ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বছরে আসছে ৪০ কোটি পিস মামলা হয়েছে ২০ হাজার

সর্বনাশা ইয়াবা ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ১১ জুন ২০২১

সর্বনাশা ইয়াবা ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই

শংকর কুমার দে ॥ কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছেনা সর্বনাশা মরণ নেশার মাদক ইয়াবা। একের পর এক চালান আসছেই। বেপরোয়া ইয়াবা চোরাচালানি চক্রের সিন্ডিকেট। ইয়াবা কারবারিদের আইনী সহায়তা, আত্মসমর্পণ, পুর্নবাসন, বন্দুকযুদ্ধ, জিরো টলারেন্স, কঠোর হুঁশিয়ারি সবই যেন অরুণ্যের রোদন। প্রতি দিনই ধরা পড়ছে ইয়াবা কারবারি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৪০ কোটি পিস ইয়াবার চালান আসছে। উদ্ধার হচ্ছে মাত্র এর ১০ শতাংশ। গত দুই বছরে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ছোট বড় ৪ শতাধিক মাদক কারবারি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের জালে আটকা পড়েছে ৫ হাজারের বেশি মাদক কারবারি ও মাদকসেবী। গত দুই বছরে আটক করা হয়েছে প্রায় ৮ কোটি পিস ইয়াবা যার বাজার মূল্য প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা। প্রায় ২০ হাজার মামলা হয়েছে। তবু ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবার চালান আসা। দেশে নিয়মিতই ঢুকছে সর্বনাশা মাদক ইয়াবা। ইয়াবা সেবন, কারবার ছাড়াও বিভিন্ন দেশের ইয়াবা চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানি চক্র। এই বিশাল অঙ্কের ইয়াবার চোরাচালানের বাজার হারাতে চাচ্ছে না পার্শ¦বর্তী দেশ মিয়ানমার। এ জন্য শত চেষ্টা করেও ইয়াবার চালান আসা বন্ধ করতে পারছে না বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন ইউনিট। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ ৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ একজনকে গ্রেফতার করেছে। গত বুধবার পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এক ইয়াবা কারবারিকে গ্রেফতার করে তার কাছে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক হাজার পিস ইয়াবা। গ্রেফতারকৃতের নাম- কছির উদ্দিন (২৩)। রাজধানীর পল্টন থানার আনন্দ ভবন কমিউনিটি সেন্টার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। কছির কক্সবাজার জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা হতে ইয়াবা সংগ্রহ করে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় মাদক কারবারিদের কাছে বিক্রয় করত বলে পুলিশের দাবি। এর আগের দিন মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ইয়াবাসহ ৬ জন মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২০ হাজার পিস ইয়াবা। গ্রেফতারকৃতরা হলো, হারুন অর রশিদ (৩৩), কালা মিয়া (৭৫), মোঃ বাছা মিয়া (৩৫), মোঃ ইমরান হোসেন ওরফে রাজা (৩৫), মোঃ জসিম উদ্দিন (৩৮) ও মুক্তা বেগম (৩৫)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে, কক্সবাজার জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা হতে উক্ত ইয়াবা সংগ্রহ করে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় মাদক কারবারিদের কাছে বিক্রয় করত। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সদর দফতরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অপরাধ পর্যালোচনা বিষয়ক এক সভায়ও তুলে ধরা তথ্যে বলা হয়েছে, সীমান্তে নিরাপত্তা থাকা সত্তে¡ও মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালান বন্ধ করা যাচ্ছে না। বৈঠক থেকে ইয়াবাসহ মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সীমান্তে নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরী। মিয়ানমার থেকে নানা কৌশলে টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, থেকে মাদক কারবারিরা ইয়াবা পাঠানো হচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। রাজধানী ঢাকা থেকে ইয়াবা চলে যাচ্ছে দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, মানুষের হাতে হাতে। হাত বাড়ালেই এখন পাওয়া যাচ্ছে মরণ নেশা ইয়াবা। বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিটের চোখ ফাঁকি দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত ইয়াবা কারবারের সিন্ডিকেট। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইয়াবার প্রধান উৎস মিয়ানমার। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দুই পাড়ের পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলো বহাল তবিয়তে আছে। ভারতের কিছু অংশ ও থাইল্যান্ড থেকে ইয়াবা আসছে। এই প্রতিবেশী দেশ থেকে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে ইয়াবা। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বেশিরভাগ সদস্যের বিরুদ্ধে সরাসরি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে সীমান্তরক্ষীদের কারও কারও সহযোগিতায় আসছে ইয়াবা। সমুদ্রপথে ইয়াবা টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, সাবরাং, উখিয়া উপজেলার মনখালী, মহেশখালীর সোনাদিয়া, ঘটিভাঙ্গাসহ পেকুয়া উপজেলার মগনামা ও উজানটিয়া, কুতুবদিয়া ও আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্রপথে খালাস করা হয়। বিশেষ করে টেকনাফ উপক‚ল দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঢুকছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চোরাচালান আসা যেন অপ্রতিরোধ্য হয়েই উঠেছে। বন্দুকযুদ্ধ, আত্মসমর্পণ, আইনী সহায়তা ও পুনর্বাসনের আশ্বাস কোন কিছুতেই ভ্রƒক্ষেপ করছে না ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের সদস্যরা। নানা কৌশলে টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, থেকে মাদক কারবারিরা ইয়াবা নিয়ে আসছে রাজধানী ঢাকায়। বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিটের চোখ ফাঁকি দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা অব্যাহত আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কোন ইয়াবার চালান ধরা পড়ার পর ইয়াবা পাচারে নতুন কৌশল অবলম্বন করে ইয়াবা সিন্ডিকেট। ইয়াবা পাচারের জন্য রোগী বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স, ডাক বিভাগের গাড়িসহ নানা ধরনের গাড়িতে বহনের পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি ও কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেলের মাধ্যম কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবা চালান বন্ধ না হওয়ার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে, মানুষ ইয়াবা সেবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন চাহিদা থাকলে তো জোগান আসবেই। এখনও কিছু রোহিঙ্গা ইয়াবা চালানের বাহক হিসেবে কাজ করছে। ইয়াবাসহ মাদক চোরাচালান বন্ধে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সত্তে¡ও প্রতিদিনই ইয়াবার চালান আসছে, আমরা অভিযান চালাচ্ছি। ইয়াবা উদ্ধার ও ইয়াবাসেবী ও কারবারিদের আটক করছি। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, জলসীমান্তের কাজ করছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড বাহিনী। স্থলসীমান্তে কাজ করছে বিজিবি। তারপরও প্রায়ই ইয়াবাসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য আসছে, আটকও করছেন এই বাহিনীর সদস্যরা। মিয়ানমারে তো আছেই। বাংলাদেশেও অনেক অসাধু লোক এই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দুই দেশে অবস্থান করা কিছু রোহিঙ্গাও জড়িত আছে এই ইয়াবা ব্যবসায়ের সঙ্গে। যারা ইয়াবার সঙ্গে ধরা পড়ছে, তারা মূলত বাহক। মূল ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে ধরা গেলে ইয়াবার চালান কমে আসবে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×