ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহান বিশ্বাস

অভিমত ॥ আরেক ‘বীর উত্তম’ খেতাবের ভাগ্য নির্ধারণের পালা

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১৩ জুন ২০২১

অভিমত ॥ আরেক ‘বীর উত্তম’ খেতাবের ভাগ্য নির্ধারণের পালা

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত চার খুনীর রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ প্রজ্ঞাপন জারি করে। আত্মস্বীকৃত চার খুনী হলেন- লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম ‘বীর উত্তম’, লে. কর্নেল এস এইচ এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী ‘বীর বিক্রম’, লে. এ এম রাশেদ চৌধুরী ‘বীর প্রতীক’ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ‘বীর প্রতীক’। গত ৯ ফেব্রæয়ারি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৭২তম সভায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত চার খুনীর রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলের সুপারিশ করা হয়। সেই সিদ্ধান্তের আলোকেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য শহীদদের হত্যা মামলার আত্মস্বীকৃত খুনী মৃত্যুদণ্ডরাপ্ত ওই চারজনের খেতাব বাতিল করা হয়। খেতাব বাতিলের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ অন্য শহীদদের হত্যাকারী, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ঘৃণ্য এই চার খুনীর মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বসূচক খেতাব থাকা জাতির জন্য চরম লজ্জাকর। সেজন্যই তাদের খেতাব বাতিল করা হয়েছে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী ও মোসলেম উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী হলেও খুনের নেপথ্যে ছিলেন জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টরের একটিতে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন মেজর জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি সেনাপ্রধান হন। ৭ নভেম্বর দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পর শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন ওই সময়কার মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৬ সালের ২৯ নবেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। পরের বছর ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জিয়া ওই দায়িত্ব নেন। ওই সময় জিয়ার সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে গণভোটের আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা। সে সময় ঢাকা সেনানিবাসে লে. কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুর তিন বছর আগে ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে একটি সাক্ষাতকার দেন তিনি। জানান, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর পাঁচটার দিকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর রশিদের নেতৃত্বে একদল সেনা তাঁর (বঙ্গবন্ধু) বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমিন আহমেদ চৌধুরী তখনও জানতেন না যে, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। মেজর রশিদের নেতৃত্বে সৈন্যরা আমিন আহমেদ চৌধুরী এবং তৎকালীন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে যায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে। জেনারেল জিয়া তখন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান। তার বাড়িতে ঢোকার সময় রেডিওর মাধ্যমে আমিন আহমেদ চৌধুরী জানতে পারেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। জেনারেল জিয়া তখন একদিকে শেভ করেছেন একদিকে শেভ করেননি। ¯িøপিং স্যুটে দৌড়ে এলেন। শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শাফায়াত কি হয়েছে? শাফায়াত বললেন, এ্যাপারেন্টলি দুই ব্যাটালিয়ন স্টেজড্ এ ক্যু। বাইরে কি হয়েছে এখনও আমরা কিছু জানি না। রেডিওতে এ্যানাউন্সমেন্ট শুনতেছি প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন। তখন জেনারেল জিয়া বললেন, সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।’ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মাত্র দশ দিনের মাথায় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়া জিয়াও ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ এসেছে। জাতির জনকের খুনীদের রক্ষায় সে সময় একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন তখনকার ‘স্বঘোষিত’ রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সংবিধান সংশোধন করে খুনীদের রক্ষার পথটি স্থায়ী করার প্রয়াস চালান। হত্যাকারীদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃত করেন। সংবিধান লঙ্ঘন করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের দেশত্যাগে সহায়তা এবং তাদের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত করে গুরুত্বপূর্ণ পদে উন্নীত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সামরিক শাসন জারি করে জিয়াউর রহমান সংবিধান কাটাছেঁড়া করেন। বাতিল করেন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘দালাল আইন’ বাতিল করেন তিনি। ১৯৭৬ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তনের জন্য ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি রহিত করেন। ১৯৭৭ সালে সংসদে আল বদরদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ বাদ দেন। এক সময় যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল, তা ফেরত পাওয়ার জন্য তাদের আবেদনের অনুরোধ শুরু হয়। সেই সুযোগেই ১৯৭৮ সালে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম পাকিস্তানী পাসপোর্ট ও বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদী ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। গোলাম আযমের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছে আবারও দরখাস্ত করেন। গোলাম আযম বলেন, ‘আমার বৃদ্ধা অসুস্থ মায়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে রাষ্ট্রপতি আমাকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ দেন।’ এরপর থেকে বাংলাদেশেই থেকে যান গোলাম আযম। জিয়াউর রহমানের সময়ই সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ রহিত করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন ইতিহাসের আরেকটি কালো দিন। এদিন জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হত্যাকারীদের ১২ জনকে (লে. কর্নেল ডালিমকে চীনের, লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায়, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজিরিয়ায়, মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে, মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায়, মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে, মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে, মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেমকে আবু ধাবিতে, লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে, লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় এবং লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে) সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে সাহায্য করেন। দেশের জনকের খুনীদের এভাবে পুরস্কৃত করার ঘটনা বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধুর খুনের বিচারের পথ প্রশস্ত হয়। ওই বছর খুনী রাশেদ চৌধুরী ব্রাজিল থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান। সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলে ২০০৪ সালে এটি মঞ্জুর করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত চেয়ে অন্তত পাঁচবার আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করে বাংলাদেশ। এরপর ২০১৮ ও ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবার চিঠি দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন মঞ্জুর সংক্রান্ত কাগজপত্র পুনর্বিবেচনার জন্য চেয়ে পাঠায়। বিভিন্ন আইনজীবীর কাছে এ বিষয়ে মতামত জানতে চান তিনি। ১৯৯৮ সাল থেকে কানাডাতে অবস্থান করছে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী নূর চৌধুরী। তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য অনেকবার আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয় কানাডা সরকারকে। নূর চৌধুরী এবং তার স্ত্রীর রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন খারিজ করে দেয় কানাডা সরকার এবং কোর্ট। তখন থেকে নূর চৌধুরী কোন স্ট্যাটাস ছাড়াই কানাডাতে অবস্থান করছে। পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০৪ এবং পরে ২০০৭ সালে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর জন্য কানাডা ডিপোরটেশন আদেশ জারি করলেও ওই সময়কার বাংলাদেশ সরকারের অনাগ্রহের কারণে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী ডালিম ১৯৯৫ সালে কেনিয়াতে রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন অবস্থায় অবসরে যান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী হিসেবে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে এখনও পলাতক রয়েছেন ওইসব খেতাবধারী। এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট পালিয়ে থাকা ওই চারজনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া বীরত্বের খেতাব স্থগিতের নির্দেশ দেয়। সেই প্রেক্ষাপটে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ফেব্রæয়ারির বৈঠকে খেতাবগুলো বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ঘটনার ক্রম এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়ানো কৌশলী কারিগরের ‘বীর উত্তম’ খেতাবের ভবিষ্যত নিয়ে যে সবার আগ্রহ শীর্ষে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। লেখক : সাংবাদিক
×