতে দেখি কুকুরটা ভিজতে ভিজতেই কারোর জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষাটা স্পষ্ট। চোখ ফের চলে গেল অন্যদিকে। বৃষ্টি প্রায় ঝরে এসেছে। এখন দুই কুকুর পাশাপাশি বসা। প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। অন্য কুকুরটি যখন এসেছিল এই সঙ্গীর কাছে, তখন তাদের উত্তেজনা, উন্মাদনা ছিল কি না দেখা হয়নি। কিন্তু তাদের শান্তভাবে বসে থাকাটা দেখলাম। ছবিও তুললাম একটা। কী তাদের সম্পর্ক জানি না। কিন্তু কিছু একটা সম্পর্ক নিশ্চয়ই ছিল। প্রতীক্ষা এবং উদ্বেগের ধরনই বলে দেয় সেটা। ইতোমধ্যে রিক্সা খুঁজে রিক্সায় উঠতে যাবার সময় দেখলাম কুকুর দুজন পাশাপাশি হেঁটে কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকেছে। পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে শান্তভাবে। দুজনেই ভেজা। মোবাইল ততক্ষণে ব্যাগের ভেতর বলে রিক্সায় উঠতে উঠতে আর বের করে ছবি নেয়া হলো না। সব ছবি ক্যামেরায় ধরাও পড়ে না, দরকারও নেই। কিছু ছবি মনে রেখে দিতে হয় বোধহয় এবং অসময়ে গভীর রাতে মনে পড়লে সেই দৃশ্যের কথা, ফুলার রোডের স্মৃতি হিসেবে ফেসবুকে লটকেও দেয়া যায় হয়ত। যখন অসুস্থ অপারগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে আমরা ফেসবুকের কম-বেশি সমালোচনা করি। হয়ত এর অপব্যবহার হয় বেশি। সময় নষ্ট করে। তার পরও কখনও কখনও বেশ টনিক হয়ে ওঠে। হাড়ে চোট পেয়ে টানা ২১ দিন শুয়ে থাকার পর পরম করুণাময় আল্লাহপাকের অনুগগ্রহে ওয়াকার নিয়ে হাঁটা শুরু করেছি। এই প্রথম বন্ধুদের জানালাম আমার শারীরিক অবস্থা। সাড়ে পাঁচ শ’ ব্যক্তি প্রতিক্রিয়া জানালেন। তিন শ’র বেশি মন্তব্য / পরামর্শ / শুভকামনা মিলল। এটি কি আনন্দদায়ক নয়? এ থেকেও সম্পর্কের পরিমাপ করা চলে হয়ত। বোঝা যায় কার অনুভব কেমন। ১৩ জুন ২০২১ [email protected]
×