ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ শফিকুর রহমান

করোনা পরিস্থিতির অবনতি ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট

প্রকাশিত: ২১:৩০, ১৪ জুন ২০২১

করোনা পরিস্থিতির অবনতি ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট

বাংলাদেশে ঈদের আগে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও বর্তমানে যেভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে, তাতে করোনা পরিস্থিতি সীমান্তবর্তী দেশ ভারতের মতো ভয়াবহ আকার ধারণ করার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা পরিস্থিতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগী যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, তাতে ইতোমধ্যেই হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন ওয়ার্ডের আইসিউ বেডসহ অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং সাধারণ বেড সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমনকি মেঝেতেও জায়গা নেই। এমতাবস্থায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে করোনা রোগীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বেশিরভাগ জেলাতেই সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। গত শুক্রবার করোনার হটস্পট মংলায় সংক্রমণের হার ৬১.২২ শতাংশ থেকে নেমে ৫০. ৯৮ শতাংশে এলেও পার্শ্ববর্তী রামপাল উপজেলায় করোনা শনাক্তের হার বেড়ে ৭২.৭২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমান সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ভারতের ট্রিপল মিউট্যান্ট বি.১.৬১৭.২ নামে পরিচিত করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং ১৬ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকার বি.১.৩৫১ মিউট্যান্ট বা বিটা ভ্যারিয়েন্ট। ইতোমধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে এবং এটি সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে আস্তে আস্তে পাশের জেলাগুলো ও ঢাকাসহ অন্যান্য দূরবর্তী জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে বলে করোনার উর্ধমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কাজেই এ সময় অধিক সংক্রমণশীল এ ভয়ঙ্কর ভ্যারিয়েন্টগুলোর কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হবে। করোনা মহামারীতে বার বার দেখা গেছে, সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমার ফলে প্রশাসন ও মানুষ বিধিনিষেধকে ভুলে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এবং করোনাকে এড়িয়ে চলাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বেমালুম ভুলে যায়। কিন্তু কিছুদিন পরই আবার নতুন রূপে মাথাচাড়া দিয়েছে করোনাভাইরাস। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি সত্ত্বেও নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টির কারণে অদূর ভবিষ্যতে নতুন বিপদের আশঙ্কা করছেন তারা। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য ৬৩ শতাংশ মানুষকে প্রথম ডোজ ও ৪৩.৫ শতাংশকে দুটি ডোজ দিয়ে টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য সত্ত্বেও করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যুক্তরাজ্যে দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ায় ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে মোট আক্রান্তের ৯১ শতাংশ মানুষ করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। কোভিড-১৯ এর মূল স্ট্রেইনের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি সংক্রমণশীল যুক্তরাজ্যের আলফা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বিগুণ হারে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম বলে যুক্তরাজ্যের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউট এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ রিসার্চের এক গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মারাত্মক অসুস্থতার ঝুঁকিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি। সম্প্রতি ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখা যায়, ফাইজারের টিকার একটি ডোজ গ্রহণকারীদের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে নিম্ন স্তরের এ্যান্টিবডি তৈরি করেছিল। ফাইজারের একক ডোজ গ্রহণের পরে আলফা, ডেল্টা ও বিটা ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতা যথাক্রমে ৫০, ৩২ ও ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যদিও এটি কোভিড-১৯ এর মূল স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে ৭৯ শতাংশ কার্যকর। যুক্তরাজ্যের সায়েন্টিফিক এ্যাডভাইজরি গ্রুপ ফর ইমার্জেন্সিস (এসএজিই) জানিয়েছে, যারা করোনার টিকার দুটি ডোজ নিয়েছেন, তারা করোনার আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকেও একই রকমের সুরক্ষা পাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দুটি ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ডেল্টা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৩.৭ শতাংশ। তাই সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গবেষকদের মতে, করোনায় আক্রান্ত বহু সংখ্যক মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হওয়া থেকে রক্ষা করছে টিকা। কাজেই টিকার মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন ছাড়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। সুতরাং করোনার হটস্পট অঞ্চলগুলোতে কার্যকর লকডাউনসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাদান কর্মসূচী এগিয়ে নিয়ে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারলেই কেবল করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তাই আমরা আশা করব, সরকার দেশের উন্নয়নের চেয়ে করোনা থেকে মানুষের সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে এবং অর্থ নয় টিকাই বিবেচ্য বিষয় মনে করে যতদূর সম্ভব অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন উৎস থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা সংগ্রহ করে করোনার মৃত্যুঝুঁকি থেকে প্রতিটি মানুষকে রক্ষা করবে। টিকার মাধ্যমে করোনা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত এসব ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আরও কার্যকর করা না হলে সংক্রমণ আরও বাড়বে। করোনা সংক্রমণ রোধে এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। যার ফলে করোনার হটস্পট জেলাগুলোতে নানা সতর্কতার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না জনগণ। করোনা যতদিন থাকবে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টও আসবে। তাই সবাইকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা ও যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় সেখানে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালনে এগিয়ে এলেই করোনার সব ভ্যারিয়েন্টই ঠেকানো যাবে। করোনা মোকাবেলায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি পালনে প্রশাসনের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×