ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার গতি-প্রকৃতি কোন্ পথে, খন্ডিত ভাবনার যোগফল কি

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ১২ জুন ২০২১

করোনার গতি-প্রকৃতি কোন্ পথে, খন্ডিত ভাবনার যোগফল কি

সমুদ্র হক ॥ এক বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত। সাধারণ মানুষ এখনও জানে না কোভিড-১৯ গতি প্রকৃতি কোন পথে। সবাই নিজেদের মতো করে ভাবছে। শিক্ষার্থীদের ভাবনা, কবে স্কুল-কলেজ খুলবে! মেডিক্যাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভ্যাকসিনের অপেক্ষায়। ভ্যাকসিনেশনের পর তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে, এমনটি আশা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পেশাজীবীর ভাবনা, গৃহস্থ ও কৃষকের ভাবনা, সিনেমা নাটকের শিল্পীর ভাবনা, ব্যবসায়ীর ভাবনা, শ্রমিকের ভাবনা, সাধারণ মানুষের ভাবনা হরেক রকম। প্রথম ঢেউয়ে মানুষ যতটা সচেতন হয়ে সাবধানতা অবলম্বন করেছিল দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই অবস্থা নেই। সাধারণ মানুষ এখনও অসচেতন। শহরের সচেতনরাও কখনও অসচেতন। গ্রামের মানুষের মধ্যে মুখের ঢাকনা (মাস্ক) শারীরিক দূরত্বের বালাই নেই। তারা বাসে ট্রেনে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, অটোবাইকে চড়ে কৃষি পণ্যসহ নানা পণ্য নিয়ে শহরে আসছে। বেচাকেনা করে ফিরে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। যে এলাকায় কঠিন লকডাউন সেখানকার লোকজন নানা ছুতোয় ঘর থেকে বের হচ্ছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট খুব খারাপ এ কথা সকলেই জানতে পারছে মিডিয়ার কল্যাণে। তারপরও যেন গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে। ভ্যাকসিন নিয়ে শঙ্কায় আছে মানুষ। মানুষ এখন চাইছে দ্রুত ভ্যাকসিন নিতে। কিন্তু ভ্যাকসিন কবে আসবে। কবে সুরক্ষায় রেজিস্ট্রেশন শুরু হবে। যারা এ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজ পাননি তারা আছেন দুই শঙ্কায়। ১. এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার বদলে ফাইজারের টিকা নিলে কি হয়। ২. যদি ম্যাচ না করে! যারা এখনও নেননি তারা আরেক ধরনের শঙ্কায় আছে- দুই ধরনের চীনা টিকা, দুই ধরনের রাশিয়ার টিকা না বৈশ্বিক জোটের কোভ্যাক্স টিকা। একবার বলা হলো চীনা টিকা সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের এক ডোজ। ফের বলা হচ্ছে দুই ডোজ। রাশিয়ার টিকা স্পুটনিক-ভি ও স্পুটনিক-লাইট দুই ডোজ করে। বলা হচ্ছে চীনা টিকা দেয়া হবে মেডিক্যাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। তাদের রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়েছে। যারা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পায়নি তারা নির্বাচন কমিশনের এনআইডি ওয়ালেট থেকে ডাউনলোড করে লেমিনেট করে নিচ্ছে। তবে এগুলো স্মার্ট কার্ড নয় কাগজের কার্ড। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়া শুরু হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। দুই ডোজ টিকার এখনও অনেকে বাকি ডোজ পায়নি। সাধারণ মানুষ সংবাদপত্রে ও হাসপাতালে প্রতিনিয়ত খবর নিচ্ছে কবে ফের টিকা দেয়া শুরু হবে। কোন উত্তর মিলছে না। তারা শুধু আশার বাণী শুনছে- টিকা এল বলে। এদিকে সীমান্ত জেলাগুলোতে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কোভিড-১৯ নিত্যদিন বাড়ছে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কোভিড-১৯ মৃত্যুহার বাড়ছে। উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোভিড-১৯ মৃত্যুর হার দ্রুত ওঠানামা করছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তারা শুধু জানছে খবরগুলো। মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন যখন প্রয়োজন লকডাউন দিচ্ছে। এ পর্যন্তই। তারপর! সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা না এলে কি আর করা- এমন মন্তব্য একজন কর্মকর্তার। মাস্ক না পরার কারণে জরিমানা করা হচ্ছে। রেস্টুরেন্টে শারীরিক দূরত্ব না মেনে খাওয়া-দাওয়া করায় কর্তৃপক্ষকে বড় অঙ্কের অর্থের জরিমানা। নির্দিষ্ট সময়ের পর দোকানপাট খোলা রাখার জন্য জরিমানা। তারপরও শহরে নগরে পথেঘাটে যানবাহন মার্কেটে মানুষের ভিড়। অনেকের মুখে ঢাকনা নেই। কারও থাকলেও থুতনির নিচে ঝুলিয়ে রেখেছে। যখনই শোনে ভ্রাম্যমাণ আদালত আসছে তখনই পথের ধারে ভাসমান দোকানিদের কাছ থেকে মাস্ক কিনে নেয়। শহরের প্রতিটি পয়েন্টে বসেছে মাস্কের ভাসমান ভেন্ডাররা। যাদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। এদেরও অনেকে মাস্ক পরে না। এই অবস্থার মধ্যে হালে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর তৃতীয় ঢেউ আরও কঠিন। দ্বিতীয় ঢেউ কবে শেষ হবে তা জানে না কেউ। সাধারণের প্রশ্ন তৃতীয় ঢেউ শুরু হলে বর্তমানের এই অবস্থার উন্নতি হবে! কোন প্রশ্নের উত্তর মেলে না। কেউ সচেতন হচ্ছে না। তবে ঘরে-বাইরে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, সকলের মধ্যে বিরাজ করছে কোভিড-১৯ আতঙ্ক। যে আতঙ্ক ভূমিকম্প বজ্রপাতের আতঙ্ক থেকে বেশি। এই আতঙ্কে গত এক বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়েছে। সামাজিক মাধ্যমের ওপর জরিপকারী পোল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নেপোলিয়নক্যাটের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী বেড়েছে প্রায় এক কোটি। বর্তমানে এই সংখ্যা (মে ২০২১ পর্যন্ত) প্রায় ৫ কোটি। একই সময়ে চারগুণ বেড়েছে ফেসবুকের মেসেঞ্জার ব্যবহারকারী। যে সংখ্যা ৪ কোটি ২২ লাখ। গত বছর এপ্রিল মাসে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৪ লাখ। ইনস্টাগ্রাম হোয়াটসএ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। সামাজিক এসব মাধ্যমের সিংহভাগ ব্যবহারকারীর বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর। তবে প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের সংখ্যাও কম নয়। জরিপের ফল ঠিক বলে ধরে নিলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, কোভিড-১৯ আতঙ্কিত মানুষ অন্তর্জাল (ইন্টারনেট) সংস্কৃতির ওপর ভর করে আতঙ্ক থেকে রিলিফ পেতে চাইছে। এদিকে মনোবিজ্ঞানীগণের কথা, বেশিরভাগ পরিবারের মধ্যে এক ধরনের সাইকোলিজিক্যাল ডিসরাপশন শুরু হয়েছে। পাবিরারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে। দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাবে পরিবারগুলোই বিরাজ করছে এক ধরনের ভঙ্গুরতা। অর্থনৈতিক চাপ, করোনার মৃত্যু ভয়ের সঙ্গে স্ট্রেসড (মানসিক চাপ) আক্রান্ত মানুষের আবেগও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে। একজনের রাগ কখনও এতটাই বিরক্তি ও ক্ষোভ তৈরি করছে যে প্রিয়জনকে মানসিক ও শারীরিকভাবে আঘাত করা হচ্ছে অনিচ্ছার পরও। সৃষ্টি হচ্ছে ধৈর্য শূন্যতা। হতাশা বেড়ে গিয়ে সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয়ে সামাজিক অপরাধও বেড়ে যাচ্ছে। অবক্ষয়ের পালায় অনেক তরুণ-তরুণীর মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় টিকটক ও লাইকির মতো সোশ্যাল মিডিয়া তরুণ-তরুণীদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। যা নিয়ন্ত্রণ করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। টিকটক বিষয়ে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিক সংকেত এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘চীন থেকে আসা টিকটক করোনার মতোই আমাদের এখানে সমাজদূষণ ভাইরাস ছড়াচ্ছে। সহজ বিনোদনের ও শিক্ষণীয় বার্তা প্রচারের এই মাধ্যমটির অশালীন অপপ্রয়োগ শুরু হয়েছে।’ কোভিড-১৯ সম্পর্কে এখনও বেশিরভাগ মানুষ জানে পৃথিবীতে একটি ভয়ঙ্কর রোগ এসেছে করোনা। শহরের মানুষের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা আছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে তাও নেই। তারা মাস্ক পরে না। সোনাতলা উপজেলার রানীরপাড়া গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি জহুরুল ইসলাম বললেন, এ যেন অন্ধকার ঘরে সাপ খোঁজার মতো। অন্ধকার ঘরের করোনা সাপটি ধরে মেরে ফেলার কত চেষ্টা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের। আর মানুষ অসচেতন। এর মধ্যে আবার কিছু গোঁয়ার গোবিন্দ আছে। দেশের মানুষের খন্ড খন্ড ভাবনার বিশ্লেষণ। অর্থনীতিবিদগণের ভাবনা অর্থনীতি নিয়ে। ব্যবসায়ীর ভাবনা শুধু ব্যবসা। সমাজবিজ্ঞানীর ভাবনা সমাজের অবস্থা নিয়ে। শিক্ষাবিদগণ আছেন সন্তানদের শিক্ষা ও লেখাপড়া নিয়ে। ডাক্তার প্রকৌশলীরা কাজে ব্যস্ত। মনোবিজ্ঞানীদের ভাবনা মানসিক অবস্থা নিয়ে। এই অবস্থায় সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব বর্তেছে রাষ্ট্রনেতা ও রাজনীতিকদের। কোভিডকালে মানুষের সমষ্টিগত ভাবনা একত্রিত করে কত দ্রুত মানুষের এই আতঙ্ক দূর করা যায় এই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাওয়ার সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সকল রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে হাসি বড় ভূমিকা রাখে। হাসলে ফুসফুসে মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ায়। চিন্তা-ভাবনা শাণিত করে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাগুলো সুসংহত করে। সম্পর্কের উন্নতি ঘটায়। আত্মবিশ্বস বাড়ে। বিশ্বে হাসি নিয়ে গবেষণা ফুরোয়নি। এই হাসি কোভিডকালে মানসিক চাপ দূর করে সুস্থতার বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কবে হাসবে বিশ্বের মানুষ।
×