ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তাক্ত মাতৃভাষা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১৪ জুন ২০২১

রক্তাক্ত মাতৃভাষা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা

॥ তিন ॥ মাতৃভাষাভিত্তিক ডিজিটাল বিশ্ব- এর আগে আমরা বিশ্বের মাতৃভাষা আন্দোলনসমূহের খ-চিত্র তুলে ধরেছি। এসব আন্দোলন যারা করেছেন তারা ইংরেজীময় একটি দুনিয়াতে ইংরেজীসহ অন্যান্য প্রধান ভাষাসমূহের দাপটের মাঝেও তাদের মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য লড়াই করেছেন। বেশির ভাগ ভাষা আন্দোলন হয়েছে একতরফা কোন ভাষা চাপিয়ে দেবার বিপক্ষে। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা ছাড়া প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতাও ছিল। সেসব ভাষা ডিজিটাল যন্ত্রে লেখা যেত না। কারণ কম্পিউটারের জন্ম ইংরেজী জানাদের হাতে এবং মেকিন্টোস বাজারে আসার পূর্ব পর্যন্ত কম্পিউটারে ইংরেজী ছাড়া আর কোন ভাষা লেখা যেত না। ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম কাজটিকে আরও সহজ করে দিয়েছে। তবে ততোদিনে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা দূর করতে বহু দেশ তাদের হরফ বিসর্জন দিয়েছে। তাদের পরিণতি কি হয়েছে এর একটি বড় দৃষ্টান্ত ডেনমার্ক। তারা ডেনিস হরফ ছেড়ে রোমান হরফ গ্রহণ করে। এখন তাদের দেশের শতকরা ১৩ ভাগ মানুষ ডেনিস বলতে ও পড়তে পারে না। অন্যান্য যারা রোমান হরফ গ্রহণ করেছেন তারাও ভাল নেই। এখনও বিশ্বের বহু লোক বলবে কি দরকার ছিল মাতৃভাষার। ইংরেজী হলেই তো হতো। অন্তত ইংরেজী হরফটা নিলেই হতো। অথচ কেউ বোঝে না ইংরেজী বাংলার বা বিশ্বের আরও অনেক ভাষার মতো বিজ্ঞানসম্মত ভাষা নয়। ইংরেজী হরফ দিয়ে বাংলাসহ বহুভাষার অনেক অক্ষর লেখা যায় না। শিরোনামটা অবাক করতে পারে। সারা বিশ্বে আমরা এখনও যখন ইংরেজীর দাপট দেখি তখন মাতৃভাষাময় ডিজিটাল বিশ্ব এমন কথা কি বলা যায়? আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচার আচরণ দেখলে রীতিমতো হাসিঠাট্টার মতো মনে হতে পারে। তবে আমি করজোরে এ কথা বলতে পারি যে, এমন সিদ্ধান্ত আমার নয়। ২০১২ সালে প্রকাশিত ঘঊঞ.খঅঘএ: ঞঙডঅঊউঝ ঞঐঊ গটখঞও খওগঐটঅখ ঈণইঊজঝচঅঈঊ বইটি পড়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত প্রকাশ করছি আমি। বইটি বেশ বড়। ৪৪৩ পৃষ্ঠায় ডিজিটাল দুনিয়ার মাতৃভাষা কেমন থাকবে তার আলোচনা হয় সেই ২০১২ সালে। ৪টি অংশে বিষয়টি নানা জনের লেখায় সমৃদ্ধ। আমি পুরো বইতো তুলে ধরতে পারব না। তবে যে প্রসঙ্গটি বহুল আলোচিত সেটি হচ্ছে ইংরেজীর দাপট কি ডিজিটাল যুগেও বজায় থাকবে? মাইকেল অস্টিনফের লেখার কিছু বিষয়বস্তু আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। অস্টিনফের নিবন্ধটির শুরুতেই বলা আছে, ১৯৯০ সালের দিকে বিশ্বজুড়ে এমন ধারণার জন্ম নিয়েছিল যে ইন্টারনেট মানেই ইংরেজী। তিনি বলেছেন, ২০১২ সালেই ইংরেজীর আধিপত্য শতকরা ৫০ ভাগে নেমে এসেছে। তার মতে ১২ সালে ইংরেজীর বিরুদ্ধে প্রবল লড়াইটা করেছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন। অস্টিনফ আজকের অবস্থাটি যদি জানতেন তবে তার তালিকাটা অন্য রকম হতো। আমি বাংলা ভাষার কথা বলতে চাই। ফেব্রুয়ারি ২১ মাসে ফেসবুক আমাকে জানিয়েছে এর আগের তিন মাসে ফেসবুকের ডাটাবেজে প্রবেশ করেছে ৩ কোটি শব্দ। ফেসবুকের তথ্যকে সমর্থন করে বিবিসির সাম্প্রতিক তথ্যাদি। বিবিসিই মনে করে যে, ইংরেজীর দিন ফুরাতে শুরু করেছে। এর পেছনে প্রধানত কারণ হচ্ছে প্রযুক্তি। প্রথমত অনলাইনে বিশ্বের প্রধান ভাষাসমূহ লেখার কোন সীমাবদ্ধতা আর নেই। প্রযুক্তি ভাষার স্বয়ংক্রিয় অনুবাদ, বানান শুদ্ধকরণ, ওসিআর ইত্যাদি কাজকে সহজ করে দিয়েছে। সামনের দিনে এসব আরও সহজ হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের ফলে। বাংলা ভাষাÑ আমার বন্ধু-সহপাঠী ও সহকর্মী মুহম্মদ জালাল এর একটি বই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছি। এখনও রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছি। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ আমার বিভাগ থেকে বাংলা ব্যবহারের জন্য নতুন করে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ডাক ও টেলি যোগাযোগ বিভাগের উপসচি? স্বাক্ষরিত এই স্মারকের পত্রে ১৪.০০.০০০.০০১.০১৬.০৮০.১৭,১৭৬ বিভাগের সকল কাজে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আপনারা জানেন, এর আগে বঙ্গবন্ধু সরকারী কাজে বাংলা ব্যবহারের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন আইন ১৯৮৭ প্রণীত হয়েছে (৮৭ সালের দুই নাম্বার আইন), যাতে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনের তিন নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, ‘৩। (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। (২) ৩(১) উপ-ধারায় উল্লিখিত কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনী ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে। (৩) যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’ বলাবাহুল্য এই আইনটি সংবিধানের তিন নাম্বার অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত। বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা- বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার জন্য তার জীবনটাই উৎসর্গ করেন। ছোট্ট করে তার কিছু ভাবনা চিন্তা এখানে তুলে ধরতে পারি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ‘আমরা বাঙালী। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমি যদি ভুলে যাই আমি বাঙালী, সেদিন আমি শেষ হয়ে যাব। আমি বাঙালী, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি, আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরবো, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা আমার কৃষ্টি ও সভ্যতা।’ প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তিনি বলেছেন-‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভিতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে জানে না এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন, দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজীতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’ ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি বলেন, ‘আমরা ইংরেজী বলতে পারব, তবে বাংলাতেই আমরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যদি পরিষদে আমাদের বাংলায় বক্তৃতার সুযোগ না দেওয়া হয় তবে আমরা পরিষদ বয়কট করব। বাংলাকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করব।’ ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের প্রাক্কালে বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার ওপর বঙ্গবন্ধু বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য, ১৯৫২ সালের মতো যে-কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকারের জন্য বাঙালীকে আহ্বান জানান। ১৯৬৯ সালের ১ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রকাশ উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ভাষা-ভাবনার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে। সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘পাকিস্তানের সর্ব অঞ্চলে মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ শিক্ষার মাধ্যম রূপে গ্রহণ করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে যত শীঘ্র সম্ভব শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রচলন করিতে হইবে এবং পাকিস্তানের সরকারী ও বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠানের এবং ব্যবসাবাণিজ্য ও ব্যবসায়িক জীবনে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রসারের চেষ্টা করিতে হইবে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার উন্নতি ও বিকাশের জন্য কার্যকরী উৎসাহ প্রদান করিতে হইবে এবং সকল প্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।’ স্বাধীনতার পর অতি অল্প সময়ে বাংলা ভাষায় সংবিধান রচনা করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। আদালতের রায় বাংলা ভাষায় লেখার নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। যথাযথ পরিভাষা না থাকার কারণেই রাষ্ট্রের সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিতে পারে, এ কথা অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বঙ্গবন্ধু যে কত আন্তরিক ছিলেন, উপরের ভাষ্য থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। (অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ : উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ-এর নিবন্ধ থেকে নেয়া) ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সর্বশেষ সম্পাদনা ১২ জুন ২১ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক [email protected] www.bijoyekushe.net.bd www.bijoydigital.com
×