ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ী সীমান্ত সুরক্ষা চ্যালেঞ্জিং

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ১১ জুন ২০২১

পাহাড়ী সীমান্ত সুরক্ষা চ্যালেঞ্জিং

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বর্তমান সরকারের গৃহীত যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে দেশের তিন পাহাড়ের সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমারসংলগ্ন সীমান্ত নিরাপত্তা সুরক্ষার কাজ দ্রæতগতিতে এগিয়ে চলেছে। নির্মিত হচ্ছে ১১শ’ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক। নতুন করে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে বিজিবির ৪০টিরও বেশি বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট)। তিন পর্যায়ে বাস্তবায়নযোগ্য এ প্রকল্পের আওতায় তিন পাহাড় পথে অস্ত্রসহ সব ধরনের চোরাচালান, বেআইনী তৎপরতা যেমন রোধ হবে, তেমনি তিন পাহাড়ী এলাকার সীমান্তসংলগ্ন এলাকার প্রভূত উন্নতি ঘটবে বলে সরকারী সংশ্লিষ্ট সূত্রে তথ্য দেয়া হয়েছে। জনকণ্ঠের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি তথ্যানুসন্ধান করে জানিয়েছেন, ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মিয়ানমারের রাখাইন ও চীনসংলগ্ন বাংলাদেশের যে সীমান্ত রয়েছে ওই এলাকাজুড়েই প্রথম পর্যায়ে প্রায় ১১শ’ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ দ্রæতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এ কাজে ১৭শ’ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করা হচ্ছে। সুদূর পাকিস্তান আমল থেকে এ তিন পাহাড়ের সঙ্গে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের সীমান্তসংলগ্ন এলাকা ছিল একেবারে অরক্ষিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অতীতের কোন সরকার এত বড় চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প গ্রহণ করেনি। বর্তমান সরকার সড়ক ও জনপথ (সওজ) এবং সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে এ কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের গৃহীত ও বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য সীমান্ত সুরক্ষায় গৃহীত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বহুমুখী অর্জন হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। অপরদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে সওজ বিভাগ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সীমান্তের মাদক, অস্ত্র ও চোরাচালান বন্ধসহ পর্যটন শিল্পে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে দুর্গম পাহাড়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পদে পদে প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এর ওপর রয়েছে পাহাড়ী চাঁদাবাজদের অপতৎপরতা। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের জীবনের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে রেখে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, এলাকার নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে ৪০টিরও বেশি নতুন বিওপিও প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। অরক্ষিত সীমান্তের সুরক্ষা এবং আগামীতে এলাকাজুড়ে উন্নয়নের এ বিষয়টি পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কেননা, সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য পাহাড়ের সীমান্তবর্তী এসব এলাকা থেকে তাদের সকল অপকর্ম গুটিয়ে ফেলতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সেখানে বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ এবং পর্যটন শিল্পেরও উন্নয়ন ঘটবে। সূত্রে জানানো হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের ৭৪ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই । বিজিবির কোন বিওপিও নেই। অর্থাৎ সম্পূর্ণ অরক্ষিত। যেখানে সীমান্তের এসব এলাকা দিয়ে অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান, মাদক পাচার এবং এর পাশাপাশি অবাধ চলাফেরা বিদ্যমান। ফলে বিঘিœত হচ্ছে দেশের ও জনগণের নিরাপত্তা। মূলত এ প্রেক্ষাপটেই সরকার সীমান্তের এসব এলাকায় বিজিবির টহল বাড়িয়ে সব ধরনের অপকর্ম রোধে এবং অবাধ যাতায়াত সুবিধার জন্য সড়ক নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে । সূত্র জানায়, সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারে বিওপি অত্যাবশ্যক। এ বিষয়টি সামনে রেখে নতুন ৪০টিরও বেশি বিওপি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা এ প্রকল্পের একটি অংশ। সরকারী সংশ্লিষ্ট সূত্রে ধারণা দেয়া হয়েছে, বিওপি প্রতিষ্ঠা হলে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, অস্ত্রসহ মাদক চোরাচালান ও প্রতিবেশী দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় অবাধ বিচরণ রোধ হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো ভূমি দখলের মিথ্যা ও বানোয়াট বিভিন্ন তথ্য প্রচার করে যাচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ২৪ ও ২৮ এপ্রিল কমলাক পাড়া, তালছড়া এবং ছৈনালছড়ার এলাকাবাসীকে মাঠে নামিয়ে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনে বাধা প্রদান করে ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রæপের সন্ত্রাসীরা। প্রথাগত নিয়মের দোহাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সব ধরনের ভূমি উপজাতীয়দের বলে দাবি তুলে ইউপিডিএফ সাধারণ মানুষদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভে নামিয়ে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে পাহাড়ের কুচক্রী মহল উন্নয়নমূলক কাজের বিরোধিতা করে আসছে। আর এখন বিরোধিতা করছে সীমান্তে নিরাপত্তা কাজেও। যেখানে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিষয়টি খুবই আশ্চর্যজনক! তারা সবকিছুতে বিরোধিতা করে আসছে । আসলে এই সন্ত্রাসীরা কী চায়-তা রহস্যজনক। বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, সীমান্তে নিরাপত্তা স্থাপন কাজে বাধা দেয়া মানে তারা চায় দেশের পাহাড়সংলগ্ন সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত থাকুক । যদি তারা তা না চায়, তাহলে ভূমি দখলের অজুহাত দিয়ে সীমান্তে সড়ক নির্মাণ ও বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন কাজের বিরোধিতা করতে পারে না। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই, যারা সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করে রাখেনি। সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য আন্তর্জাতিক আইনও রয়েছে। অনাহূতভাবে রাষ্ট্রের সব পদক্ষেপে বাধা দেয়া মঙ্গলময় হতে পারে না। এদিকে সওজ সূত্রে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে ৫৪০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকাটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত থাকার সুবাধে চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক পাচারের ঘটনা ঘটাচ্ছে দুষ্কৃৃতকারীরা। তাই সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে বিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ রক্ষা ও পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য ১১শ’ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের পদক্ষেপ নিয়েছে বর্তমান সরকার। এরমধ্যে ৩১৭ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে ১৬৯৯ কোটি ৮৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘সীমান্ত সড়ক (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা) নির্মাণ প্রকল্প প্রথম পর্যায়’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ। গত ২০১৮ সালের ২০ মার্চ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে ১ম পর্যায়ের এ কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি, বরকল ও রাজস্থলী উপজেলা, খাগড়াছড়ি জেলার বাঘাইছড়ি, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার সীমান্তসংলগ্ন এলাকাজুড়ে প্রথম পর্যায়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এরমধ্যে ঠ্যাগামুখ-লইতংপাড়া-থানচি-দুমদুমিয়া-রাজস্থলী পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার, সাজেক-দোকানঘাট-ঠ্যাগামুখ পর্যন্ত ৯৫ কিলোমিটার, সাজেক-শিলদা- বেতলিং পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার এবং উখিয়া-আশারতলী-ফুলতলী পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সড়ক নির্মিত হবে। সড়ক ও জনপথ রাঙ্গামাটি জোনের তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম জনকণ্ঠকে জানান, সীমান্ত এলাকা সুরক্ষার পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের ১১শ’ কিলোমিটার সড়ক প্রথম পর্যায়ে নির্মিত হলে পরবর্তীতে আরও দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। তিন পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। বর্তমানে প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয়ে এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তিনি জানান, নতুন সীমান্ত সড়কটি নির্মিত হলে ওই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হবে। পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে। পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত ও সহজতর হবে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল ওহাইদ জানান, সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় যোগাযোগ সুবিধা নেই। অনেক এলাকা এখনও অরক্ষিত। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে পুরো সীমান্ত এলাকা সুরক্ষিত হবে। এতে সীমান্তের অনেক এলাকা পরিপূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বহু এলাকা অত্যন্ত দুর্গম। দুর্গম এসব এলাকায় যাতায়াতেরও কোন সুযোগ নেই। অনেক বাধা বিপত্তিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যে কারণে প্রকল্পের প্রথম দিকে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। তার মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সবদিক থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। অপরদিকে, ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো প্রতিনিয়ত অভিযোগ তুলে আসছে সরকারকে বেকায়দায় রাখার জন্য। এটি তাদের একটি অপকৌশল। তবে একথাও সত্য যে, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের শতভাগ আওতায় এখনও আনা যায়নি। দুর্গম হওয়ায় এখনও দেশের অন্য জেলার তুলনায় সমপর্যায়ের নয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রæপের অবৈধ সব ধরনের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করা প্রয়োজন। পাহাড়ের সাধারণ মানুষ স্বঘোষিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর প্ররোচণায় যাতে প্ররোচিত হতে না পারে তার জন্য সামগ্রিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সূত্র। অপরদিকে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে প্রকল্পটিকে ভাল অগ্রগতি সম্পন্ন প্রকল্প হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় নির্মিতব্য সড়কের পাশের পাহাড়ের ঢাল হতে মাটি যাতে ধুয়ে সড়কে নেমে না আসে সেজন্য স্থানগুলোতে পাহাড় প্রোটেকশনের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী বলে মত ব্যক্ত করা হচ্ছে।
×