ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদ্যুত প্রকল্পের বর্জ্যে নাব্য হারাচ্ছে কোহেলিয়া

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১২ জুন ২০২১

বিদ্যুত প্রকল্পের বর্জ্যে নাব্য হারাচ্ছে কোহেলিয়া

নিজস্ব সংবাদদাতা, মহেশখালী, ১১ জুন ॥ চারদিকে সাগর আর নদীবেষ্টিত বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষা উপকূলীয় দ্বীপ মহেশখালীর কোহেলিয়া নদী। নদীটি চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার পশ্চিম সীমান্ত ধরে মহেশখালীর কালার মার ছড়া, মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। যুগ যুগ ধরে জোয়ার-ভাটায় আপন গতিতে বয়ে চলেছে। নদীর দুই পাড়ে ছিল সবুজ বনানী। ছিল পাখপাখালির কলকাকলি আর নদী ভরা মাছ। তবে বর্তমানে স্রোতস্বিনী কোহেলিয়া হারিয়েছে তার গতি। ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে মরা গাঙ্গে। সাম্প্রতি সময়ে মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের দুর্গন্ধযুক্ত বর্জ্য আর পলি জমে দিন দিন নাব্য হারিয়ে কোহেলিয়া নদী এখন মৃতপ্রায়। মাতারবাড়ীতে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য কোহেলিয়া নদীর পশ্চিম পাড়ে মাতারবাড়ীর দক্ষিণে ১ হাজার চার শ’ ১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বর্তমানে মাটি ভরাট করে প্র্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলছে। অপরদিকে কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের জন্য নদী ভরাট করে মাতারবাড়ী সেতু থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩০০ ফুট প্রস্থ বিশাল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সকড়টি নির্মাণের দায়িত্ব পায় মীর আকতার হোসেন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে কোহেলিয়া। ফলে নদীতে চলাচলকারী ইঞ্জিনচালিত লবণের বোট ও বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের বর্জ্য ও সাগর থেকে তুলে পলি পাইপের মাধ্যমে সরাসরি কোহেলিয়া নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীটি। ভরাটের কারণে নদীতে চলাচল করা ইঞ্জিনচালিত লবণের বোট ও বিভিন্ন ধরনের নৌযান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বেকার হয়েছে নৌযানের মাঝিমাল্লা ও শ্রমিকরা। এছাড়া বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর পানিও দূষিত হচ্ছে। পানি দূষিত হওয়ায় সামুদ্রিক মাছসহ মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী। এতে করে বন্ধ হয়ে গেছে মাছ ধরা। বেকার জীবনযাপন করছে নদীর ওপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার জেলে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পে এখনও দূষিত কয়লা ব্যবহার করা হচ্ছে না। কয়লা ব্যবহারের আগেই প্রকল্পের বর্জ্য যেভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে, প্রকল্পের কাজ শেষে কয়লা পোড়ানো হলে আশপাশের নদী ও সমুদ্রের পানির দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে তাদের আশঙ্কা। জাতীয় নদী জোট ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) একটি টিম গত জানুয়ারিত কোহেলিয়া নদী পরিদর্শনে গিয়েছিল। প্রকাশ্যে নদী ভরাটের দৃশ্য দেখে মর্মাহত হয়েছেন তারা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেছেন, মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের নামে কোহেলিয়া নদী ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। যেজন্য কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের পলিমাটি ও দুর্গন্ধযুক্ত বর্জ্য নদীর সঙ্গে মিশে পানি দূষিত হচ্ছে। যার কারণে একদিকে যেমন নদী ভরাট হচ্ছে অন্যদিকে দখলের কারণে ছোট হয়ে যাচ্ছে নদী। এভাবে দূষণ ছড়াতে থাকলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে বলেও জানান তারা। এমনকি এলাকার মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন পরিবেশবাদীরা। মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের পলিমাটি নদীর পানিতে মিশে বর্তমানে নদীর পানি দূষিত হওয়ায় দুইপাশে প্রায় অর্ধশত চিংড়ি প্রোজেক্টে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে মাছের পোনাসহ নানা প্রজাতির মাছ মারা যাচ্ছে। এ কারণে চিংড়ি প্রোজেক্টের ইজারাদারদের বর্ষায় লোকসান গুণতে হয়। কোহেলিয়া নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক সাংবাদিক আবুল বশর পারভেজ বলেন, কক্সবাজার উপকূলের নদী পথে মালামাল পরিবহন ও যাতায়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা কোহেলিয়া নদীটি দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হারিয়ে যাবে এ নদী। নদী ভরাট ও বর্জ্য ফেলা বন্ধ করে নদীর গভীরতা ফিরিয়ে আনা এবং দখলদারের হাত থেকে কোহেলিয়াকে উদ্ধারের দাবি জানান তিনি। কোহেলিয়া নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিকসহ উর্ধতন নেতৃবৃন্দ কোহেলিয়া নদী পরিদর্শন করেছেন। সচিব ও এমপি শীঘ্রই নদী ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন। কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের বর্জ্য ফেলে দূষণের বিষয়ে তিনি বলেন, নদীতে কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের বর্জ্য ফেলার বিষয়টি গত ৭ জুন কোলপাওয়ার কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আগামীতে বিদ্যুত প্রকল্পের কোন বর্জ্য যাতে কোহেলিয়া নদীতে ফেলা না হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
×