ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কেবিনের টিকেট নিতে অতিরিক্ত ৫০০-১০০০ টাকা দিতে হয়

দালালের কাছে জিম্মি ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চযাত্রীরা

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ১১ জুন ২০২১

দালালের কাছে জিম্মি ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চযাত্রীরা

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের সবচেয়ে আরামদায়ক পথ হচ্ছে নৌপথ। দীর্ঘদিন থেকে এ রুটে চলাচল করে আসছে দেশের সবচেয়ে বিলাসবহুল লঞ্চ। তবে আরামদায়ক এ রুটের যাত্রী ও পর্যটকের কাছে বিলাসবহুল লঞ্চের কেবিনের টিকেট যেন সোনার হরিণ। অধিকাংশ লঞ্চ কোম্পানির টিকেট বিক্রির কাউন্টারে মিলছে না কেবিনের টিকেট। সব কাউন্টার থেকেই জানানো হচ্ছে, টিকেট নেই। তবে টিকেট পাওয়া যায় কালোবাজারে দালালের কাছে। অতিরিক্ত পাঁচ শ’ থেকে এক হাজার টাকা বেশি দিয়ে বিলাসবহুল লঞ্চের কেবিনের টিকেট সংগ্রহ করতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীকে। দীর্ঘদিন থেকে বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও সাধারণ যাত্রী ও বরিশাল ভ্রমণে আসা পর্যটকের ভোগান্তি লাঘবে রহস্যজনক কারণে দালালের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে প্রতিদিন কমপক্ষে দশটি লঞ্চ চলাচল করছে। বিলাসবহুল লঞ্চের মধ্যে রয়েছে-এমভি মানামী, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, সুরভী, কীর্তনখোলা, এ্যাডভেঞ্চার, পারাবত, ফারহান ইত্যাদি। এসব লঞ্চে সিঙ্গেল, ডবল, ভিআইপি, সেমি ভিআইপি, শৌখিন, ফ্যামিলি ও ভিভিআইপি ক্যাটাগরিতে কয়েক হাজার কেবিন রয়েছে। অতীতে মূলত ঈদের পূর্বেই দেখা যেত লঞ্চের কেবিন সঙ্কট। সে সময় রমজান শুরুর পর থেকেই সাধারণ যাত্রী ও তাদের স্বজনরা কেবিনের টিকেট পেতে লঞ্চের অফিস ও কাউন্টাওে দৌড়ঝাঁপ শুরু করতেন। ওই সময় তাদের (যাত্রী) কাছ থেকে ¯িøপ জমা রাখা হতো। পরবর্তীতে নির্ধারিত সময়ে তাদের (সাধারণ যাত্রী) নামে কোন কেবিন থাকত না বলে অভিযোগ রয়েছে। কেবিনের খাতায় নাম থাকে প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা মালিকপক্ষের লোকজনের। এ কারণে প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে প্রভাবশালী ব্যক্তি অথবা লঞ্চ মালিক পক্ষের লোকজনের মাধ্যমে কেবিন নিতে হতো সাধারণ যাত্রীকে। বাড়ি ফেরার নানা ঝক্কিঝামেলার সঙ্গে যোগ হতো লঞ্চের টিকেট পাওয়ার জন্য লবিং ও তদ্বির। আর যাদের প্রভাবশালীদের সঙ্গে পরিচয় নেই তারা অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে কালোবাজারে দালাল চক্রের ওপরই ভরসা। অসংখ্য যাত্রীর অভিযোগ, লঞ্চের কাউন্টারে টিকেট পাওয়া না গেলেও বরিশাল নদী বন্দরে দালালদের দাবিকৃত অতিরিক্ত পাঁচ শ’ থেকে এক হাজার টাকা দিলেই পাওয়া যায় ঈদ মৌসুমে কেবিনের টিকেট। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে শুধু ঈদ মৌসুমেই নয় করোনার চলমান সময়েও দালালদের কাছে ঈদ মৌসুম চলছে। এত লঞ্চের কয়েক হাজার কেবিনের টিকেট কোথায় যাচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চারদিন ধরে বরিশাল নগরীর পারাবত, সুন্দরবন, সুরভী, মানামী, কুয়াকাটা, কীর্তনখোলা লঞ্চ কাউন্টারে গিয়ে কোন কেবিনের টিকেট পাওয়া যায়নি। তবে সন্ধ্যার পূর্বে বরিশাল নদী বন্দরের পন্টুনে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেই দেখা যায় টিকেটের ছড়াছড়ি। অনেকটা প্রকাশ্যেই হাঁকডাক দিয়ে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা হয় বিলাসবহুল লঞ্চের কেবিনের টিকেট। এসব টিকিট কোথা থেকে এলো? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশেষ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লঞ্চের কাউন্টার থেকে অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে টিকেট কালোবাজারি করে থাকে একটি চক্র। বিভিন্ন লঞ্চের অসাধু কতিপয় কর্মকর্তার সহযোগিতায় লঞ্চের ‘কলম্যান অথবা খালাসিরা’ এসব টিকেট কালোবাজারে বিক্রি করছে। এছাড়া লঞ্চের স্টাফদের সহযোগিতায়ও সরাসরি দালাল চক্র কালোবাজারে অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে যাত্রীর কাছে কেবিনের টিকেট বিক্রি করছে। সূত্রমতে, বরিশাল লঞ্চঘাটে কালোবাজারে টিকেটের দালাল চক্রের তালিকায় সর্বপ্রথম যে নামটি শোনা যায় সে হচ্ছে দালাল লেদু। দীর্ঘদিন থেকে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের টিকেট কালোবাজারে বিক্রির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে লেদু। কোন কাউন্টারে টিকেট থাকুক আর না থাকুক লেদুর কাছে কেবিনের টিকেট ঠিকই থাকবে। অবৈধভাবে কালোবাজারে লঞ্চের কেবিনের টিকেট বিক্রি করে লেদু রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, লেদুর পাশাপাশি বশির ও খোকন নামের দালাল যুক্ত রয়েছে পারাবত লঞ্চের টিকেট কালোবাজারে বিক্রির সঙ্গে। নগরীর কেডিসি এলাকার জুয়েল কুয়াকাটা-২ লঞ্চের টিকেট কালোবাজারে বিক্রি করে। লঞ্চঘাটে বসে জুয়েল নিজেই স্বীকার করে বলেন, তিনি একাই নন; জামাল, বারেক, রানাসহ বেশ কয়েকজন কুয়াকাটা-২ লঞ্চের কেবিনের টিকেট কালোবাজারে বিক্রি করছেন। বিলাসবহুল আরেক লঞ্চ মানামীর টিকেট কালোবাজারে করেন রিপনসহ বেশ কয়েক দালাল। এসব দালাল দীর্ঘদিন থেকে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বিলাসবহুল লঞ্চের কেবিনের টিকেট কালোজারে বিক্রির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তবে যাত্রীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা না করে মূলত এসব দালাল অতিরিক্ত মুনাফার লোভে অবৈধ কাজটি করে থাকেন। সবুর হাওলাদার নামের এক লঞ্চযাত্রী বুধবার সন্ধ্যায় লঞ্চ টার্মিনালে বসে বলেন, লঞ্চের কেবিনের টিকেটের জন্য আমি দুদিন আগেই কয়েকটি লঞ্চের কাউন্টারে যোগাযোগ করেছি। প্রতিটি কাউন্টার থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের সব কেবিন বুকিং করা। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যায় আমি যখন লঞ্চঘাটে আসি ঠিক তখনই দেখি পারাবত লঞ্চের সামনে কেবিন খালি আছে বলে অনেকেই ডাকাডাকি করছেন। পরবর্তীতে আমি অতিরিক্ত সাত শ’ টাকা দিয়ে একটি কেবিন সংগ্রহ করেছি। মকবুল হোসেন নামের আরেক যাত্রী বলেন, টিকেট নাই কিন্তু ঠিকই লঞ্চঘাটে দালালদের কাছে টিকেট পাওয়া যাচ্ছে। এসব টিকেট যদি লঞ্চের কাউন্টার থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে অতিরিক্ত মূল দিয়ে কাউকে টিকেট কিনতে হতো না। সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলার সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে দালালের দৌরাত্ম্যের কথা শোনা গেলেও এবার করোনার মধ্যেই দালাল কর্তৃক যাত্রী হয়রানির অভিযোগ উঠেছে।
×