ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এল সালভাদরে আর্নেস্তো চে গুয়েভারা শাহ বুলবুল

প্রকাশিত: ২১:৩৬, ১১ জুন ২০২১

এল সালভাদরে আর্নেস্তো চে গুয়েভারা শাহ বুলবুল

সালভাদোরান কালজয়ী যোদ্ধাদের মতোই আদিবাসী কৃষাণীর ফসলি উঠোন আর মিছিল স্লোগানে আজও জেগে আছে আর্জেন্টাইন বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। এল চে হয়ে উঠার আগে অথবা জীবদ্দশায় বোহেমিয়ান ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনা একাধিকবার সফর করেছেন এমন দেশগুলোর একটি মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাদোর । ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে নিকারাগুয়ার মানাগুয়া থেকে হনডুরাস সীমান্ত ও সান সালভাদোর অতিক্রম করে আর্নেস্তো গুয়েভারা তার লক্ষ্যস্থল গুয়াতেমালায় আসেন। গুয়াতেমালা থেকে ভিসা সংক্রান্ত কাজে পুনারায় এল সালভাদোরে আসেন ১৯৫৪ সালের মে মাসের শেষ দিকে। গুয়াতেমালা থেকে আর্নেস্তো গুয়েভারা আর্জেন্টিনায়া তার মাকে মে এবং জুনে দুটি চিঠি লেখেন। একটি চিঠির তারিখ ১০ মে ১৯৫৪ সাল এবং অন্যটি ২০ জুন ১৯৫৪ সাল। মায়ের কাছে আর্জেন্টিনায় পাঠানো চিঠির সূত্রধরে বলা যায় ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা উল্লেখিত সময়ের মাঝে কোন এক সময় তার আবাসন ভিসার কাজে এল সালভাদোর সফর করেছিলেন। আর্নেস্তোকে নিয়ে তার বাবা আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চের স্মৃতিচারণমূলক বই ‘ইয়াং চে’ এর মতে ডাক্তার আর্নেস্তো মে মাসে গুয়াতেমালাতে ছিলেন এবং তার আবাসনের অনুরুধ প্রত্যাখ্যান হওয়ায় সে ভিসা পাওয়ার জন্য এল সালভাদোরে গিয়েছিলেন যাতে আর্নেস্তো গুয়াতেমালায় ফিরে আসতে পারেন। আর্নেস্তো চে গুয়েভারা দে লা সেরনার জীবনী লেখক জন লি আন্ডারসনের মতে, ২০ মে আর্নেস্তো এবং হিলদা গাদেয়া আকোস্তা গুয়াতেমালার সাকাতেপেকুয়েজ প্রদেশের সোমপাংগু গ্রামের পার্শ্ববর্তী সানজুয়ান গ্রামে রাতযাপন করেন এবং এটাই ছিল উভয়ের একত্রে প্রথম রাত্রিযাপন। জন লি আন্ডারসনের ভাষায় এর কিছু দিন পর মাত্র বিশ ডলার সম্বল করে আর্নেস্তো এল সালভাদোরে প্রবেশ করেন এবং ১৪ জুন গুয়াতেমালায় আর্নেস্তো গুয়েভারা তার ২৬তম জন্মদিন পালন করেন। এসব ঘটনা থেকে মনে হতে পারে আর্নেস্তো গুয়েভারা ভিসার আবেদন করতে এল সালভাদোর গিয়েছিলেন ১৯৫৪ সালের ২০ মে’র পরে এবং গুয়াতেমালার ভিসা পাওয়ার পর তিনি প্রত্যাখান করেন হনডুরাসের ভিসা । ১৯৫৪ সালে গুয়াতেমালায় সংঘঠিত শ্রমিক যুদ্ধের কয়েকদিন আগে ডাক্তার আর্নেস্তো এল সালভাদোর সফর করেন যখন আসন্ন যুদ্ধের ভয়ে এখানে নির্বাসিত ও বসবাসরত বিদেশীরা আশপাশের দেশগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারার তৎসময়কার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী হিলদা গাদেয়া আকোস্তা ভেবেছিলেন আর্নেস্তো হয়ত তাকে না বলেই দেশ ত্যাগ করেছে। তবে এল সাল ভাদোর থেকে চে যখন পুনরায় গুয়াতেমালায় ফিরে আসেন তখন সবচেয়ে আশ্চর্য ও খুশি হয়েছিলেন হিলদা। গুয়াতেমালায় সংঘটিত অন্যায় যুদ্ধে জনগণ পরাজিত হলে আর্নেস্তো গুয়েভারা আর্জেন্টিনায় ফিরে না গিয়ে নির্বাসিত হয়ে চিয়াপাশ সীমান্ত দিয়ে মেক্সিকোতে পা রাখেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৯ সালের আগেই বোহেমিয়ান আর্জেন্টাইন ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনা লাতিন আমেরিকার মাটি ও মানুষের চোখে গেরিলা যুদ্ধের দাবানল ‘চে গুয়েভারা’। গেরিলা যুদ্ধের দাবানল ছিটিয়ে দিতে চে ছুটে গেলেন নিকারাগুয়ার আদিবাসী কৃষক গ্রাম, কঙ্গোর তাংগানিকার আর বলিভিয়ার নাকাহুয়াজু। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ায় লা হিগুয়েরা গ্রামের টিনি স্কুলের কক্ষে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বিপ্লবী এই যোদ্ধাকে। জীবিত চে গুয়েভারার চেয়ে অমর চে’র বিপ্লবী দাবানল ছিল তীব্র থেকে আরও বেশি তীব্রতর যার লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে লাতিন আমেরিকাসহ সারাবিশ্বে চলমান সর্বহারা শ্রমিক আন্দোলনে। দুঃসময়ে এল সালভাদোরে আবারও ফিরে আসেন বিপ্লবী চে গুয়েভারা। সালভাদোরের গেরিলা যোদ্ধারা মনে করতেন অসকার রোমেরো, ফেলিসিয়ানো আমা, ফারাবোনদো মারতি, প্রোদেনসিয়া আয়ালা’র মতো আর্জেন্টাইন বিপ্লবী চে গুয়েভারা তাদের সঙ্গে আছেন এবং পাশে থেকে লড়াই করছেন। ১৯৫৪ সালের এপ্রিলের শেষভাগে ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা এল সালভাদোর সফরকালে বিশেষভাবে ঘুরে দেখেন মায়া সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন নাহুয়া পিপিলদের বসতি চালচুয়াপার তাজুমাল। এল সালভাদোরানরা ২০০৯ সালে বোহেমিয়ান আর্জেন্টাইন ডাক্তারের আগমনী বার্তা ভবিষ্যতের কাছে পৌঁছে দিতে চালচুয়াপার তাজুমালে স্থাপন করেন শিলালিপি সংবলিত বীর গেরিলা যোদ্ধার প্রতিকৃতি। বীর গেরিলা যোদ্ধা চে গুয়েভারার প্রতিকৃতির ঠিক নিচে শিলালিপিতে স্পেনিশ ভাষায় লেখা হয়-‘আমি ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে এল তাজুমালের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করেছি।’ এর নিচেই লেখা আছে-পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে, যে কারও প্রতি অবিচার হলে তা গভীরভাবে অনুভব করতে পারাটাই একজন বিপ্লবীর সবচেয়ে সুন্দর গুণ। সালভাদোরে গেরিলা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৮১ সালের ১১ ডিসেম্বর মোরাজান প্রদেশের গ্রামগুলোতে সংঘটিত হয় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড যা এল মোজতের গণহত্যা নামে পরিচিত। গণহত্যায় জীবনদানকারীদের স্মরণে এখানকার পেরকুইনে স্থাপন করা হয়েছে একটি যাদুঘর যাতে গণহত্যার সময় বেঁচে থাকা গেরিলা কমরেডরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন এবং আগত দর্শনার্থীদের কাছে খাবার, আর্নেস্তো চে গুয়েভারা টি-শার্ট এবং অস্কার রোমেরো সম্পর্কিত বই বিক্রি করেন। মোরাজানবাসীর মতো চালাতেনাংগোর আদিবাসী মানুষরাও গেরিলা যোদ্ধা আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে করেছেন তাদের অনিবার্য ইতিহাসের অংশ। গেরিলা যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামটিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করা হয় যা সোমপোল নদী গণহত্যা নামে পরিচিত। যুদ্ধ শেষ হলে বেঁচে থাকা কমরেডরা তাদের প্রিয় গ্রামটিকে আবারও ফিরিয়ে আনেন সবুজ অরণ্যে এবং শতশত স্বজন হারানো বেদনাকে মনে রাখতে নদীর তীরে স্থাপন করা হয় সান জোসে লাস ফ্লোরেস যাদুঘর; যেখানে সাহস আর শক্তির প্রতীক হিসেবে রাখা হয়েছে বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার ভাস্কর্য। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী এবং বর্তমান শান্ত এল সালভাদোরের সর্বত্র আদর্শিক শক্তি নিয়ে বিরাজ করছেন অমর বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। রাজপথের মুখরিত দেয়াল, পর্যটন, গেরিলা যুদ্ধের স্মৃতিবাহী যাদুঘর, বাম দলগুলোর নির্বাচনী প্রচার, শ্রমিক দিবসের র্যালি, দাবি আদায়ের ভাষায়-এল সালভাদোরের কোথায় নেই বিপ্লবী চে গুয়েভারা! দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য যে-যুদ্ধ, গণহত্যা আর খুনোখুনি সালভাদোরের ইতিহাসের একটা বড় অংশ তথাপি এখানকার লড়াকু মানুষ সবভুলে আবারও ফিরে গেছে ফসলে ক্ষেত আর নিবিড় জীবনের কাছে। গৃহযুদ্ধে সব হারানো একজন মাক্সবাদী গেরিলা রক্তের ছাপ আর যুগের বাস্তবতা হাতিয়ারের মতোই জমা রেখেছেন এল সালভাদোরের ইতিহাস অনুধাবনকারী নতুন প্রজন্মের কাছে। গণকবরের প্রতিবেশী এসব সালভাদোরানদের প্রেরণা বিপ্লবী চে গুয়েভারা যাদের বাহুতে সমাহিত গেরিলা যুদ্ধের উত্তরাধিকার।
×