ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইনেই হচ্ছে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি চর্চা

প্রকাশিত: ২১:৫৩, ১২ জুন ২০২১

অনলাইনেই হচ্ছে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি চর্চা

মনোয়ার হোসেন ॥ মহামারীর আগ্রাসনে বদলে গেছে জীবনের চালচিত্র। যাপিত জীবনের পরতে পরতে এখন মিশে আছে ভয়ঙ্কর করোনা থেকে রক্ষার সতর্কতা। আর জীবন যখন হুমকির সম্মুখীন তখন স্বাভাবিকভাবেই বাধাগ্রস্ত হয় শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা। নির্মল আনন্দের আগে ভাবতে হচ্ছে জীবন বাঁচানোর কথা। সেই সুবাদে সংক্রমণ প্রতিরোধে বন্ধ রয়েছে উন্মুক্ত আঙ্গিনা কিংবা মিলনায়তনকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতা। স্বাস্থ্য সুরক্ষার সরকারী নির্দেশনা মেনে জনসমাগম পরিহারের প্রেক্ষাপটে হচ্ছে না কোন সঙ্গীতাসর থেকে নৃত্যানুষ্ঠান। শোনা যাচ্ছে না যাত্রাশিল্পীর উচ্চারিত উচ্চলয়ের সংলাপ। যাত্রাপালার মতো একই দশা মঞ্চনাটকের। রাজধানীসহ সারা দেশের নাট্যমঞ্চগুলোয় বিরাজ করছে শূন্যতা। অল্প কিছু সিনেমা হল চালু থাকলেও দেখা নেই দর্শকের। মুক্তি পায় না নতুন কোন চলচ্চিত্র। শহর ঢাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেকগুলো গ্যালারি থাকলেও হাতেগোনা দুই-একটি বাদে বাকিগুলোয় বন্ধ রয়েছে প্রদর্শনী। প্রদর্শনালয়ের দেয়ালগুলোয় ঝুলছে না চিত্রকরের রং-তুলির আঁচড়মাখা চিত্রকর্ম। তবে এই হতাশার উল্টোপিঠে ভিন্ন পথরেখায় জ্বলে উঠেছে আশার আলো। করোনাকালের নতুন বাস্তবতায় বিকল্প পথে ধাবিত হয়েছে সংস্কৃতি চর্চা। সরাসরি আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে অনলাইনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে নানা আয়োজন। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজ কিংবা ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচারিত হচ্ছে সেসব অনুষ্ঠান। সেই সুবাদে বর্তমানে অন্তর্জালেই প্রবাহিত হচ্ছে সংস্কৃতির স্রোতধারা। হচ্ছে সঙ্গীতানুষ্ঠান থেকে নৃত্যানুষ্ঠান। বাদ পড়ছে না কবিতার শিল্পিত উচ্চারণের আবৃত্তি পরিবেশনা। কখনও বা শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর দেখা মিলছে অনলাইনে। এমনকি বড় পরিসরের চলচ্চিত্র উৎসব থেকে প্রয়াত শিল্পীদের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে স্মরণানুষ্ঠান। আর অস্থির সময়ে শ্রোতা-দর্শকরাও স্বস্তির সন্ধানে সংযুক্ত হচ্ছেন এসব অনুষ্ঠানে। ঘরে বসেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উপভোগ করছেন বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক আয়োজন। বিভিন্ন অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজকরা বলছেন, সাধারণত দর্শকের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে অনুষ্ঠান। শ্রোতা বা দর্শকের অনুভূতি স্পর্শ করে মঞ্চের শিল্পীকে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও শ্রোতা-দর্শকের তাৎক্ষণিক অনুভূতি পাওয়া যায়। একজন শিল্পরসিকের শরীরী উপস্থিতি না থাকলেও অনলাইন আয়োজনে থাকে মানসিক উপস্থিতি। এটা একটা ভিন্ন জগত। ভিন্ন ধারা। নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজন করলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও একটা বিশাল দর্শকগোষ্ঠী পাওয়া যায়। যাদের অনেকেই হয়তো আয়োজিত অনুষ্ঠানে আসতে পারছেন না। সব মিলিয়ে সাম্প্রতিককালে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় সচল রয়েছে সংস্কৃতি ভুবন। এসব অনুষ্ঠান ঘরবন্দী মানুষের একঘেয়ে জীবনে সুরের ছোঁয়ায় রঙ্গিন করে তুলছে। ঢাকার মিলনায়তন বা মঞ্চগুলোয় নীরবতা বিরাজ করলেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম পূরণ করছে সেই শূন্যতা। নিয়মিতই বিভিন্ন রাজধানীর সাংস্কৃতিক আয়োজনে হাজির হতেন পুরান ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা তাসনিম আনোয়ার। কথা প্রসঙ্গে এই শিল্পানুরাগী বলেন, সেগুন বাগিচার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা কিংবা বেইলী রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তন ছিল আমার অবসর উদ্্্যাপনের গন্তব্য। নিয়মিত মঞ্চনাটক দেখে কেটে যেত সুসময়। এরই বাইরে বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন সঙ্গীতাসর, নৃত্যানুষ্ঠান বা শিল্পকর্ম প্রদর্শনীগুলো ছিল আমার কাক্সিক্ষত গন্তব্য। বর্তমানে এসব আয়োজন না থাকায় কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে। তাই বলে শিল্প-সংস্কৃতির নির্যাস থেকে একেবারে বঞ্চিত নই। অনলাইনে বৈচিত্র্যময় নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে। ঘরে বসেই ফেসবুক বা ইউটিউব চ্যানেলনির্ভর সেসব অনুষ্ঠান উপভোগ করছি। অনলাইনে সংস্কৃতিচর্চার দারুণ এক উদাহরণ নবম লিবারেশন ডকফেস্ট বাংলাদেশ। বিশাল পরিসরের এই প্রামাণ্যচিত্র উৎসবটির আয়োজন করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। দেশ-বিদেশের মুক্তির সংগ্রাম আর মানবিকারবিষয়ক তথ্যনির্ভর চলচ্চিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে পাঁচ দিনের এই উৎসব। দর্শকরা চাইলে বিনা দর্শনীতে উপভোগ করতে পারছেন এসব ছবি। চলচ্চিত্রের এ আসরে দেখানো হচ্ছে ৫১ দেশের নির্বাচিত ১৬৪ প্রমাণ্যচিত্র। ৮ জুন থেকে শুরু হওয়া উৎসবটি চলবে ১২ জুন পর্যন্ত। উৎসবের ছবি দেখতে হলে ঢুঁ মারতে হবে উৎসবের ওয়েবসাইটে। সেই ঠিকানাটি হচ্ছে উৎসবের ওয়েবসাইট । করোনাকালে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বৈচিত্র্যময় ধারার সঙ্গীতাসরের আয়োজন করছে সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ। সংগঠনটি গত বছরের জুন থেকে চলমান জুন মাস পর্যন্ত ১২৫ দিন সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আর এসব সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে সংস্কৃতি ভুবনে যুক্ত হয়েছে নবমাত্রা। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ড. বিশ্বজিৎ রায়ের নিরলস প্রচেষ্টায় হচ্ছে এসব অনুষ্ঠান। এই গুণী শিল্পী কখনও সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, কখনও সৃজনশীল গানের দল নিবেদন, কখনও রাধারমণ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের ব্যানারে নিরলসভাবে বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এই সংগঠক ও শিল্পী বলেন, গত বছর বিশ্ব সঙ্গীত দিবসকে কেন্দ্র করে শুরু করি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠান আয়োজন। একটানা পাঁচ দিন অনুষ্ঠান করি। এরপর রাধারমণ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের ব্যানারে টানা ১৫ দিন অনুষ্ঠান করেছি। সেই সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের সম্মানীও দেয়া হয়েছে। এছাড়া লোককবিদের নিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন বিশ্বজিৎ রায়। জানালেন, জালাল খাঁ, শরৎ বাউল, উকিল মুন্সী, দুরবীন শাহ, শাহ আবদুল করিম, সৈয়দ শাহানুর, সীতলং শাহ, বিজয় সরকার, পাগলা কানাই, ধবা পাগলা, আরকুম শাহ- এমন বিশ জন বাউলকে নিয়ে বিশটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এখন করছেন ‘নাগরিক পল্লী কবি’ নিয়ে অনুষ্ঠান। এই আয়োজনে উপস্থাপিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্্দীনসহ বিভিন্ন শহুরে কবির লোকজ আঙ্গিকের সঙ্গীত। সাংস্কৃতিক মনীষী ও গুণীজনদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনলাইনে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনার আয়োজন করছে শিল্পকলা একাডেমি। পথিকৃৎ চিত্রকর এস এম সুলতান, বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, প্রখ্যাত নজরুলঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগম, কিংবদন্তি শিল্পী আব্দুল আলীম, আব্দুল লতিফসহ গুণী শিল্পীদের মূল্যায়নের পাশাপাশি তাদের সৃষ্টিকর্মের নির্যাসে সাজানো হয়েছে এসব আয়োজন। খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পীরা পরিবেশনার পাশাপাশি বিশিষ্টজনদের মূল্যায়নধর্মী আলোচনানির্ভর অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করছেন শ্রোতা-দর্শকরা। অনুষ্ঠানের উপভোগের পাশাপাশি এসব শ্রোতা-দর্শক গুণীজনদের প্রকাশ করছেন নিজেদের ভালবাসা। নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে মাসব্যাপী অনলাইনে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে নজরুল একাডেমি। মে মাস থেকে সূচনা হওয়া এই আয়োজনে নজরুলঙ্গীত পরিবেশন করছেন দেশ-বিদেশের শিল্পীরা। একইভাবে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটও রবীন্দ্র, নজরুলজয়ন্তীসহ নিয়মিতভাবে অনলাইনে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন। এছাড়া দেশে এবং দেশের বাইরে থেকেও বিভিন্ন সংগঠন প্রায় নিয়মিতভাবেই নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। যেমন রবীশঙ্কর মৈত্রী ফ্রান্স থেকে আয়োজন করেন ‘সহজ মানুষ’ শিরোনামে অনুষ্ঠান। ফ্রান্স থেকে কিরণময় ম-ল আয়োজন করেন ‘অনন্তধ্বনি’। ঢাকা থেকে অসীম বাইন ‘সোনারতরী’ নামে নিয়মিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন। বনা হালদার আয়োজন করেন ‘আমার গান’ শিরোনামের সঙ্গীতানুষ্ঠান। সুনামগঞ্জের দিরাই থেকে ‘কুটুমপাখি’ নামে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠিত বেশ কিছু অনলাইননির্ভর কবিতা উৎসবের মন রাঙ্গিয়েছে কবিতাপ্রেমীদের। প্যারিসের জানালা নামে আন্তর্জাতিক বাংলা কবিতা উৎসবে বাংলা ভাষার কবিদের এক মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল। অন্তর্জালের এ ধরনের আয়োজনকে সাধুবাদ জানিয়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণেই দর্শক সমাগম ঘটিয়ে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বর্তমানে সম্ভব নয়। সেই বাস্তবতায় সংস্কৃতিচর্চাটি এখন মিলনায়তনের পরিবর্তে পৌঁছে গেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। ফলে অচল হওয়ার পরিবর্তে সচল রয়েছে শিল্প-সংস্কৃতির গতিধারা। মূলত করোনার প্রভাবে গত বছরের মার্চ মাস থেকে সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে স্থবিরতা। সেই স্থবিরতায় ঢাকা লিট ফেস্ট কিংবা ঢাকা ফোক ফেস্টের মতো আন্তর্জাতিক আসর অনুষ্ঠিত হয়নি। গত বছরের মার্চে থমকে থাকা সংস্কৃতি পুনরায় সচল হয় আগস্ট মাসে। ২৮ আগস্ট মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় লাল জমিন নামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মঞ্চনাটক। এরপর পুরনো নাটকের পাশাপাশি রাজধানীর নাট্যমঞ্চে প্রদর্শিত হয় বেশ কিছু নতুন নাটক। এভাবে বিগত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই সময়টিতে বিষয়ভিত্তিক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। এছাড়াও সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, ছায়ানট, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী প্রায় নিয়মিতভাবেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এছাড়া মহামারীকে সঙ্গী করেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরিসহ প্রদর্শনীসহ বেশ কিছু ভার্চুয়াল প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে কয়েকটি প্রদর্শনালয়। এই গ্যালারিগুলোর মধ্যে রয়েছে লাল মাটিয়ার শিল্পাঙ্গন, উত্তরার গ্যালারি কায়া, ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয় ও মোহাম্মদপুরের কলাকেন্দ্র।
×